কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ

ইসমা খাতুন, সূত্র : শেয়ারবিজ, ৮ নভেম্বর ২০২৪

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ

প্রযুক্তিনির্ভর এই ডিজিটাল বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেন আরেকটি বিপ্লবরূপে আবির্ভূত হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) হলো মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে কম্পিউটার বা কম্পিউটার প্রযুক্তিনির্ভর কোনো যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তব রূপ দেয়ার একটি ব্যবস্থা। এটি কম্পিউটার বিজ্ঞানের এমন একটি শাখা, যেখানে মানুষের চিন্তাভাবনা ও বুদ্ধিমত্তাকে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কম্পিউটার বিজ্ঞানী জন ম্যাকার্থিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক বলা হয়। কারণ তিনিই ১৯৫৫ সালে সর্বপ্রথম ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ শব্দগুচ্ছটি ব্যবহার করেন। তারও আগে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ অ্যালান টুরিং কোনো যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যাচাই করার উদ্দেশ্যে একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যা ‘টুরিং টেস্ট’ নামে পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে যাচাই করলে দেখা যায়, সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চর্চার মাধ্যমে মানবপ্রজাতিকে আজ এ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। একসময় মানুষ যেটা স্বপ্ন দেখত, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার বাস্তব রূপ দিতে সক্ষম হয়েছে।

মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান থাকলেও কিছু জটিল কাজ মানুষের দ্বারা করা সম্ভব হয় না, অথচ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে খুব সহজেই সেই কাজ স্বল্প সময়ের মধ্যেই করা যায়। সারা বিশ্ব যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগে নিজেদের উন্নতির মধ্যে মাতিয়ে তুলেছে, তখন বাংলাদেশকেও এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া উচিত। জনসংখ্যাবহুল এই দেশের বেকারত্ব সমস্যাকে ব্যবহার করে আমরা শিক্ষিত বেকারদের দিয়ে খুব সহজেই এসব গবেষণা কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে পারি। এর ফলে এসব বেকারেরা নিজেদের বেকারত্ব অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারবে, সেইসঙ্গে নিজেরা উদ্যোক্তা হয়ে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে খুব সহজে ও কম সময়ে অধিক কাজ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারবে, যা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করবে। মানুষের বিশ্রামের প্রয়োজন হয়, ক্লান্তি আছে। ফলে মানুষের দ্বারা একটানা কোনো কাজ করা কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোনো বিশ্রাম প্রয়োজন হয় না, বরং যেকোনো কমান্ড দিলে বিরামহীনভাবে কাজ করে যায়। জটিল ও বিপজ্জনক কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে খুব সহজেই করা সম্ভব। তাই আধুনিক বাংলাদেশকে নতুনভাবে বিনির্মাণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দিকে বিশেষ নজর দেয়া উচিত।

বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। মহাকাশ গবেষণা থেকে শুরু করে চাঁদে পাঠানোর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ, বিভিন্ন কারখানার পণ্য সরবরাহ করাসহ যেকোনো বিপজ্জনক কাজে, জটিল চিকিৎসার ক্ষেত্রে, গবেষণা কেন্দ্রে, শিক্ষাপাঠদানে, এমনকি বড় বড় রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দেয়া-নেয়া ও ডেলিভারির কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ ঘটছে। এ ছাড়া এটি ব্যবহার করে অনেক বৈচিত্র্যময় সমস্যার সমাধান হয়েছে। বিভিন্ন ভার্চুয়াল গেইমস, গাণিতিক প্রমাণ তৈরি, কম্পিউটার উৎপাদিত ‘ভার্চুয়াল অবজেক্ট’ ম্যানুপুলেট করা। গুগল, চ্যাটজিপিটি প্রভৃতি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আমরা মুহূর্তে যেকোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারছি। শুধু তা-ই নয়, চ্যাটজিপিটি সাবলীলভাবে মানুষের ভাষায় যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার ফলে বিশ্বের জটিল চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব। তাই আধুনিক বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতি বিশেষ নজর দেয়া উচিত। আমাদের দেশে প্রতিটি স্কুলপর্যায়ে গবেষণাধর্মী সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত। গত ২ নভেম্বর পাবনা আইডিয়াল ল্যাবরেটরি স্কুলে এক বিজ্ঞানমেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় ছোট ছোট সাধারণ শিক্ষার্থী আমাদের দেশের নানা ধরনের সমস্যা তুলে ধরেছে এবং তা সমাধানের পথকে তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছে। তারা দেখিয়েছে, কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য প্রতিনিয়ত ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে এবং এই ধ্বংসাত্মক প্রভাব দূর করতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ও বৃক্ষনিধন বন্ধ কতটা জরুরি। তারা আধুনিক বাংলাদেশকে গড়তে বিদ্যুৎ সংগ্রহ, এর অপচয় রোধ এবং নবায়নযোগ্য শক্তিকে সংরক্ষণের মাধ্যমে কীভাবে সুচারুভাবে ব্যবহার করা যায় তা দেখিয়েছে। এছাড়া যানজটের সমস্যাসহ নতুন বাংলাদেশ রূপায়নের বিভিন্ন প্রকল্প জনসাধারণের মধ্যে তুলে ধরেছে, যেটা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলশিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এরূপ গবেষণাচর্চা বাংলাদেশের প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিশ্চিত করতে হবে। এরূপ সুযোগ-সুবিধা সহজলভ্য হলে প্রতিটি স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের সৃজনশীলতা জাগ্রত হবে। তারা সহজেই বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান লাভের সুযোগ পাবে। সেইসঙ্গে তারা প্রত্যকেই এ ধরনের গবেষণামূলক চর্চায় নিয়োজিত থাকায় নিজেদের দেশের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিশ্চিত করা নয়, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এটি যেভাবে আমাদের নতুন সভ্যতা বিনির্মাণ করে, ঠিক মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ধ্বংসও করে দিতে পারে। এর দৃষ্টান্ত আগেও দেখা গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যে পারমাণবিক বোমা হামলা হয়েছিল, তা ছিল এই আধুনিক প্রযুক্তির ফসল। অনেক সময়ই অসাধু লোকেরা আত্মস্বার্থ পূরণের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার করে থাকে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক অ্যাপস অনেক সময় ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের জীবননাশের কারণ হতে দেখা গেছে। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে বেকারত্বের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। কারণ মানুষের চেয়ে কর্মঠ, বিরামহীন ও ঝুঁকিবহনকারী হওয়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মানুষের চাহিদা সংকুলান করার পর এটির অগ্রাধিকার পাওয়াটা স্বাভাবিক। এ সমস্যা দূরীকরণে মানুষের মধ্যে কিছুটা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন বিশেষ প্রয়োজন। সাধারণত আমরা সবসময় একটা ভালো কোনো চাকরি পাওয়ার আশা করি। জনবহুল দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলেও চাকরির বাজারের সেক্টরের হার সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা না থাকলেও এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বেকারত্ব সমস্যা থেকেই যাবে। বরং এটা বলা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগের ফলে যে পরিমাণ বেকারত্বের সংখ্যা বাড়বে, এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঠিক ব্যবহার স্বল্প সময়ের মধ্যে তার চেয়ে অধিক বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দিতে পারবে। এজন্য প্রত্যেকটা মানুষের লক্ষ্য ভালো চাকরি করা নয়, ভালো উদ্যোক্তা হওয়া উচিত এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিজেদের প্রতিপক্ষ নয়, কাজের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা উচিত। শিক্ষিত বেকারদের মাধ্যমে বেশি বেশি কর্মসংস্থান গড়ে তুলে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার প্রতি বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। তাহলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা হিসেবে নয়, বরং জনসম্পদ হিসেবে রূপান্তরিত হবে। পাশাপাশি একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে—আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করব, কিন্তু প্রযুক্তি দ্বারা নিজেরা ব্যবহূত হবো না। শুধু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহার করব। সতর্ক থাকতে হবে, এটিকে এতটা উন্নত ভারসনে আপডেট দেয়া যাবে না, যাতে মানবজাতির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়। এমন পর্যায়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করা যাবে না যে তারা নিজেরাই নিজেদের আপডেট করতে পারে এবং মানুষের ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করে। এজন্য এর ব্যবহারের নিরাপত্তা বজায় রেখে বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে তুলে ধরতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া উচিত।