কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

কর্মজীবী নারীর অবদান স্বীকৃতি পাচ্ছে না কেন?

সৈয়দ ফারুক হোসেন । সূত্র : সময়ের আলো, ০৮ মার্চ ২০২৫

কর্মজীবী নারীর অবদান স্বীকৃতি পাচ্ছে না কেন?
প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। নারী হলো সৃষ্টির প্রতীক। সৃষ্টির অস্তিত্ব নারী ছাড়া কল্পনায় আনা যায় না। এই দিনটি বিশেষ করে নারীদের কৃতিত্বকে সম্মান করে এবং লিঙ্গবৈষম্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায়। এ দিনে আমাদের সমাজে মহিলাদের কৃতিত্ব উদযাপন করার উপায়গুলো নিয়ে আমাদের সবার চিন্তা করা উচিত। মেয়েদের শিক্ষার প্রসার ঘটানো এবং সমাজের সব অংশ থেকে লিঙ্গ পক্ষপাত দূর করা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বে নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অর্জনকে সম্মান জানাতে এ দিনটি পালিত হয়। দিনটি লিঙ্গ সমতা, প্রজননের অধিকার, নারীদের ওপর হিংসা ও নির্যাতন, নারীর সমান অধিকার ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
 
 
 
এখনও সারা পৃথিবীতেই সমাজের বেশিরভাগ জায়গায় লিঙ্গবৈষম্য বর্তমান রয়েছে। ঘরে-বাইরে নানা বৈষম্যের শিকার নারীরা। দেশে নারী দিবস শত বছর পার করলেও এখনও শ্রমের স্বীকৃতি মেলেনি গ্রামীণ নারীদের। সংসারে তো বটেই, বাইরে পরিশ্রম করে নারী বলেই তাকে হতে হচ্ছে অবমূল্যায়িত। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও ন্যায্য মজুরিবঞ্চিত নারী কৃষি-শ্রমিকরা। নারী নির্যাতনের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। সমাজ-সংসার-কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গায়ই নারীকে কোনো না কোনোভাবে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। আর তার শতকরা ৮৬ ভাগের বাস গ্রামে। গবেষণায় দেখা যায়, গ্রামীণ নারীরা দিনের মোট সময়ের শতকরা ৫৩ ভাগ ব্যয় করে কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পক্ষেত্রে। যেখানে পুরুষরা ব্যয় করে শতকরা ৪৭ ভাগ সময়। নারীরা পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা সব কাজে আজ অবদান রেখে চলছে। তারপরও তাদের সমাজে পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে। দেশে প্রায় আড়াই কোটি কর্মজীবী নারীর মাঝে দেড় কোটিই গ্রামীণ নারী। পুরুষরা এখনও বহু ক্ষেত্রে বেশি মাত্রায় সুবিধা ভোগ করেন। আর সেই কারণেই এ দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প-সাহিত্যসহ সব ধরনের ক্ষেত্রে এবং সমাজের সব কাজে নারীদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতেই এ দিনটি পালিত হয়।
 
 
 
 
মানব সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে পুরুষ ও নারী উভয়ে। পুরুষ ও নারী এ দুয়ের সমন্বয়ে গঠিত হয় মানব সমাজ। তাই মানব জীবনে উভয়ের গুরুত্ব অনেক ব্যাপক। বাস্তবে সমাজ জীবনে একজন পুরুষ যেভাবে মূল্যায়িত হয় তেমনি একজন নারী নানাভাবে নানা কারণে হয় অবহেলিত ও নির্যাতনের শিকার। অর্থাৎ অবমূল্যায়ন করা হয় নারীকে পদে পদে। নারীর অবমূল্যায়নটা শুরু কিন্তু পরিবার থেকেই হয়। আর সেটা শৈশব থেকে হয়। এরপর বিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কিছু পুরুষ ব্যতীত প্রায় সব পুরুষ চায় না তাদের স্ত্রীরা পড়াশোনা করুক, চাকরি করুক। এদিকে বর্তমান এই আধুনিক প্রযুক্তির একটা নেতিবাচক দিক হলো সাইবার নিপীড়ন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নারীরা নানাভাবে হয়রানি হচ্ছে। যেমন প্রেমের সম্পর্কের ছবি-ভিডিও, ফেসবুকে ছেড়ে মেয়েটাকে ব্লাকমেইলের চেষ্টা করা হয়। এ ছাড়াও যৌতুক, উত্ত্যক্তকরণ, এসিড, সন্ত্রাস, বাল্যবিবাহ ও ধর্ষণের শিকার তো আছেই।
 
 
 
 পৃথিবীতে একমাত্র প্রাণী মনে হয় নারী, যাদের সঙ্গে এত রকমের অন্যায় করা হয়। সামাজিক সমস্যাগুলোর প্রায় বেশিরভাগই নারীদের। নারীর প্রতি সহিংসতার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। নারীদের আজও সমাজে অবহেলার চোখে দেখা হচ্ছে। বাল্যবিয়ে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেওয়া, পড়ালেখা বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনা তো প্রতিনিয়তই হয়ে আসছে। সমাজে এখনও তাদের উন্নতির কোনো চিন্তা না করে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চিন্তা করা হয়। এখনও শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন অকালে প্রাণ কেড়ে নেয় গৃহবধূর। আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে তেমন পার্থক্য না থাকলেও উচ্চশিক্ষার বেলায় মেয়ে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে রয়েছে। যার মূল কারণ হলো বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য, অভিভাবকের সদিচ্ছার অভাব এবং নিরাপত্তাহীনতা। এ লক্ষ্যে তাদের যে বিশেষ সুবিধাগুলো দরকার তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- শিক্ষার সমান সুযোগ, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং সমাজের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন। এদিকে যেহেতু সমাজে কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে, তবুও নারীদের অধিকার নিয়ে কিন্তু সেই পরিবর্তনটা স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে হয়নি।
 
 
 
 
 
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, একজন কর্মজীবী নারী একজন পুরুষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ কাজ করেন। কর্মজীবী নারী নিজের পরিবারে বা বাড়িতে যে কাজগুলো করেন তার কোনো আর্থিক মূল্যায়ন হয় না। ফলে নারীদের পারিবারিক কাজের গুরুত্ব যেন অদৃশ্যই থেকে যায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে নারীদের অবস্থান এখনও সেই প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থাতেই রয়ে গেছে। কর্মজীবী পুরুষদের থেকে নারীদের প্রায় দ্বিগুণ কাজ করতে হয়। কর্মজীবী পুরুষ অফিসে কাজ করে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সামলিয়ে ঘরে ফেরার পর ঘরের কাজে অংশগ্রহণ করেন খুবই কম। অন্যদিকে অফিস বা কারখানায় কাজ শেষ করে ঘরে ফেরার পরও নারীর ফুরসত নেই। পরিবারের রান্না করা থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক সব কাজও করতে হয় তাকেই। ফলে সৃষ্টিশীল কর্মজীবী নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা নিয়ে টিকে থাকা তাই পুরুষের চেয়ে অনেক অনেক গুণ কঠিন। এত কিছুর পরেও দেশের নারীরা অবহেলিত ও নির্যাতিত। এমন কোনো দিন নেই, এমন কোনো মাস নেই, এমন কোনো সপ্তাহ নেই যে নারীর ওপর নির্যাতন হয়নি। দেশের নারীদের ওপর নির্যাতন চলছে, ধর্ষণ চলছে। তার চেয়ে বড় দুঃখের ও কষ্টের বিষয় হচ্ছে, এই ধর্ষণের ব্যাপারে কোনো বিচারের প্রয়োগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
 
 
 
 
আগামী দিনের বাংলাদেশ যদি আমরা নারীদের ক্ষমতায় রাখতে চাই প্রথমে বাংলাদেশের নাগরিকদের ক্ষমতায়ন করতে হবে। দেশের নাগরিকরা যদি অধিকারহীন হয়ে যায়, ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, তা হলে নারীদের ক্ষমতায়নের সুযোগ থাকবে না, কারও ক্ষমতায়নের সুযোগ থাকবে না। যে সমাজে আমরা রুখে দাঁড়াতে পারব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারব, সবাই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব এবং নারীদের পক্ষে দাঁড়াতে পারব, সেই সমাজই আমাদের সবার কাম্য। মেয়েদের স্বাবলম্বী করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। তাই পুরুষদের উচিত নারীদের প্রতিযোগী না ভেবে সহযোগী ভাবা। তা হলে একসঙ্গে কাজ করে দেশ ও জাতিকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এভাবে আমরা সবাই মিলে দেশটাকে পালটে দেওয়ার চেষ্টা করলে একটি আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই মিছিলে চলে সরকার লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন।
 
 
 
১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। অতঃপর ১৯৭৫ সাল ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে পৃথিবীজুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি, নারীর সম-অধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অভীপ্সা নিয়ে। সারা বিশ্বের সব দেশে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
 
 
লেখক- সাবেক রেজিস্ট্রার, জেএসটিইউ