কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার নামে ট্যাক্স-ভ্যাট হার বাড়ানো

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ । সূত্র : বণিক বার্তা, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার নামে ট্যাক্স-ভ্যাট হার বাড়ানো

কেন এ অকাল কুষ্মাণ্ডের আবির্ভাব? প্রধান উপলক্ষ আইএমএফের রাজস্ব আয় বাড়ানোর তাগিদ, কর-জিডিপির রেশিও বাড়ানোর উপায় হিসেবে।

অতি সম্প্রতি প্রায় একশ পণ্য ও সেবা খাতে ট্যাক্স-ভ্যাটের হার বড় মাত্রায় বাড়ানো নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠছে। সমালোচনা ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রথম কারণ হলো বিগত প্রায় তিন বছর বাংলাদেশে উচ্চ দ্রব্যমূল্যের প্রভাবে জনঅর্থনীতিতে জীবন ও জীবিকা বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আছে। ঠিক এ সময় এবং এমনতর পরিস্থিতিতে এতগুলো পণ্য ও সেবায় ভ্যাট-ট্যাক্সের (যা পরোক্ষ কর, যার বোঝা অতি ধনবান ও নিম্নবিত্ত সবাইকে বহন করতে হয়) হার বড় আকারে ও পরিমাণে বাড়ানোর বিষয়ে আরো পর্যালোচনা প্রয়োজন ছিল।

 

 

সমালোচনার দ্বিতীয় কারণ, অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে সংসদের অবর্তমানে ট্যাক্স-ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে অধ্যাদেশ জারি করে। ভ্যাট-ট্যাক্সের হার বৃদ্ধির মোক্ষম মৌসুম হচ্ছে জুনে বাজেট অধিবেশনে ‘অর্থ আইন’ আকারে উপস্থাপন করে পাস করা। কর বৃদ্ধির প্রস্তাব জনপ্রতিনিধিদের সংসদে আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ থাকে, তারা আলোচনা-সমালোচনার সময় না পেলেও মিডিয়ার মাধ্যমে গণপ্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায়। ক্রমেই সবাই ঠাওর করতে পারে নতুন অর্থবছরে কোন কোন খাতে বাড়তি ভ্যাট-ট্যাক্স আসছে। এবার সে আশায় গুড়ে বালি।

 

 

এনবিআর স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং আগাম কোনো ব্যাখ্যা বিবৃতি ব্যতিরেকে ‘কর ক্যু’ করে ফেলায় সবাই বিস্মিত হয়েছে, খাতভিত্তিক স্টেকহোল্ডার তো বটেই, ভোক্তা সাধারণের পক্ষে মিছিল হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর তরফ থেকে বর্ধিত ট্যাক্স-ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। তৃতীয় কারণ, হঠাৎ করে করহার বৃদ্ধির ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ পরিস্থিতি আচমকা ধাক্কা খেয়েছে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ট্যাক্স-ভ্যাটের হঠাৎ বৃদ্ধিতে থমকে দাঁড়িয়েছে তো বটেই, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্যে স্থবিরতার আভাস মিলছে।

 


কেন এ অকাল কুষ্মাণ্ডের আবির্ভাব? প্রধান উপলক্ষ আইএমএফের রাজস্ব আয় বাড়ানোর তাগিদ, কর-জিডিপির রেশিও বাড়ানোর উপায় হিসেবে। অর্থনীতি বর্ধিত এ করের ভার সইতে পারবে কি না অর্থাৎ তার সক্ষমতা বেড়েছে কিনা এবং এ বাড়তি কর আহরণের সক্ষমতা, দক্ষতা ও কৌশল বাস্তবায়নের ধোপে এনবিআরের আগাম প্রাক্কলন অর্জিত হবে কিনা বাস্তবতার আলোকে তা বলা মুশকিল। এত বড় একটা ঝুঁকি নেয়ার আগে যেটি ছিল পরীক্ষা পর্যালোচনার অবকাশ। আইএমএফ বলুক আর না বলুক কর-রাজস্ব অনুপাত বাড়ানোর অনিবার্যতা বহুদিনের দাবি। সুতরাং এ পদক্ষেপের অন্যতম অনুঘটক কর-জিডিপি রেশিও বৃদ্ধির উপায় উপলক্ষের তীর সেদিকে ধাবিত হওয়া দরকার।

 

 


নতুন করে বলার দরকার নেই যে বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত সমপর্যায়ের অনেক দেশের তুলনায় বেশ কম। এটি কম কেন তা নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে না বলে সরলীকরণে বলা যায়, তিন কারণে কর-জিডিপি বাড়ানো যাচ্ছে না: এক. করের আওতার সীমাবদ্ধতা, পরিধিগত ঘাটতি। সব যোগ্য করদাতা ও খাতকে করজালের মধ্যে আনতে পারার দীর্ঘসূত্রতা বা ক্ষেত্রবিশেষে অপারগতা, অক্ষমতা; দুই. ব্যাপক কর ছাড়, কর রেয়াত, কর ফাঁকি, মামলায় আটকানো, সরকারি সংস্থার কাছে ব্যাপক বকেয়া পাওনা, কর কর্তন কিংবা আদায়কৃত কর রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা না হওয়া এবং তিন. রাজস্ব বিভাগের সাংগঠনিক দুর্বলতা, দক্ষ লোকবলের অভাব, অদক্ষতা-অপারগতা, দুর্নীতিজাত ইনফরমাল রেভিনিউ বা রেন্ট সিকিং, সমন্বয় ও মনিটরিংয়ের দুর্বলতা, কর আইন ও আহরণ ও প্রদান পদ্ধতির জটিলতা, মনোভঙ্গি পরিবর্তনের আবশ্যকতা।

 

 

 

করের আওতা সীমিত, জুরিসডিকশন আসলে বাঞ্ছনীয়ভাবে বাড়ছে না। অর্থাৎ সক্ষম সব করদাতা এবং প্রযোজ্য সব খাত করজালের আওতায় আসেনি। ফলে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়েনি। যেকোনো দেশে জিডিপির অন্তত ১৫-১৬ শতাংশ কর হিসেবে আহরিত হয়। কিন্তু আমাদের কর-জিডিপির অনুপাত ৭-৮ শতাংশের মধ্যে দীর্ঘদিন ঘোরাফেরা করছে। এর মানে এখনো জিডিপির হিস্যা অনুযায়ী অর্জিতব্য কর অনাহরিত থেকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ৫-৬ শতাংশের একটা ঘাটতি রয়েই যাচ্ছে। জিডিপিতে কৃষির অবদান এখনো বেশি। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী ছিল।

 

 

এ প্রবৃদ্ধিতে সার্বিকভাবে কৃষির অবদানই বেশি। গত আট-দশ বছরে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হোক, বন্যা হোক বা ব্যাপক ফসলহানি হোক এ রকম ঘটনা তেমন ঘটেনি। সিডর বা আইলার পরে আর বড় ধরনের অঘটন ঘটেনি। ফলে জিডিপিতে কৃষি অব্যাহতভাবে ঊর্ধ্বমুখী অবদান রেখে যাচ্ছে। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো কৃষি খাতের অধিকাংশ আয় কর আওতার বাইরে। কৃষির পরে জিডিপিতে অবদান শিল্পের। শিল্প থেকে কর আসছে বা আসবে, তা আহরণের আওতায় আনার প্রয়াস ও পদ্ধতি প্রলম্বিত। জিডিপিতে বড় অবদান সত্ত্বেও কৃষি খাত করের বাইরে থাকায় কর-জিডিপি অনুপাত হারাহারিমতে বাড়ছে না।

 

 

কৃষিকে সম্প্রসারণের নামে কৃষির উপায় উপকরণজাত অনেক আয়বর্ধক কর্মকাণ্ড বা শিল্প করের বাইরে রয়ে গেছে। গ্রামের কৃষককে তিন-চার লাখ পর্যন্ত করমুক্ত করা হয়েছে, সেটি ঠিক আছে। কিন্তু কৃষকের কৃষি খাতের কিছু কিছু সাবসেক্টরে ব্যাপক আয় আছে, যেমন মৎস্য চাষ, সার উৎপাদন, সেচ প্রভৃতি। যেগুলো কৃষি খাতের, কিন্তু অর্থকরী শিল্প, বিরাট অংক, বিরাট অর্থনীতি। ঘোরানো প্যাঁচানো ব্যাখ্যার বদৌলতে কোনো কোনো কর্মকাণ্ড করের বাইরে রেখে, ক্ষেত্রবিশেষে কর রেয়াত দিয়ে, সাবসিডি দিয়ে সুরক্ষার নামে কর রাজস্ব আয়কে সীমিত করা হচ্ছে।

 

 

কৃষিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে যেসব শিল্প গড়ে উঠছে, সেগুলোও কৃষির নাম করে বরং করের আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। মৎস্য চাষ, পানি সেচের যন্ত্র থেকে শুরু করে অনেক কিছুকে বলা হয় কৃষি খাতের আওতাভুক্ত। কর জালের আওতায় আনার ক্ষেত্রে কৃষি খাতে যেসব ছাড় বা সীমাবদ্ধতা আছে, সেটি ঠিক করে আনতে পারলে যারা কর দেয়া এড়িয়ে যায় কিংবা ফাঁকি দিচ্ছে সেটি ঠিক করা যাবে।

 

 

আওতার ব্যাপারে আরেকটি কথা হলো আমাদের অর্থনীতি হঠাৎ করে বড় হচ্ছে। এটি ধারাবাহিকভাবে গ্রো করেনি। নব্বই দশক থেকে হঠাৎ বড় হচ্ছে অর্থনীতি। আর বড় হচ্ছে যেসব খাত তা হলো তৈরি পোশাক, আবাসন, নির্মাণ শিল্প, সেবা, বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ, আর্থিক খাত, টেলিকম, ওষুধ প্রভৃতি। আরো কিছু খাত উঠতি। এসব খাতে অনেক মুনাফা হচ্ছে, মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। অথচ এদের অনেকে করের আওতায় ভালো করে আসছে না। কর অবকাশের তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে, শিল্প উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় আসতে কর অবকাশের সুযোগ ব্যবহার ইতিবাচক প্রবণতায় আসতে বিলম্ব হচ্ছে।

 

 

রফতানিমুখী শিল্পের নাম করে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা এখনো নানান ধাঁচের কর রেয়াত সুবিধা নিচ্ছেন এবং যথেষ্ট কম কর দিচ্ছেন। শুল্ক ও কর রেয়াতের মাধ্যমে উল্টো প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। রিহ্যাবের কাছ থেকে বাড়ি বিক্রি বাবদ তেমন করই সরকার পায় না। তারা কত লাভ করছে, সেটিও স্পষ্ট হচ্ছে না। শহরের বাড়িগুলো জরিপ করার উদ্যোগ বারবার নেয়া হয়। প্রত্যেক বাড়িওয়ালাকে করের আওতায় আনার কাজ শেষ হয়েও হইলো না শেষ। যেখানে যেখানে অর্থনীতি দৃশ্যমান হচ্ছে বা বড় হচ্ছে সেগুলো আসলে করের আওতায় আনার ব্যাপারে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার দুর্বলতা বা অপারগতার সুযোগে রাজস্ব আয় অর্জিত হচ্ছে না।

 

 

আওতার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিকে একটি বিষয়ে অবশ্য অনেক উন্নতি হয়েছে, চাকরিজীবীদের সবাই করের আওতায় এসেছেন। আগে অনেকেই কর দিতেন না। দিতে চাইলেও তাগিদে ঘাটতি বা কমতি ছিল। এখন সরকারি-বেসরকারি সবাইকে কর দিতে বলা হচ্ছে। না দিলে অফিস থেকে বেতন না দেয়ার কথাও বলা হচ্ছে। কর মেলায় দেখা যাচ্ছে অনেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সহজে কর দিতে ভিড় জমাচ্ছেন। কর সংস্কৃতিতে এটি একটি ইতিবাচক এবং আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি। কখনো সখনো দেখা যাচ্ছে, অফিসে কর্মীর কাছ থেকে কর কাটা হচ্ছে ঠিকই, সেই অর্থ সরকারি খাতে নিয়মিত যথাযথভাবে দেয়া হচ্ছে কিনা সেটি নিশ্চিত হচ্ছে না।

 

 

অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে, উৎসে কর যারা কেটে নিয়েছে তারা ঠিকমতো কোষাগারে তা জমা দিচ্ছেন না, দিলেও বেশ বিলম্ব করছেন। অর্থাৎ এখানেও উৎসে কর কর্তনকারীর দায়িত্ববোধের ও কর বিভাগের তরফে মনিটরিংয়ের একটা দুর্বলতা রয়ে গেছে। দৃশ্যত নির্বাচনের প্রার্থীদের সম্পদের পাহাড় ঘোষিত হলেও আয়করের নথিতে তা না মেলানোর, দুর্নীতিজাত অর্থের ওপর কর আদায় না করে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় না আনতে প্রণোদনা (কালো টাকা সাদা করার জন্য) দেয়া হচ্ছে।

 

 

আওতার আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো যাদের আয় বেশি এমন বড় বড় প্রফেশনের লোকজন ‘ন্যায্য দেয়’ করের আওতায় নেই। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, উকিল, চাঁদাখোর ও উচ্ছিষ্টভোগেী রাজনীতিক, আমলাসহ পেশাজীবী গোষ্ঠীর এখনো অনেকেই কর দেন না, আবার যারা বা দেন, সঠিক বা ন্যায্য পরিমাণে দেন না। এখানে করদাতা এবং কর আহরণকারী উভয় পক্ষের দায়দায়িত্ব যথাযথভাবে পরিপালিত হচ্ছে না।

 

 

একই কথা প্রযোজ্য ভ্যাটের ক্ষেত্রেও। পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতা সবাই ভ্যাট দিচ্ছে। সার্ভিস নেয়ার সময় ভ্যাট দিচ্ছে। উৎসে যারা ভ্যাট নিচ্ছে তারা তা রাষ্ট্রকে দিচ্ছে না। জনগণ কর বা ভ্যাট দিচ্ছে, অথচ সেই অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাচ্ছে না। ভ্যাটের আওতা বাড়ানো এবং সরকারি কোষাগারে জমা নেয়া নিশ্চিত করার জন্য ২০১২ সালে জারি হওয়া ভ্যাট আইনটি এখনো প্রবর্তন বা প্রয়োগ কৌশল সুনির্দিষ্ট হয়নি। সাম্প্রতিক বাড়তি ট্যাক্স-ভ্যাট আরোপ সেই নিরিখে করতে চাওয়া হয়েছে। কিন্ত উদ্দেশ্য বিধেয়র মধ্যে রয়ে গেছে বিস্তর ফারাক। ভ্যাট পণ্য বা সেবা গ্রহণকারীর কাছ থেকে কাটা করের টাকা রাষ্ট্র পাচ্ছে না।

 

 

এক্ষেত্রে কর ব্যবস্থাপনাকে জবাবদিহিমূলক করা যাচ্ছে না। আওতাসংক্রান্ত ওপরে উল্লিখিত জটিলতা বা সীমাবদ্ধতার কাদায় কর আয়ের বিপুল সম্ভাবনা আটকে যাচ্ছে, দুর্নীতি, অদক্ষতা অপারগতার অবয়বে লাপাত্তা হচ্ছে। জবাবদিহিবিহীন অবয়ব অবকাঠামোকে স্বশাসিত, স্বয়ংক্রিয় ও স্বপ্রণোদিত করা না গেলে কর-জিডিপি অনুপাত তথা রাজস্ব আয় বাড়ানো সুদূরপরাহতই রয়ে যাবে।

 

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান