কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

মানবিক করিডর ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ

এটিএম মোস্তফা কামাল [সূত্র : আমাদের সময়, ১১ জুন ২০২৫]

মানবিক করিডর ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ

মানবিক করিডর বলে কোনো করিডরের অস্তিত্ব কোথাও নেই। মানবিকতার আড়ালে থাকে সামরিক ইস্যু। করিডর দিতে গেলে সুনির্দিষ্ট শর্তাবলির অধীনে জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে সেটা দিতে হবে। জাতিসংঘ মানবিক করিডরের জন্য কক্সবাজার বিমানবন্দর নাকি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করবে সেটাও চুক্তিতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকবে। সে ক্ষেত্রে কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রামে একটা বড় পরিসরের জায়গা নিয়ে জাতিসংঘের লোকজনের আবাসন-যানবাহন-মালামাল গুদামজাতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় স্টোরেজ ফ্যাসিলিটিজ প্রোভাইড করতে হবে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কোন পয়েন্টকে করিডর হিসেবে ব্যবহার করা হবে সেটাও নির্ধারণ করতে হবে।

 

কক্সবাজারের উখিয়া নাকি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তে ওই করিডরের জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হবে সেটাও একটা গুরুত্বপুর্ণ ইস্যু। যেখানেই করিডরের জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হোক না কেন, সেই করিডর তৈরি এবং করিডর ব্যবহার করে মিয়ানমারে মালামাল প্রবেশের ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারের সম্মতি ও সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। ওই মালামাল কে রিসিভ করবে সেটাও পূর্বাহ্ণে নির্ধারণ করতে হবে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তো জাতিসংঘ কিংবা বাংলাদেশের কাছে সেরূপ কোনো সহযোগিতা চায়নি।

 

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কোনো সহযোগিতা না চাইলে জাতিসংঘ কেন মিয়ানমারকে সহযোগিতা করতে যাবে? এই ইস্যুটাও জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশকে ফয়সালা করতে হবে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যদি এরূপ করিডরের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে তা হলে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেবে- বাংলাদেশ কেন সেরূপ সংঘাতে জড়াবে? রাখাইন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ যদি আরাকান আর্মির কন্ট্রোলে থেকে থাকে তা হলে জাতিসংঘ কি মানবিক সহায়তা আরাকান আর্মির কাছে হস্তান্তর করবে? আরাকান আর্মি তো জাতিসংঘ স্বীকৃত কোনো কর্তৃপক্ষ নয়। সে কারণে আরাকান আর্মির কাছে মানবিক সহায়তা হস্তান্তরের প্রশ্নও বিবেচনায় আসার অবকাশ নেই। অধিকন্তু আরাকান আর্মির কাছে মানবিক সহায়তা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকার নিশ্চিতভাবেই আপত্তি জানাবে- সেরূপ প্রেক্ষাপটেও সামরিক সংঘাতের প্রশ্ন এসে যাবে।

 

 

 

রাষ্ট্রের নিরাপত্তাজনিত কোনো ইস্যু কিংবা সামরিক সংঘাতের কোনো বিষয় দেখা দিলে সেটির সঙ্গে বিজিবি এবং প্রতিরক্ষা বাহিনী জড়িয়ে পড়বে। তাই এ জাতীয় কোনো ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত রাখার আবশ্যকতা রয়েছে।

 

 

তার পর প্রশ্ন আসবে কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রাম থেকে সীমান্ত করিডর পর্যন্ত কোন্? সড়কপথ ব্যবহার করা হবে সেটাও সুনির্দিষ্ট করতে হবে- সে সড়কের সাইজ এবং মান নিয়েও প্রশ্ন আসবে, সেটা উন্নয়নের প্রয়োজন হলে কে সেটা করবে- খরচ কে বহন করবে- সেসব প্রশ্নের মীমাংসা করার বিষয়ও থাকবে। তার পর প্রশ্ন আসবে কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম পয়েন্ট থেকে নির্ধারিত সড়ক ব্যবহার করে সীমান্ত করিডর পর্যন্ত জাতিসংঘের লোকজন-মালামাল-যানবাহনের নিরাপদ অবস্থান এবং চলাচলের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করার প্রশ্ন। এরূপ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘ হয়তো মার্কিন সহযোগিতা চাইতে পারে। যদি মার্কিন সহযোগিতা চাওয়া হয় তা হলে মার্কিন সেনাদের অবস্থানের জন্য একটা সেনা ঘাঁটির প্রশ্নও এসে যাবে। তার পর প্রশ্ন এসে যাবে জাতিসংঘকে যে সড়কটি ব্যবহার করার জন্য বাংলাদেশ চুক্তিবদ্ধ হবে সেটি জাতিসংঘ ছাড়া অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে না? শুধু জাতিসংঘের একচ্ছত্র ব্যবহারের জন্য একটা সড়ক ছেড়ে দেওয়া বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে- সেটা অনেকটা অসম্ভব বিষয় হয়ে দাঁড়াবে?

 

 

তার পর যে ইস্যুটা নিষ্পত্তি করতে হবে সেটা হচ্ছে মানবিক করিডরের জন্য যেসব সম্পত্তি জাতিসংঘকে হস্তান্তর করা হবে সেটার জন্য কি লিজিং পদ্ধতি নাকি অন্য কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে? লিজের ক্ষেত্রে কতদিনের জন্য কী ধরনের লিজ- সেটাও লিজ ডিডে উল্লেখ থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থাকে লিজ দেওয়ার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে কোনো অঢ়ঢ়ৎড়াবফ ঋড়ৎসধঃ নেই। যদি সত্যিই লিজ দিতে হয় তা হলে নতুন করে ফর্মাট ডেভেলপ করতে হবে। লিজ তো আর বিনা পয়সায় হবে না- নামমাত্র মূল্যে দেওয়ার প্রশ্নও আসে না- জাতিসংঘকে উপযুক্ত পেমেন্টই দিতে হবে। সেই পেমেন্টের পরিমাণ বার্ষিক কমপক্ষে দুই ট্রিলিয়ন ডলারের কম হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।

 

 

বাংলাদেশ কেন জাতিসংঘের অনুরোধে এতসব ঝুঁকি নিতে যাবে? জাতিসংঘ বাংলাদেশকে এরূপ অনুরোধ জানানোর আগে জাতিসংঘকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিরাপদে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়ে তাদের পুনর্বাসন কাজ শেষ করতে হবে। জাতিসংঘ চাইলে তো এই কাজটি বহু আগেই নিষ্পত্তি করতে পারত। জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশের চাওয়া হবে যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করার জন্য। বাংলাদেশে মিয়ানমারের একজন শরণার্থী অবশিষ্ট থাকা অবস্থায়ও জাতিসংঘের অনুরোধে মানবিক করিডরের বিষয়ে সাড়া দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।

 

 

বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ শান্তিকামী দেশ। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে কোনোরূপ সামরিক সংঘাতে জড়াতে চায় না। সামান্যতম নিরাপত্তাঝুঁকি থাকলেও জাতিসংঘকে বাংলাদেশ কর্তৃক মানবিক কিংবা অমানবিক করিডর দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ বাংলাদেশের নিরাপত্তাঝুঁকি মোকাবিলায় জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সাহায্য করার কিছুই থাকবে না।

 

 

ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতে জাতিসংঘ কী করতে পেরেছে? গাজার লাখ লাখ শিশু-নারী-পুরুষ-যুবক-যুবতী সমগ্র বিশ্বমানবতার চোখের সামনে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে আর সামান্য খাদ্যের জন্য পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে- করিডর থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েল কয়েক মাস ধরে ত্রাণবাহী যানবাহন গাজায় ঢুকতে দিচ্ছে না- জাতিসংঘ সে ক্ষেত্রে কী করতে পেরেছে? বিশ্বমানবতা কোথায়? গাজাবাসীকে প্রয়োজনীয় সহায়তা না দিয়ে জাতিসংঘ কেন মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে অযাচিত (টঘডঅঘঞঊউ) সহযোগিতা করতে চাইছে- এ ক্ষেত্রে কোনো পরাশক্তির কোনো গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নে জাতিসংঘ তৎপর হয়েছে কিনা- সেই সহযোগিতার ধরন কী- খাদ্যদ্রব্য নাকি অন্য কিছু সেটাও খতিয়ে দেখার আবশ্যকতা রয়েছে। আরাকান অঞ্চলে তো মানবিক সহায়তা দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টিই হয়নি।

 

 

জাতিসংঘ যদি মিয়ানমারে কোনো মানবিক সহায়তা দিতে চায় তা হলে তাকে নাফ নদীর মিড স্ট্রিমের মিয়ানমারের অংশকে বেছে নেওয়াই উত্তম হবে। বাংলাদেশকে এর সঙ্গে জড়ানো কোনোক্রমেই সঠিক হবে না।

 

 

করিডর নিয়ে সরকারের দুই উপদেষ্টার দুই ধরনের বক্তব্যে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন একবার বলেছিলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘকে মানবিক করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে- এর মানে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনাক্রমে এরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এখন বলছেন, এই বিষয়ে কারও সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি। দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার দুই ধরনের বক্তব্যে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে যা চজঊঝঝ জঊখঊঅঝঊ দিয়ে নিরসন করা অত্যাবশ্যক।

 

 

জাতিসংঘকে মানবিক করিডর দেওয়ার বিষয়টা সরকারের (নির্বাচিত/অনির্বাচিত) স্বাভাবিক দায়িত্বের আওতায় পড়ে না। এই জাতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গণভোটের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের মালিক সাধারণ জনগণের সম্মতি নেওয়ার এবং জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে সেটা অনুমোদিত হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে।

 

 

জাতিসংঘের সঙ্গে এই বিষয়ে কোনো গঙট স্বাক্ষর করা হয়ে থাকলে কিংবা উপদেষ্টা পরিষদের সভায় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকলে কিংবা অন্য কোনোরূপ দালিলিক ডকুমেন্ট সৃষ্টি হয়ে থাকলে জাতিসংঘ মহাসচিবকে ঝঙজজণ বলে তা অবিলম্বে বাতিলপূর্বক সরকারকে এই জাতীয় উদ্যোগ থেকে সরে আসার আবশ্যকতা রয়েছে। জাতিসংঘকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব না দিয়ে দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ মাত্রায় গুরুত্ব দেওয়া অত্যাবশ্যক।

 

 

এটিএম মোস্তফা কামাল : অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব