মার্কিন ভিসা বাতিলের হুমকির মধ্যে নতুন যা আছে
ড. ফরিদুল আলম [কালের কণ্ঠ, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫]

সম্প্রতি হোয়াইট হাউসের কাছে একজন আফগান নাগরিক মার্কিন ন্যাশনাল গার্ডের দুজন কর্মীকে লক্ষ্য করে গুলি করেন। এই ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য স্থায়ীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়া এরই মধ্যে তাঁর পূর্বসূরি জো বাইডেনের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হওয়া লাখ লাখ অভিবাসীর অবস্থানকেও বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন। এখানেই ক্ষান্ত হননি তিনি।
ট্রাম্পের এই ঘোষণাটি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে, সেই সঙ্গে মার্কিন অভিবাসনের ক্ষেত্রে এটিকে দেখা হচ্ছে একটি বড় ভূমিকম্প হিসেবে। বাস্তবে এটি মার্কিন অভিবাসন নীতির ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, বিষয়টিকে একটু যাচাই করে দেখলে আমরা যা বলতে পারি তা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প আসলে নতুন করে কিছুই বলেননি, বরং তাঁর পুরনো কিছু সিদ্ধান্তই পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আমরা একটু লক্ষ করলে দেখব, এ বছরের জুন মাসে ট্রাম্পের এক ঘোষণায় ১৯টি দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসনের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এটিকে আবার দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।
আমরা এর আগেও দেখেছি, মার্কিন নেতৃত্বের মধ্যে অভিবাসীদের বিষয়ে মতের ভিন্নতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বের চেয়ে রিপাবলিকান নেতৃত্বের অবস্থান কিছুটা কঠোর। অতীতে দেখা গেছে, ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্টরা এ ক্ষেত্রে অনেকটা নমনীয়তার পরিচয় দিয়েছেন। এর আগে জো বাইডেনের শাসনামলেও বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ নাগরিক, যারা অবৈধভাবে এসে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেছিল, তাদের স্থায়ী করা হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল আফগানিস্তান। ২০২১ সালের অক্টোবরে তালেবানের কাছে মার্কিন সমর্থিত সরকারের পতন ঘটলে সেখান থেকে হাজার হাজার মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে গেলে তাদের বিশেষ কর্মসূচির আওতায় স্থায়ী করা হয়। বাইডেনের এই সিদ্ধান্তকে একহাত নিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি এটিকে অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করার পাশাপাশি তাঁর পূর্বসূরির মাধ্যমে স্থায়ী হওয়া, এমনকি নাগরিকত্ব পাওয়া তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের অবস্থান খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছেন। এর আওতায় এরই মধ্যে উল্লিখিত ১২টি দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণার মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। প্রথমত, তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের জন্য মার্কিন ভিসা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া এবং দ্বিতীয়ত, এরই মধ্যে নাগরিকত্ব পেয়ে যাওয়া কেউ যদি মার্কিন শান্তি, স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও মূল্যবোধের জন্য হুমকি বলে বিবেচিত হন, তবে তাঁদের অনুমোদন বাতিল করে দেওয়া। এখানে তাঁর এই ‘স্থায়ীভাবে ভিসা বাতিল’ বিষয়টি নিয়ে অনেক ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক হয়; যেমন—এখানে ‘স্থায়ী’ বলতে আসলে কী বোঝানো হয়েছে, এসব দেশের ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে ভিসা বাতিল করে দেওয়া, নাকি একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য এই নীতি কার্যকর রাখা? এখানে আমরা যদি মার্কিন অভিবাসন আইনের ব্যাখ্যা দেখতে যাই, তাহলে বরং এর প্রায়োগিক দিকটি লক্ষ করব।
এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে প্রেসিডেন্টরা এই নীতিকে তাঁদের মতো করে প্রয়োগ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অনেকটা ‘লোক-দেখানো’ প্রয়োগ হিসেবেও দেখা যেতে পারে। নির্বাচনের আগে তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে ছিল অবৈধ অভিবাসী এবং মার্কিন নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে যাঁরা বিবেচিত হবেন, তাঁদের বহিষ্কার করা, যা তাঁর বিজয়ে অনেকটা অবদান রেখেছে বলে ধারণা করা হয়। আর তাই দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি এমন ১৯টি দেশের প্রাথমিক তালিকা প্রণয়ন করেন। তবে নাগরিকত্ব পেয়ে যাওয়া এমন কারো ক্ষেত্রে যদি তিনি তাঁর এই বহিষ্কারের নীতি প্রয়োগ করতে যান, তাহলে নিঃসন্দেহে তাঁকে আইনি জটিলতার মধ্যে পড়তে হবে।
অবশ্য এর আগেও তাঁর প্রথম মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সে সময়ে এটিকে ট্রাম্পের মুসলিমবিদ্বেষ বলে প্রচার করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এটি আদালতের মাধ্যমে কিছু সংশোধনীর পর কার্যকারিতা পেলেও বাইডেনের সময়ে এ ক্ষেত্রে উদারতা প্রদর্শনের ফলে অসংখ্য অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে বৈধতা লাভ করেন। এখন ট্রাম্পের এই নয়া ঘোষণার ফলে এক ধরনের আইনি জটিলতার বাইরেও নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে মার্কিন অর্থনীতিতে অভিবাসীদের অবদানের বিষয়টি লক্ষ করলে দেখা যায় যে নতুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে শতকরা ২৫ শতাংশই এই অভিবাসী। এর বাইরেও উদ্ভাবনী এবং প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে তাঁদের বড় অবদান রয়েছে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ মার্কিন মনে করেন, অভিবাসীদের মধ্যে যাঁরা বৈধভাবে বসবাস করছেন, তাঁরা অর্থনীতিতে অবদান রাখার বাইরেও মার্কিন সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করছেন। এ ছাড়া মার্কিন ব্যবসায়ী শ্রেণির একটা বড় চাহিদা রয়েছে এই অভিবাসীদের বিষয়ে। তুলনামূলক সস্তায় তাঁদের নিয়োগ দেওয়া যায় বলে তারা লাভবান হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে আবার যাঁরা অবৈধভাবে বসবাস করছেন, তাঁদের সুরক্ষার বিনিময়ে সস্তা শ্রম আদায় করে নেওয়ার প্রবণতাও রয়েছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে ট্রাম্পের এই নীতি খুব একটা জনপ্রিয়তা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে মার্কিন মূলধারার জনগণ মনে করে, এই অভিবাসীদের কারণে ফেডারেল সেবা তাদের কাছে যথার্থভাবে পৌঁছে না। সাম্প্রতিক সময়ে এই অভিবাসীবিরোধী মনোভাব আরো বেশি জোরালো হয়েছে। ২০১৯ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ১৯ শতাংশ মার্কিন মনে করেন, এই অভিবাসীদের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৩২ শতাংশ মার্কিন মনে করেন, বৈধ অভিবাসীদের দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে অপরাধ সংঘটিত করার আশঙ্কা বাড়ছে।
ট্রাম্প তাঁর ঘোষণায় তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের অভিবাসীদের ভিসা বাতিলের কথা বলেছেন। প্রথমে ঘোষিত ১৯টি দেশের সঙ্গে আরো ৩০টি দেশের নাম যুক্ত হতে পারে। সংগত কারণেই ধারণা করা যায় যে সামনের দিনে একে একে তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রেই এই নীতি প্রয়োগ হতে পারে। তবে সব কথার বড় কথা হচ্ছে, তাঁর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি কার্যত অভিবাসীবিরোধী নতুন কোনো নীতির কথা জানান দেননি, বরং এরই মধ্যে গৃহীত কিছু সিদ্ধান্তের দ্রুত বাস্তবায়নের পথে হাঁটছেন।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়