ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ
জিয়া আহমদ [সূত্র : যুগান্তর, ২৮ মে ২০২৫]

২০২৫-এর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের মানুষ আশাবাদী হয়েছিল যে স্বৈরাচারের রাহুমুক্ত হওয়ার পর সব দলমতের মানুষ মিলে আমাদের বাংলাদেশটাকে গড়ে তুলবে। ১৯৭১, ১৯৯০ ও ২০২৪-এর প্রত্যাশা ও স্বপ্ন অনুযায়ী নতুন দেশ দেখতে পাব আমরা। সোয়া দুইশ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে পিছিয়ে পড়া এই দেশকে উন্নত একটি দেশ হিসাবে গড়ে তোলা এবং এর জনগণের জীবন-জীবিকার মানের উন্নতি করা এ অঞ্চলের গণমানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা।
কিন্তু বারবার সে আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ হয়েছে কিছু সুযোগসন্ধানী ও লোভী মানুষের কারণে। এদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য হলো তারা যাদেরই বিশ্বাস করে ক্ষমতায় এনেছে, তারা বারবার সেই জনগণেরই বিশ্বাসভঙ্গ করে নিজেদের আখের গুছিয়েছে। এর সর্বশেষ ও জ্বলন্ত উদাহরণ হলো পলাতক স্বৈরাচার শেখ হাসিনা।
গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার দুঃশাসনের অবসান ও তার পালিয়ে যাওয়ার পর এদেশের মানুষ আস্থা রেখেছিল গণ-অভ্যুত্থানের সামনের কাতারের যোদ্ধাদের ওপর। সারা দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পেছনে, যখন তিনি হাসিনা-উত্তর বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করলেন।
কিন্তু সমস্যা ও সংকট শুরু হয়েছিল ঠিক তখনই, যখন উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হলেন কিছু বিতর্কিত চরিত্র। সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া এবং কোনো কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়াই ছাত্র-সমন্বয়করা যখন বিশাল দায়িত্ব নিলেন, তখন সেই ভার বহনের ক্ষমতা তাদের ছিল, এমনটি তাদের পরবর্তী কাজকর্মে মনে হয়নি। বস্তুত কারও অর্থ ও প্রতিপত্তির মোহ সর্বনাশ ডেকে আনল। আর দেশের অভিজ্ঞ ও স্বৈরাচারের সহযোগী আমলারা তাদের নানা কৌশলে ভুল ও অসৎপথে চালিত করলেন। এতে ওই আমলাদের চাকরি ও পদ যেমন রক্ষা পেল, তেমনই তারা এ তরুণদের জাতির প্রত্যাশার বিপরীত মেরুতেও নিয়ে ফেললেন। সে কারণে এখনো স্বৈরাচারী হাসিনার নিয়োগ করা ৪৪ জন সচিবসহ অন্য বড় পদের কর্মকর্তারা আয়েশের সঙ্গে চাকরিতে থাকলেও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।
কোনো কিছুই যে বয়স ও অভিজ্ঞতার বিকল্প হতে পারে না, তা বোঝা গেল এই তরুণ ছাত্রনেতাদের কারও কারও পদস্খলনে। এ তরুণরা আমাদের পূর্ববর্তী আওয়ামী নেতৃত্বের মতোই একই ভুল করলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ যেমন মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্ব নিজেদের বলে দাবি করে অন্যসব মুক্তিকামী দলকে ‘আউটসাইডার’ বানিয়ে ফেলেছিল, তেমনই ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের এ নায়কের অন্যসব রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে কোনো কৃতিত্ব ভাগ করতে রাজি হয়নি। তারা দাবি করা শুরু করলেন যে এই গণ-অভ্যুত্থান মাত্র ৩৬ দিনের আন্দোলনে সফল হয়েছে এবং তার ফলে শেখ হাসিনার মতো স্বৈরাচার ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি কোটায় নিযুক্ত একজন উপদেষ্টা পর্যন্ত বলে বসলেন যে, ‘গত ৫৪ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো কিছু করতে পারেনি বলেই তাদের ক্ষমতায় আসতে হয়েছে’! কতটা ‘রাজনৈতিকভাবে অজ্ঞ’, অনভিজ্ঞ ও আত্মম্ভর হলে একজন মানুষ এমন কথা বলতে পারেন! গত ৫৪ বছরে দেশে তিনবার স্বৈরাচারী শাসকরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। কিন্তু তিনবারই রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তারা পরাজিত হয়েছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো ২০২৪। এই আন্দোলনের সুবাদেই অনেকের মুখে আজ ‘বড় বড় কথা’ ফুটছে, যারা ওই আন্দোলনকালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে কফি খেয়েছেন আর টিভি দেখেছেন।
এসব বালখিল্য কথার জবাব দেওয়ার আসলে কিছু নেই। তবে তাদের মনে করিয়ে দেওয়া যায়, ডিবি হারুনের আতিথেয়তার পর যখন আন্দোলন অব্যাহত থাকবে কি না, সে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছিল, তখন দেশের গণতন্ত্রকামী সব রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রাস্তায় নেমে আসার কারণে আন্দোলন থামেনি। বরং আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়ে ছেড়েছে। একটি পাথরকে হাত দিয়ে ভেঙে ফেলা সম্ভব না। কিন্তু সেই পাথরের ওপর যদি বছরের পর বছর পানির ফোঁটা পড়ে, তাহলে পাথরটি ছিদ্র হয়ে যায়। বস্তুত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো গত পনোরো বছর ধরে সেই কষ্টসাধ্য কাজটি অধ্যবসায়ের সঙ্গে করে গেছে। আর জুলাই, ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান সেই পরিশ্রমের ফসলের ওপর দাঁড়িয়ে।
বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে আফসোসের জায়গাটা হলো তাদের সবার প্রিয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার শপথের মর্যাদা রক্ষায় দৃঢ় থাকতে পারছেন না। তার কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল তিনি দেশের অভিভাবক হিসাবে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে একই দৃষ্টিতে দেখবেন। তার লক্ষ্য থাকবে দেশের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় সংস্কারটুকু করে (বিশেষত নির্বাচনব্যবস্থা ও প্রশাসনের সংস্কার) অতি দ্রুত দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে তার ওপর অর্পিত বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন এবং সারা দেশের মানুষ তাকে চিরকাল সম্মান করবে এ কারণে। কিন্তু তিনি যে তার দীর্ঘদিনের কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত সম্মানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবেন, তা অভাবনীয় ছিল।
উপদেষ্টা পরিষদ কোনো ‘পবিত্র সংঘ’ না যে এর সদস্যদের পরিবর্তন করা যাবে না, বিশেষত ড. ইউনূস যখন ভালো করেই জানেন যে, তার উপদেষ্টাদের অনেকে অতি বৃদ্ধ ও অনেকেই অসাধু। তার একজন উপদেষ্টা কর্মরত অবস্থাতেই মারা গেছেন। তারপরও ড. ইউনূস অতি বৃদ্ধদেরও অবসরে যেতে দেননি। তাছাড়া পরবর্তীকালে তিনি একাধিক সময়ে যে উপদেষ্টাদের নিয়োগ দিয়েছেন, তাদের অনেকেই বিতর্কিত। উপদেষ্টা ফারুকীকে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করে ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির’ মহাপরিচালক পদত্যাগ করেন। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো তদন্তের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে জনপ্রশাসন সচিবের বিরুদ্ধে বদলি বাণিজ্যের অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সে কমিটি ৭ মাসেও তদন্ত রিপোর্ট দেয়নি। অথচ এ তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন তিনজন উপদেষ্টা। এ বিষয়গুলো সবই ড. ইউনূসের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির বিপক্ষে গিয়েছে।
বর্তমানে দেশকে ঘিরে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র চলছে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো আমাদের সার্বভৌমত্বকে নস্যাৎ করা। এ ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে বিশাল মাপের ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই মাপের মানুষ। তার পদত্যাগের কোনো সুযোগ নেই। তিনি যখন এই অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিলেন, তখন তিনি দেশকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সঠিক ‘ট্র্যাকে’ তুলে আনার দায়িত্বও নিয়েছেন। এখন মাঝপথে তার সে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়াটা অনৈতিক হবে এবং দেশপ্রেমিক ও বিচক্ষণ একজন মানুষ হিসাবে তিনি তা করতে পারেন না।
তাকে অবিলম্বে দেশের সব বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে তার নিরপেক্ষতার বিষয়ে তাদের আশ্বস্ত করতে হবে। অনতিবিলম্বে সামনের ‘নির্বাচনের রোডম্যাপ’ ঘোষণা বিষয়টিকে আরও এগিয়ে আনতে হবে। এবং কালবিলম্ব না করে সব অদক্ষ ও বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বিদায় জানিয়ে নতুনভাবে যোগ্য, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক মানুষদের নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন করতে হবে। এ কাজগুলো করলে দেশ স্থিতিশীল হবে এবং দেশের মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। বিপরীত যে কোনোকিছু পতিত স্বৈরাচার ও তার প্রভুদের নীলনকশা বাস্তবায়নে সহায়ক হবে, যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়।
জিয়া আহমদ, এনডিসি : সাবেক সরকারি কর্মচারী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক