কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই ভবিষ্যতের অপরিহার্য দক্ষতা
ড. মতিউর রহমান [ সূত্র : Share Biz News , ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫]

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্রুত প্রসারের মুখে বৈশ্বিক শ্রমবাজার এক গভীর রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই রূপান্তরের কেন্দ্রে কী ধরনের দক্ষতা অপরিহার্য হবে, তা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (WEF) ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত শ্বেতপত্র ‘New Economy Skills: Unlocking the Human Advantage’। এই প্রতিবেদন একটি শক্তিশালী বিপরীত বর্ণনা উপস্থাপন করেছে—নতুন অর্থনীতিতে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা কেবল প্রযুক্তিগত দখলে নয়, বরং তা মূলত মানবিক সক্ষমতার (Human Capabilities) মধ্যে নিহিত।
ডিজিটাল ও শিল্প রূপান্তরের পথে চলা বাংলাদেশের জন্য এই অন্তর্দৃষ্টিটি কেবল শিক্ষামূলক নয়; এটি একটি জরুরি অর্থনৈতিক অপরিহার্য বিষয়, যা একটি উন্নত জাতি হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সহায়ক হবে। মূল থিসিসটি অত্যন্ত স্পষ্ট—সৃজনশীলতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও সমন্বিত সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, যেগুলো একসময় ‘সফট’ স্কিল বা নরম দক্ষতা হিসেবে অবহেলিত ছিল, সেগুলোই এখন কঠিন, টেকসই সম্পদ, যা স্বয়ংক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম এবং উদ্ভাবনা, অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
WEF-এর শ্বেতপত্র নতুন অর্থনীতির জন্য পাঁচটি মূল দক্ষতা ক্যাটাগরি চিহ্নিত করে, যা উদ্ভাবন, স্থিতিস্থাপকতা এবং বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। এই পাঁচটি ক্যাটাগরি হলো—১. মানবকেন্দ্রিক দক্ষতা (Human-centric skills), যা সহযোগিতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা (Emotional Intelligence)-এর মতো মানুষের অনন্য ক্ষমতাকে অন্তর্ভুক্ত করে; ২. এআই, ডেটা ও ডিজিটাল দক্ষতা (AI, data and digital skills); ৩. সবুজ ও স্থায়িত্বের দক্ষতা (‰reen and sustainability skills); ৪. ব্যবসা দক্ষতা (Business skills) এবং ৫. ট্রেড ও বৃত্তিমূলক দক্ষতা (Trade and vocational skills)। এই কাঠামো স্পষ্ট করে, ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্র কেবল কোডিং বা ডেটা অ্যানালাইসিস নির্ভরশীল হবে না; বরং এটি প্রযুক্তি, পরিবেশ ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের এক জটিল সমন্বয়। এই সমন্বয়মূলক দৃষ্টিভঙ্গিই বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিকে গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।
ফিউচার অফ জবস রিপোর্ট ২০২৫ অনুসারে, নিয়োগকর্তারা অনুমান করেছেন যে, ২০৩০ সালের মধ্যে শ্রমিকদের ৩৯ শতাংশ মূল দক্ষতা পরিবর্তিত হবে। এই পরিবর্তনের শীর্ষে থাকবে বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনা (Analytical Thinking), যা ৭০ শতাংশ নিয়োগকর্তা বর্তমানে অপরিহার্য মনে করেন। এর সঙ্গে সমান গুরুত্ব পেয়েছে স্থিতিস্থাপকতা, নমনীয়তা ও চটজলদি ভাব (Resilience, Flexibility and Agility), নেতৃত্ব ও সামাজিক প্রভাব (Leadership and Social Influence), সৃজনশীল চিন্তাভাবনা (Creative Thinking) এবং অনুপ্রেরণা ও আত্মসচেতনতা (Motivation and Self-awareness)। এই তালিকা প্রমাণ করে যে, মানবকেন্দ্রিক দক্ষতাগুলো, যা একসময় ‘সফট স্কিল’ হিসেবে গণ্য হতো, এখন শ্রমবাজারের সবচেয়ে ‘কঠিন’ এবং ‘টেকসই’ সম্পদ। এই উচ্চ-ক্রমের জ্ঞানীয় (High-order cognitive) এবং সামাজিক-সংবেদনশীল (Socio-emotional) দক্ষতাগুলোই এআইয়ের যুগে মানবিক বুদ্ধিমত্তাকে এক স্বতন্ত্র সুবিধা প্রদান করবে।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি একটি স্পষ্ট বৈপরীত্য প্রকাশ করে, যা বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর জন্য এক সতর্কবার্তা। নিয়োগকারীরা মানবকেন্দ্রিক দক্ষতাকে উচ্চ মূল্য দিলেও নিয়োগের অনুশীলনে এই একই দক্ষতাগুলো মূলত অদৃশ্য থেকে যায়। ‘এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে ২০২৫’ অনুসারে, মাত্র অর্ধেক নিয়োগকর্তাই তাদের কর্মীদের সহযোগিতায় দক্ষ মনে করেন এবং মানবকেন্দ্রিক দক্ষতা যেমন স্থিতিস্থাপকতা, নেতৃত্ব ও সহমর্মিতা ২০২২-২০২৫ সালে ৮ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ২০১৯-এর নিচে রয়ে গেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে এই দক্ষতাগুলো সহজাতভাবে ‘প্রদত্ত’ বলে মনে করা হয়, দক্ষতা হিসেবে অন্বেষণ, বিকাশ ও পুরস্কৃত করার বিষয় নয়। সৃজনশীল চিন্তাভাবনা চাহিদার দিক থেকে দ্রুততম বর্ধনশীল দক্ষতা হিসেবে অনুমান করা হলেও, এটি চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে সবচেয়ে কম উল্লিখিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশের চাকরির বাজারে, যেখানে নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রায়শই কঠোর নিয়মের ভিত্তিতে চলে, সেখানে এই পদ্ধতিগত অন্ধদৃষ্টি এড়ানোর জন্য কর্মশক্তি পরিকল্পনায় এই দক্ষতাগুলোকে সুস্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যাবশ্যক।
আঞ্চলিক তথ্যে, দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশ যেখানে অন্তর্ভুক্ত, এক স্বতন্ত্র প্যাটার্ন দেখায়। এখানকার নিয়োগকারীরা ‘অন্যদের সঙ্গে কাজ করা’-এর মতো দক্ষতায় আপেক্ষিক শক্তি রিপোর্ট করেন, যা গ্রামীণ সামাজিক বন্ধনের ইতিবাচক প্রভাব হতে পারে। কিন্তু ‘কৌতূহল ও আজীবন শিক্ষা (Curiosity and Lifelong Learning)’ এবং ‘সহনশীলতা, নমনীয়তা ও চটজলদি ভাব’-এ পদ্ধতিগত দুর্বলতা সুস্পষ্ট। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, কৌতূহল ও আজীবন শিক্ষা বৈশ্বিকভাবে দুর্বলতম দক্ষতা হিসেবে রয়ে গেছে।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাঁক, কারণ ২০৩০ সাল পর্যন্ত দ্রুত বাড়তে থাকা দক্ষতার তালিকায় কৌতূহল ও আজীবন শিক্ষা স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, যা ঐতিহাসিকভাবে মুখস্থ বিদ্যা এবং পরীক্ষার ফলাফলের ওপর জোর দিয়েছে, সেখানে শুরু থেকেই সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং প্রশ্ন করার সংস্কৃতিকে উৎসাহ দেওয়া অপরিহার্য। দেশের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশ তখনই গুণগত মানে রূপান্তরিত হবে, যখন এটি এই উচ্চক্রমের জ্ঞানীয় এবং সামাজিক-সংবেদনশীল দক্ষতাগুলো ভালোভাবে বিকশিত করবে, যা ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের জন্য অপরিহার্য।
এই ‘টেকসই’ বলে কথিত দক্ষতাগুলোর নাজুকতা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি। মানবকেন্দ্রিক সক্ষমতাগুলো বাহ্যিক আঘাতের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। কোভিড-১৯ মহামারি শিক্ষাদান ও সহনশীলতার মতো নিয়মিত আন্তঃব্যক্তিক মিথস্ক্রিয়া প্রয়োজন এমন দক্ষতাগুলোতে পরিমাপযোগ্য পতন ঘটায়। ২০২৫ সাল পর্যন্তও তথ্য দেখায়, এই দক্ষতাগুলো মহামারি-পূর্ব স্তরে ফিরে আসেনি। এটি নির্দেশ করে, ইচ্ছাকৃত অনুশীলন, প্রতিক্রিয়া এবং সহায়ক পরিবেশ ছাড়া এই দক্ষতাগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অস্থিরতা, জলবায়ু চাপ এবং দ্রুত নগরায়ণের প্রেক্ষাপটে স্থিতিশীল, সহায়ক প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতি মাধ্যমে সচেতনভাবে লালন না করলে এই দক্ষতাগুলো একইভাবে অবনতি হতে পারে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বৈশ্বিক প্রশিক্ষণের দুর্বলতাও লক্ষণীয়। ৩০ শতাংশ শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে সামাজিক-সংবেদনশীল দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করার প্রশিক্ষণ ছাড়াই কাজ করেন। বাংলাদেশে এই চ্যালেঞ্জটি আরও তীব্র, যেখানে বড় ক্লাসের আকার এবং পাঠ্যক্রমের বোঝা থাকা সত্ত্বেও মানবকেন্দ্রিক দক্ষতা গড়ে তোলার জন্য ইন্টারেক্টিভ ও চিন্তাশীল শিক্ষাদান পদ্ধতির সুযোগ সীমিত। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উচিত শিক্ষকের প্রস্তুতিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করা এবং এমন শিক্ষাদান পদ্ধতি গ্রহণ করা যা সহযোগিতামূলক প্রকল্প, সিমুলেশন এবং সমস্যাভিত্তিক শিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় শ্রবণ (Active Listening) এবং সহানুভূতির (Empathy) মতো দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করে।
এআই, ডেটা ও ডিজিটাল দক্ষতা নতুন অর্থনীতির পাঁচটি মূল দক্ষতার একটি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমস্যা সমাধান ও উদ্ভাবন চালিত করে। তবে এই দক্ষতাগুলো মানবকেন্দ্রিক স্কিলসের সঙ্গে সমন্বিত হয়েই অর্থপূর্ণ ফলাফলে রূপান্তরিত হয়। বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনার সঙ্গে এআই ও বিগ ডেটার ৫১ শতাংশ কোর্স যৌথভাবে শেখানো হয়। এই সমন্বয় ‘গুণক প্রভাব’ (Multiplier Effect) সৃষ্টি করে।
ভবিষ্যতের কাজের রূপরেখা স্পষ্ট: মেশিন পরিচালনা, প্রক্রিয়াকরণ এবং অপ্টিমাইজ করবে, কিন্তু মানুষকে নির্দেশনা দিতে হবে, সহমর্মিতা দেখাতে হবে, অনুপ্রাণিত করতে হবে এবং নৈতিকভাবে বিচার করতে হবে। প্রযুক্তিগত সাক্ষরতা এবং সাইবার নিরাপত্তার মতো দক্ষতাগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে দ্রুত গুরুত্ব বাড়া দক্ষতার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে, যা প্রমাণ করে, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এখন আর বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়; এটি মানবিক ‘নজরদারি’ (Human Oversight) এবং নৈতিক যুক্তির সঙ্গে যুক্ত। Coursera-এর ডেটা অনুসারে, AI-related learning human skills-এর সঙ্গে ১৯-৫১ শতাংশ কোর্সে যুক্ত থাকে, যা এই সমন্বয়ের গুরুত্বকে আবারও তুলে ধরে। বাংলাদেশের দক্ষতা কৌশলকে শুধু প্রযুক্তিগত ডিজিটাল সাক্ষরতার একক ফোকাস থেকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিনিয়োগের দিকে ঘুরতে হবে, যা অপরিবর্তনীয়ভাবে মানবিক দক্ষতায় করা হয়। সিস্টেম চিন্তাভাবনা (Szstems Thinking), যা ২০৩০-এর কোর দক্ষতার অংশ, তা এআই এবং মানবিক দক্ষতার এক সমন্বিত ব্যবহারের দাবি রাখে।
