কপ-৩০-এ বাংলাদেশ : প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ
অভিবাসন, ভূমি ক্ষয় এবং সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলোকে আন্তর্জাতিক জলবায়ু অ্যাজেন্ডার কেন্দ্রে রাখা, সময়োপযোগী ও কার্যকর সহায়তা নিশ্চিত করা। - মোহাম্মদ নাভিদ সফিউল্লাহ [প্রকাশ : নয়াদিগন্ত, ৩ ডিসেম্বর ২০২৫]

আমাজনের প্রবেশদ্বার বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ-৩০ (COP-30) বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু আলোচকদের বৈশ্বিক মিলনক্ষেত্র হওয়ার চেয়েও অনেক বেশি কিছু ছিল। এটি ছিল টিকে থাকা, মর্যাদা ও জলবায়ু ন্যায্যতার জন্য জোরালো দাবি জানানোর মঞ্চ।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, তীব্র ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, খরা ও জলবায়ু-তাড়িত বাস্তুচ্যুতির মতো বিষয়গুলো তুলে ধরে বাংলাদেশ কপ-৩০-কে ব্যবহার করেছে বৈশ্বিক সংহতি, দৃঢ় পদক্ষেপ এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগুলোর জন্য নির্ভরযোগ্য সমর্থনের জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে।
বাংলাদেশের মূল প্রত্যাশা
বাংলাদেশ ন্যায়বিচার, টিকে থাকা এবং সমতাপূর্ণ জলবায়ু পদক্ষেপের ওপর ভিত্তি করে একটি সুস্পষ্ট এবং নীতিগত অ্যাজেন্ডা নিয়ে কপ-৩০-এ উপস্থিত হয়েছিল। জলবায়ু অর্থায়ন (Climate Finance) : বাংলাদেশ একটি নতুন, উচ্চাকাক্সক্ষী অর্থায়ন লক্ষ্যের আহŸান জানিয়েছে যা হবে অনুমানযোগ্য, প্রয়োজনভিত্তিক এবং যার মধ্যে অভিযোজন (Adaptation), স্থিতিস্থাপকতা (Resilience) এবং ক্ষয়ক্ষতি (Loss and Damage) অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদার জন্য পুরনো ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি অপর্যাপ্ত।
বৈশ্বিক প্রশমন (Global Mitigation) : বাংলাদেশ গ্রিন হাউজ গ্যাসের প্রধান নিঃসরণকারী দেশগুলোর প্রতি গ্যাস নিঃসরণ কমাতে কার্যকর ও নির্দিষ্ট সময় মেনে তা বাস্তবায়ন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে পর্যায়ক্রমিক ও ন্যায্য রূপান্তরের জন্য বিশ্বাসযোগ্য পথ অনুসরণের জোরালো অনুরোধ জানিয়েছে। সিদ্ধান্তমূলক প্রশমন ছাড়া, অভিযোজনের খরচ বহুলাংশে বেড়ে যাবে।
ক্ষতি ও ক্ষয়ক্ষতি তহবিল (Loss and Damage Fund) : বাংলাদেশ তাৎক্ষণিক মূলধন সরবরাহ, ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য সহজলভ্যতা এবং ন্যায্যতা ও জরুরি প্রয়োজনীয়তা প্রতিফলিত করে এমন পরিচালনা কাঠামোর ওপর জোর দিয়েছে।
অভিযোজন-সংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্য (Global Goal on Adaptation-GGA) : একটি বদ্বীপের দেশ হিসেবে, বাংলাদেশ জাতীয় অভিযোজন কৌশলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিমাপযোগ্য লক্ষ্যমাত্রা, সময়সীমা ও অর্থায়নের আহ্বান জানিয়েছে। জীবন, জীবিকা এবং বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষার জন্য অভিযোজন অপরিহার্য।
ন্যায্য রূপান্তর প্রক্রিয়া (Just Transition Mechanism) : বাংলাদেশ এই মর্মে দাবি করেছে, নিম্ন-কার্বন অর্থনীতির দিকে বৈশ্বিক পরিবর্তন যেন ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও উন্নয়ন-উপযোগী থাকে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর শ্রমিক, স¤প্রদায় এবং খাতগুলোকে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের জন্য কপ-৩০-এর উল্লেখযোগ্য অর্জন
চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান থাকা সত্তে¡ও কপ-৩০ বাংলাদেশের জন্য নিম্নলিখিত উল্লেখযোগ্য ফলাফল এনে দিয়েছে :
উন্নত অভিযোজন কাঠামো জোরদার করা এখন অভিযোজন চাহিদা মূল্যায়নের জন্য আরো স্পষ্ট মাপকাঠি প্রদান করে, যা জলবায়ু-সহনশীল কৃষি, উপকূলীয় সুরক্ষা, প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্র্রাসের জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম করবে।
ক্ষতি ও ক্ষয়ক্ষতিতে অগ্রগতি : নতুন প্রতিশ্রুতি, তহবিল সরবরাহের প্রসারিত পথ এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক সমর্থন জলবায়ুজনিত ক্ষতি, জীবিকা ব্যাহত হওয়া এবং বাস্তুচ্যুতির জন্য সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর স্বীকৃতি : কপ-৩০ নিচু উপকূলীয় বদ্বীপ এবং জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর বিশেষ বিপদের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে, যা আলোচনা এবং অর্থায়ন কাঠামোতে বাংলাদেশের দরকষাকষির ক্ষমতা জোরদার করেছে।
ন্যায্য রূপান্তর প্রক্রিয়া : কপ-৩০ ফলাফলে এর অন্তর্ভুক্তি একটি কূটনৈতিক অর্জন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা নিশ্চিত করে যে নি¤œ-নির্গমন রূপান্তরে ন্যায্যতা এবং সমতা কেন্দ্রীয়ভাবে থাকবে এবং নবায়নযোগ্য শক্তি, প্রযুক্তি হস্তান্তর, সবুজ কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণের সুযোগ উন্মুক্ত করবে।
আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থার জন্য সহায়তা : অংশীদাররা মাল্টি-হ্যাজার্ড আগাম সতর্কীকরণে বাংলাদেশের অগ্রণী ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং শেষ-পর্যায়ের বিতরণ (last-mile delivery), ডিজিটাল পূর্বাভাস এবং জলবায়ু-স্মার্ট ঝুঁকি-বিষয়ক যোগাযোগ শক্তিশালী করার অঙ্গীকার করেছে।
সামনের প্রধান চ্যালেঞ্জ
অর্থায়ন লক্ষ্যের উচ্চাকাক্সক্ষা ও স্পষ্টতার অভাব : বড় আকারের, অনুমানযোগ্য অর্থায়ন ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে অভিযোজনের ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক চাপ বাড়তেই থাকবে।
জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধের দুর্বলতা : ফলাফলের ভাষ্যগুলোতে শক্তিশালী সময়সীমা এবং জবাবদিহির অভাব ছিল, যা দেশগুলোকে ক্রমবর্ধমান নিঃসরণের ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে।
জলবায়ু-তাড়িত বাস্তুচ্যুতি : লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি, জমি এবং জীবিকা হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে, অথচ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং কাঠামোগত সহায়তা এখনো অপর্যাপ্ত।
জটিল অর্থায়ন প্রক্রিয়া : ধীর এবং আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সময়োপযোগী জলবায়ু পদক্ষেপে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে; সহজলভ্য, দেশ-পরিচালিত প্রবেশাধিকার অপরিহার্য।
সামনের পথ
বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো কৌশলগত ধারাবাহিকতা, অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি ও বৈশ্বিক অংশগ্রহণের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে-
কূটনৈতিক নেতৃত্ব : আন্তর্জাতিক জলবায়ু কূটনীতিতে বাংলাদেশের কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করা, যাতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি বৈশ্বিক সিদ্ধান্তগুলোকে পরিচালিত করে।
অভিযোজন ত্বরান্বিত করা : উন্নত এএঅ কাঠামোর সাথে সঙ্গতি রেখে জলবায়ু-সহনশীল কৃষি, উপকূলীয় বাঁধ, ম্যানগ্রোভ পুনরুদ্ধার, উন্নত জল ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো স¤প্রসারণ করা।
অর্থের দক্ষ ব্যবহার : আন্তর্জাতিক সম্পদ দক্ষতার সাথে ব্যবহার করার জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়, ডাটা সিস্টেম এবং জাতীয় প্রক্রিয়াগুলো শক্তিশালী করা।
ন্যায্য রূপান্তর প্রক্রিয়ার সুবিধা নেয়া : সম্প্রদায় এবং শ্রমিকদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রযুক্তিগত অংশীদারিত্ব, নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিনিয়োগ ও সবুজ দক্ষতা উন্নয়ন অনুসরণ করা।
জলবায়ু বাস্তুচ্যুতি নিয়ে জোরালো দাবি : অভিবাসন, ভূমি ক্ষয় এবং সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলোকে আন্তর্জাতিক জলবায়ু অ্যাজেন্ডার কেন্দ্রে রাখা, সময়োপযোগী ও কার্যকর সহায়তা নিশ্চিত করা।
কপ-৩০ স্থিতিস্থাপকতা, জলবায়ু ন্যায্যতা ও টেকসই উন্নয়নের প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকারকে পুনর্ব্যক্ত করেছে। নীতিগত সমর্থনকে ব্যবহারিক কৌশলে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেয়া অব্যাহত রেখেছে। সামনে, টেকসই কূটনীতি, শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা এবং কৌশলগত আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্প্রদায়গুলোকে রক্ষা করতে, টেকসই উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে এবং সবার জন্য জলবায়ু-সহনশীল, নিম্ন-কার্বন ও ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যতে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক : অতিরিক্ত সচিব