কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

মায়ানমারে জরুরি অবস্থার সম্প্রসারণ ও রোহিঙ্গা সংকট

ড. সুজিত কুমার দত্ত । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

মায়ানমারে জরুরি অবস্থার সম্প্রসারণ ও রোহিঙ্গা সংকট

মায়ানমারের জান্তা সরকার সম্প্রতি দেশটিতে আরো ছয় মাসের জন্য জরুরি অবস্থা জারি রাখার ঘোষণা দিয়েছে। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল, যা বারবার বাড়ানো হচ্ছে। এই ঘোষণার মাধ্যমে জান্তা তাদের ক্ষমতা আরো সুদৃঢ় করতে চাইছে, কিন্তু এর ফলে দেশটির রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক সংকট আরো গভীর হচ্ছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি ও তাঁর নির্বাচিত সরকারকে উত্খাত করার পর থেকে মায়ানমার গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

 

 

জান্তা এখন সাধারণ নির্বাচনের কথা বললেও বিশ্লেষকদের মতে, এটি হতে পারে একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন, যার মাধ্যমে জেনারেলরা তাঁদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চাইছেন। এই পরিস্থিতিতে মায়ানমারের জনগণের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত এবং এর প্রভাব শুধু মায়ানমারেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও পড়বে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপটে। জরুরি অবস্থা বাড়ানোর ফলে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান আরো পিছিয়ে যাবে। মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

 

 

এ ছাড়া সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তাদের নীতি পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত দেয়নি। ফলে বাংলাদেশের ওপর রোহিঙ্গাদের চাপ বাড়ছে, যা দেশটির অর্থনীতি, পরিবেশ ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

 

২০২০ সালের নভেম্বরে মায়ানমারে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কিন্তু সেনাবাহিনী নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে।

 

 

সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে জান্তা সরকার বারবার জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়িয়ে চলেছে, যার সর্বশেষ সংস্করণ হলো আরো ছয় মাসের জন্য জরুরি অবস্থা জারি রাখা। জান্তার দাবি, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য স্থিতিশীলতা ও শান্তি অর্জন করা প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই জরুরি অবস্থা জান্তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার একটি হাতিয়ার মাত্র।

 

 

জরুরি অবস্থার নামে মায়ানমারের সেনাবাহিনী দেশজুড়ে ব্যাপক দমন-পীড়ন চালাচ্ছে।

 

প্রতিবাদকারী, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এবং সাধারণ নাগরিকদের ওপর নির্যাতন, গুম, হত্যা এবং নির্বিচারে গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। সহিংসতা এতটাই বেড়েছে যে মায়ানমার এখন গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছে। দেশটির জনগণ ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং তাদের খাদ্য, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। মায়ানমারের এই সংকট শুধু দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

 

 

জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা মায়ানমারে চলমান সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছে। কিন্তু জান্তা আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে তাদের দমননীতি অব্যাহত রেখেছে। মায়ানমারের ইতিহাসে সামরিক শাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক কারচুপি, ভীতি প্রদর্শন এবং বিরোধী দলগুলোকে দমন-পীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এবারও একই চিত্র দেখা যেতে পারে। জান্তা সরকার এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নানা রকম বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে এবং বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার ও দমন করা হচ্ছে। এর ফলে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে।

 

 

মায়ানমারের সংকটের প্রভাব শুধু দেশের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ২০১৭ সালে মায়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায়, যার ফলে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এই সংকট এখনো চলমান এবং মায়ানমারে জরুরি অবস্থা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা আরো ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার বোঝা বহন করছে। এই সংকটের স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়েই থাকবে। বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা প্রদান করলেও এই সংকটের স্থায়ী সমাধান ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। মায়ানমারের জরুরি অবস্থা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানকে আরো জটিল করে তুলেছে।

 

 

বাংলাদেশের ওপর এই বোঝা কমাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। মায়ানমারের সংকট মোকাবালায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পদক্ষেপগুলো সীমিত ও অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র জান্তা সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, কিন্তু তা জান্তা সরকারকে তাদের দমননীতি থেকে বিরত রাখতে পারেনি। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মায়ানমারের পক্ষে ভেটো দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক পদক্ষেপকে ব্যাহত করেছে। এশিয়ান দেশগুলোর সংগঠন আসিয়ানও মায়ানমার সংকট মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছে। ২০২১ সালের এপ্রিলে আসিয়ান মায়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে একটি পাঁচ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যাতে সহিংসতা বন্ধ, সংলাপ শুরু এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু জান্তা সরকার এই চুক্তির কোনো ধারাই বাস্তবায়ন করেনি এবং আসিয়ান এই ব্যর্থতার জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে।

 

 

মায়ানমারের সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। প্রথমত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জান্তার ওপর আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে, যাতে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা সীমিত হয়। দ্বিতীয়ত, মায়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী শক্তিগুলোকে সমর্থন ও সহায়তা প্রদান করতে হবে, যাতে তারা জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারে। তৃতীয়ত, মানবিক সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে এবং মায়ানমারের জনগণের জন্য মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।

 

 

মায়ানমারে জরুরি অবস্থার সম্প্রসারণ দেশটির সংকটকে আরো গভীর করছে। জান্তা সরকারের দমননীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং প্রহসনমূলক নির্বাচনের পরিকল্পনা মায়ানমারের জনগণের ভবিষ্যেক অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই সংকট শুধু মায়ানমারেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এর প্রভাব প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশসহ পুরো অঞ্চলে পড়েছে। রোহিঙ্গা সংকটের মতো জটিল সমস্যার সমাধানও এই পরিস্থিতিতে আরো কঠিন হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান ছাড়া বাংলাদেশের ওপর এই বোঝা কমানো সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করে মায়ানমারের সংকট ও রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় এই সংকট কেবল মায়ানমার ও বাংলাদেশের জন্যই নয়, পুরো অঞ্চলের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

 

 

লেখক : সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়