টেকসই উন্নয়নের জন্য সবুজ ও স্থায়িত্বের দক্ষতা (Green and Sustainability Skills) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ সংরক্ষণ, টেকসই অনুশীলন এবং লো-কার্বন অর্থনীতির দিকে রূপান্তরে এই জ্ঞান অপরিহার্য। এই দক্ষতাগুলো মানবকেন্দ্রিক স্কিলসের সঙ্গে যুক্ত, যেমন পরিবেশ সংরক্ষণ (Environmental Stewardship) ২০৩০-এর মূল দক্ষতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত এবং নেটওয়ার্কস ও সাইবার সিকিউরিটির পর এটি দ্বিতীয় স্থানে দ্রুত বাড়ছে।
বাংলাদেশের মতো দেশ, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, তার জন্য এই দক্ষতাগুলো কেবল একটি ঐচ্ছিক বিষয় নয়, বরং একটি কৌশলগত অনিবার্যতা। WEF-এর ২০২৫ সালের আনুষ্ঠানিক আলোচনায় জল, স্যানিটেশন ও হাইজিন (WASH) ইনোভেশনস, জলবায়ু অভিযোজন এবং টেকসই উন্নয়নের ওপর ফোকাস করা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যেখানে জলবায়ু চাপ এবং জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ গুরুতর, সেখানে WASH এবং গ্রিন স্কিলস একীভূত করে নীতি গঠনে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। এই দক্ষতাগুলো কেবল পরিবেশ রক্ষা করে না, বরং নতুন অর্থনৈতিক সুযোগও সৃষ্টি করে, বিশেষ করে টেকসই টেক্সটাইল উৎপাদন এবং পরিবেশবান্ধব লজিস্টিকসের মতো খাতে।
বাংলাদেশের জন্য সামনে চলার পথটি বহু-স্তরের অংশীদারদের জন্য একটি অ্যাকশনের ডাক দাবি করে, যা ডব্লিউইএফের প্রস্তাবিত নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
১. মূল্যায়নের বিবর্তন ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন: মানসম্মত পরীক্ষার বাইরে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোম্পানিগুলোকে পারফরম্যান্স-ভিত্তিক মূল্যায়ন গ্রহণ করতে হবে—সিমুলেশন, প্রকল্পের পোর্টফোলিও এবং সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়া, যা বাস্তব বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তি কীভাবে চিন্তা করে, খাপ খায় এবং সহযোগিতা করে, তা ধারণ করে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণ সংস্থাগুলোকে ডিজিটাল পোর্টফোলিও চালু করা উচিত, যা সৃজনশীলতা, নেতৃত্ব ও সহনশীলতার মতো দক্ষতা নথিভুক্ত করে, যা নিয়োগকারীদের কাছে আরও সমৃদ্ধ সংকেত প্রদান করবে। শিক্ষা এবং মেন্টরিং দক্ষতা ২০২৩ সাল থেকে উন্নতি লাভ করেছে, যা এই নীতিগত পরিবর্তনের জন্য ইতিবাচক ভিত্তি তৈরি করে।
২. বিকাশের জন্য মনস্তাত্ত্বিকভাবে নিরাপদ স্থান: চ্যালেঞ্জভিত্তিক শেখার (Challenge-Based Learning) চারপাশে পাঠ্যক্রম আবার ডিজাইন করা প্রয়োজন, যেমন মেক্সিকোর Tec21 মডেল। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় শিল্প ও এনজিওগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব করে শিক্ষার্থীদের বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য নিয়োজিত করতে পারে টেকসই টেক্সটাইল উৎপাদন থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ফিনটেক সমাধান পর্যন্ত যার মাধ্যমে সহযোগিতা, সহনশীলতা ও সৃজনশীল চিন্তাভাবনা শেখার কাঠামোর মধ্যে বোনা যায়। করপোরেশনে, নেতৃত্বের কর্মসূচিগুলিকে তাত্ত্বিক মডিউল থেকে সরে এসে এআই-চালিত রোল-প্লে সিমুলেশন অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যা পরিচালকদের ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশে কঠিন কথোপকথন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্বের অনুশীলন করতে দেয়।
৩. বিশ্বাসযোগ্য ক্রেডেনশিয়াল ইকোসিস্টেম ও কৌশলগত বিনিয়োগ: বাংলাদেশকে মানবকেন্দ্রিক দক্ষতার জন্য একটি বিশ্বস্ত ক্রেডেনশিয়াল ইকোসিস্টেম তৈরি করতে হবে। প্রচলিত ডিগ্রি এই সূক্ষ্মতা ধারণ করে না। ‘নৈতিক নেতৃত্ব’ বা ‘ডিজাইন থিংকিং’-এর মতো দক্ষতার জন্য যাচাইযোগ্য ডিজিটাল ব্যাজ ও মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল গ্রহণ দক্ষতাগুলোকে বহনযোগ্য ও দৃশ্যমান করতে পারে। বাংলাদেশের আইসিটি বিভাগ ও শিল্পনেতাদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ ধরনের বিকল্প সনদের জন্য একটি জাতীয় কাঠামোর পাইলট করতে পারে নিয়োগকারীদের দ্বারা বিশ্বস্ত এবং আজীবন শিক্ষার পথের সঙ্গে একীভূত তা নিশ্চিত করতে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ন্যাশনাল নিউ জয়নার লার্নিং উদ্যোগের মতো সরকারি-সহ-অর্থায়নকৃত কর্মসূচি ডিজাইন করা যেতে পারে, যা তৈরি পোশাক (RMG) খাতের ম্যানেজমেন্ট ট্র্যাক বা আইটি ফ্রিল্যান্সারদের মতো গোষ্ঠীগুলোকে লক্ষ করে।
৪. নেতৃত্ব ও প্রতিভা ব্যবস্থাপনায় ফোকাস: নেতৃত্ব ও সামাজিক প্রভাব এবং প্রতিভা ব্যবস্থাপনার (Talent Management) মতো দক্ষতাগুলো শীর্ষ ১০ গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতার মধ্যে রয়েছে। এর অর্থ হলো, কেবল শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানো নয়, বরং প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরে কীভাবে talent-কে চিহ্নিত, লালন ও ধরে রাখা হয়, সেই পদ্ধতিতেও মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। উচ্চতর ব্যবস্থাপনার জন্য সহানুভূতি ও সক্রিয় শ্রবণ (Empathy and Active Listening)-এর মতো দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ প্রয়োজন, যা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিস্থাপক কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে পারে।
মানবিক সুবিধা আনলক করা একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে উৎসাহিত করার বিষয়ে। এটির জন্য নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ ও সিইওদের প্রয়োজন দক্ষতার পাশাপাশি সহমর্মিতা, কোডিংয়ের পাশাপাশি সৃজনশীলতা এবং রাজস্বের পাশাপাশি সহনশীলতাকে উচ্চ ও স্থিরভাবে মূল্য দেওয়া। একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হওয়ার বাংলাদেশের যাত্রায়, এর সবচেয়ে কৌশলগত বিনিয়োগ বুদ্ধিমান মেশিনে নাও হতে পারে, বরং তা হতে পারে জ্ঞানী, আরও অভিযোজিত এবং আরও সহযোগিতাপূর্ণ মানুষের মধ্যে।
ভবিষ্যতের অর্থনীতি শুধু অ্যালগরিদম ও স্বয়ংক্রিয়তার ওপর নির্মিত হবে না, বরং বোঝার, সৃষ্টি করার এবং একসঙ্গে অধ্যবসায় করার জন্য মানুষের স্থায়ী সক্ষমতার ওপর গড়ে উঠবে। বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনা, সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, স্থিতিস্থাপকতা এবং কৌতূহল—এই চারটি প্রধান মানবিক দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা উভয়ই নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশের জন্য সেই স্বতন্ত্রভাবে মানবিক সুবিধায় বিনিয়োগের সময় এখনই।