ক্রিপ্টো কারেন্সির বৈধতা মুদ্রায় না সম্পদে
নিরঞ্জন রায় । সূত্র : সময়ের আলো, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫

ক্রিপ্টো কারেন্সি আজ বিশ্বে বেশ পরিচিত এবং আলেচিত আর্থিক বিনিয়োগ মাধ্যম। ক্রিপ্টো কারেন্সি সংক্ষেপে ক্রিপ্টো নামেই বেশি পরিচিত। ক্রিপ্টো কারেন্সি মূলত এক ধরনের ভার্চুয়াল মুদ্রা, যাকে ডিজিটাল কারেন্সিও বলা হয়ে থাকে।
অনেকে অবশ্য একে ডিজিটাল ওয়ালেট বা ভার্চুয়াল মানিব্যাগ বলতেই বেশি পছন্দ করেন। কারণ কারেন্সি হবে তখনই, যখন সেটি দিয়ে সরাসরি লেনদেন বা কোনো কিছু ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। ক্রিপ্টো দিয়ে সরাসরি লেনদেন করার সুযোগ নেই। অনলাইনে অর্থ স্থানান্তর বা ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করা যায় জন্য। এসব লেনদেনের মাধ্যমকে প্লাস্টিক ওয়ালেট বলা হয়। একইভাবে ক্রিপ্টো একচেঞ্জে কিনে রাখা একটি সংখ্যা মাত্র, যা অনলাইন স্থানান্তরের মতো লেনদেন করা সম্ভব। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ক্রিপ্টোর অবস্থান হচ্ছে এটি একটি ভার্চুয়াল মুদ্রা বা ডিজিটাল কারেন্সি।
সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে ক্রিপ্টো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও এই ডিজিটাল কারেন্সি এখন পর্যন্ত আইনগত বৈধতা পায়নি। দুয়েকটি ছোট দেশ ব্যতীত বিশ্বের কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রিপ্টো কারেন্সিকে বৈধ মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বিশ্বের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক এই কারেন্সি লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে না। এমনকি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি ক্রিপ্টো কারেন্সি লেনদেনের সঙ্গে জড়িত থাকে তাদের ব্যাংক হিসাব খুলতে সমস্যা হয়।
কোনোরকমে ব্যাংক হিসাব খুললেও সেটি বিশেষ নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে যে ক্রিপ্টো কারেন্সির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু না হলেও এই মুদ্রা বিশ্বব্যাপী এক বিশাল বাজারে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টো কারেন্সির বাজার এখন প্রায় চার ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
কোনোরকম পূর্বানুমতি না নিয়েই অবৈধ মুদ্রা হিসেবে এই ক্রিপ্টো কারেন্সি এত বিশাল মার্কেটে পরিণত হওয়ার ফলে এই আর্থিক সম্পদের দায়দায়িত্ব কোনো একক কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। ক্রিপ্টো কারেন্সি লেনদেনে কোনোরকম অনিয়ম হলে তা দেখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। মাঝেমধ্যে আমেরিকার সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি), ফেডারেল ট্রেড কমিশন জোরপূর্বক কিছু নিয়মের মধ্যে ফেলে এই ভার্চুয়াল মুদ্রার লেনদেনের অনিয়ম তদন্ত করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করেও খুব একটা সফল হতে পারে না। কেননা নানারকম আইনগত জটিলতা দেখা দেয়। এতে করে যারা ক্রিপ্টো কারেন্সিতে বিনিয়োগ করেছে, তারা সবসময়ই এক ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
আমেরিকার আর্থিক ব্যবস্থা যেমন সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী, তেমনি সুনিয়ন্ত্রিত। আমেরিকার মতো সুশৃঙ্খল এবং সুনিয়ন্ত্রিত আর্থিক খাতে কোনোরকম বৈধতা ছাড়া কীভাবে এই ক্রিপ্টো কারেন্সি এত দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃপক্ষের সামনে লেনদেন হতে হতে আজ চার ট্রিলিয়ন ডলারের বাজারে পরিণত হয়েছে, সেটিই একটি বড় রহস্য। এই ক্রিপ্টো কারেন্সির বাজার বাড়তে বাড়তে এত বিশাল আকার ধারণ করেছে যে একে অবজ্ঞা করার আর কোনো অবকাশ নেই। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক আমেরিকাকে এই অবৈধ ভার্চুয়াল মুদ্রাকে হজম করতেই হবে। সুতরাং ক্রিপ্টো কারেন্সিকে বৈধতা দেওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ক্রিপ্টো কারেন্সিকে বৈধতা দিয়ে সহজভাবে নিয়ন্ত্রণের দাবি দীর্ঘদিনের হলেও বাইডেন প্রশাসন কাজটি করেনি। কেননা ডেমোক্র্যাটদের মাঝে ক্রিপ্টো সহায়ক নীতিনির্ধারকের বড় অভাব ছিল। উল্টো যে কংগ্রেসম্যানের ওপর এই ক্রিপ্টো দেখভালের দায়িত্ব ছিল, তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন অত্যন্ত ক্রিপ্টোবিরোধী। এর ফলে ক্রিপ্টো কারেন্সি বৈধতা পাওয়ার কাজটি একেবারেই এগোয়নি। অধিকন্তু বাইডেন প্রশাসনের পুরো সময় ধরে ক্রিপ্টো সবচেয়ে খারাপ সময় পার করেছে। গত নভেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্প এবং তার রিপাবলিক দল বিজয়ের মধ্য দিয়ে ক্রিপ্টো কারেন্সির দুর্দিন কেটে গেছে বলেই অনেকে মনে করেছেন।
রিপাবলিক দলের পক্ষে যেসব কংগ্রেসম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তাদের অধিকাংশ ক্রিপ্টো প্রেমিক। তারা নিজেরাই অনেক ক্রিপ্টো কারেন্সির মালিক। তা ছাড়া যারা ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জের মালিক বা ক্রিপ্টো কারেন্সি লেনদেনের বিশাল খেলোয়াড়, তারা রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যানদের বিজয়ী করতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। বিজয়ী হয়ে তাদের অনেকেই প্রকাশ্যে ক্রিপ্টোর পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন।
তা ছাড়া ট্রাম্প নিজে একজন ব্যবসায়ীবান্ধব ব্যক্তি এবং তিনিও ক্রিপ্টোর পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। এ কারণেই নভেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিটকয়েনের বাজারমূল্য ৮০ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়, যা বর্তমানে এক লাখ ডলারের ওপড়ে উঠে গেছে। উল্লেখ্য, বিটকয়েন কয়েকটি প্রচলিত ক্রিপ্টো কারেন্সির মধ্যে অন্যতম একটি। সবকিছু মিলিয়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ক্রিপ্টো কারেন্সি খুব সহসাই আমেরিকায় বৈধতা পেয়ে যাবে। কোনো একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে নিয়ন্ত্রিত হয়ে এর লেনদেন চলতে থাকবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ক্রিপ্টো কারেন্সিকে বৈধতা দিলেও কীভাবে দেওয়া হবে বা এর অবস্থানই কি হবে। অর্থাৎ ক্রিপ্টো কি একটি বৈধ মুদ্রা বা লিগ্যাল টেন্ডার হিসেবে স্বীকৃতি পাবে, নাকি শেয়ার বা বন্ডের মতো আর্থিক সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। এই বিষয়টি এখনও সেভাবে আলোচনায় আসেনি। সবাই এই ডিজিটাল কারেন্সির বৈধতা এবং একে কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে নিয়ে আসার বিষয়টি আলোচনা করছে। যখন বিষয়টি সামনে আসবে, তখন এক ধরনের জটিলতা দেখা দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
আমেরিকা যদি ক্রিপ্টোকে কারেন্সি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ফেডারেল রিজার্ভের ওপর ন্যস্ত করে, তা হলে সেটি তখন ডলারের মতো আমেরিকার আরও একটি বৈধ মুদ্রা বা লিগ্যাল টেন্ডার হিসেবে লেনদেন নিষ্পত্তিতে ব্যবহৃত হবে। আর এমনটা হলে ক্রিপ্টো কারেন্সি তখন ডলারের বিকল্প মুদ্রা হিসেবে চালু থাকবে। এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকান ডলার যে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছে, সেখানে কিছুটা ভাটা পড়বে।
দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে আমেরিকা একটি কাজ খুব সফলতার সঙ্গে করতে সক্ষম হয়েছে, তা হচ্ছে যে বিশ্বে আন্তর্জাতিক লেনদেন নিষ্পত্তিতে আমেরিকার ডলারের শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখা। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও যে পরিমাণ ডলারভিত্তিক লেনদেন হয়, সেটি বিবেচনায় নিলে খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রায় সত্তর থেকে আশি শতাংশ লেনদেন নিষ্পত্তি হয় ডলারে।
একসময় ডলারের পাশাপাশি আরও কিছু মুদ্রায় আন্তর্জাতিক লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পাউন্ড, স্টারলিং, ইউরো, জাপানি ইয়েন, ডয়েচ মার্ক। এসব মুদ্রা এখন আর সেভাবে ব্যবহার হয় না। ফলে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলার এখন ব্যাপক চাহিদার মুদ্রা, যাকে এককথায় হার্ড কারেন্সি বলা হয়। আমেরিকা তাদের মুদ্রা, ডলারকে হার্ড কারেন্সি করে রাখার সুবিধাও পেয়েছে যথেষ্ট।
আমেরিকা তাদের নীতি সুদহার হ্রাস-বৃদ্ধি করে ডলারকে হার্ড কারেন্সি হিসেবে ধরে রাখার মাধ্যমে ডলারনির্ভর দেশগুলোকে বেকায়দায় ফেলতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, অতি চাহিদার মুদ্রা থাকার কারণে আমেরিকার বেশ কয়েকটি আর্থিক মন্দা কাটাতে এই ডলার ভালো ভূমিকা রেখেছে। তাই ডলারের একক আধিপত্য খর্ব হতে পারে এমন কোনো সিদ্ধান্ত যে আমেরিকা নেবে না তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।
সেই বিবেচনায় ক্রিপ্টো কারেন্সিকে আর্থিক সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি এবং সেই কাজটা তুলনামূলক সহজই হবে। সে রকম হলে আমেরিকায় শেয়ার বা বন্ডের মতো এই ক্রিপ্টো কারেন্সি কোনো একটি এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত হয়ে ক্রয়-বিক্রয় হতে পারবে। আমেরিকায় গতানুগতিক ধারার বন্ড বা শেয়ার ছাড়াও অনেক ডেরিভেটিভ প্রোডাক্ট এবং হাইব্রিড প্রোডাক্ট চালু আছে। এর সঙ্গে তখন আরও একটি প্রোডাক্ট হিসেবে এই ক্রিপ্টো কারেন্সিও যোগ হবে। এমনকি ক্রিপ্টো কারেন্সি নিজেই একটি এক্সচেঞ্জ হিসেবে কাজ করে।
তাই এর যেকোনো একটিকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং সুনির্দিষ্ট আইন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে নিয়ে এসে খুব সহজেই স্বতন্ত্র ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এখানেও কিছু সমস্যা আছে তা হচ্ছে এই ক্রিপ্টো নিয়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সঙ্গে এক ধরনের জতিলতা তৈরি হয়েই আছে। ইতিমধ্যে এসইসি জোরপূর্বক কিছু নিয়মের মধ্যে ফেলে এই ভার্চুয়াল মুদ্রার লেনদেনের অনিয়ম, তদন্ত এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করেছে। এই নিয়ে ক্রিপ্টো মালিকদের সঙ্গে এসইসির বড় ধরনের একটা মতবিরোধ লেগেই আছে।
আমেরিকার এসইসি খুবই শক্তিশালী এবং কঠোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এদের নিয়ন্ত্রণের মানদণ্ড বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কঠোর। এতদিন নিয়ন্ত্রণবিহীন স্বাধীনভাবে চলতে অভ্যস্ত হওয়া ক্রিপ্টো মালিকরা কোনোভাবেই এসইসির মতো শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে যেতে চাইবে না। তবে যেহেতু সবাই এটির বৈধতা চায় এবং কোনো সংস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিতও হতে চায়, তাই এই সমস্যা হয়তো সে রকম জটিল হবে না।
ক্রিপ্টো কারেন্সি আইনগত বৈধতা পারে সেটি হয়তো মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু মুদ্রা হিসেবে নাকি শেয়ার বা বন্ডের মতো আর্থিক সম্পদ হিসেবে এই ক্রিপ্টো কারেন্সি বৈধতা পাবে, সেটি দেখার জন্য আমাদের আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে যেভাবেই হোক না কেন, ক্রিপ্টো কারেন্সি বৈধতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেনদেন বা বিনিয়োগের জন্য ভালো সুযোগও সৃষ্টি হবে। এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগে থেকে ভালো প্রস্তুতি নিয়ে রাখা প্রয়োজন।
অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং বিশেষজ্ঞ