কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

মধ্যম আয়ের ফাঁদ থেকে মুক্তির উপায়

আব্দুল বায়েস । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫

মধ্যম আয়ের ফাঁদ থেকে মুক্তির উপায়

আমরা প্রায়ই মধ্যম আয়ের ফাঁদ কথাটি শুনে থাকি, যদিও মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার দৌড়ে এমনকি বাংলাদেশও। মধ্যম আয়ের ফাঁদ এমন এক পরিস্থিতি, যখন মধ্যম আয়ের দেশ মজুরি বৃদ্ধির কারণে শ্রমঘন পণ্য রপ্তানিতে আপেক্ষিক সুবিধা হারায়, কিন্তু একই সঙ্গে কম উৎপাদনশীলতার জন্য উঁচু মূল্য সংযোজন জনিত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায়, মজুরি থাকে স্থবির অথবা পড়ন্ত এবং বর্ধনশীল হয় অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি।

 

 

ইংরেজিতে মিডল ইনকাম কান্ট্রিজ বা ‘মিকস’ এখন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি বড় উদীয়মান অংশ হিসেবে আবির্ভূত। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ, মোট জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ, মোট চরম দরিদ্রের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এবং কার্বন নিঃসরণের প্রায় ৭০ শতাংশ ধারণ করে বিশ্বমানচিত্রে দেশগুলো সগৌরব উপস্থিতি জানান দেয়। মূলত লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর অনেকে কয়েক দশক ধরে মধ্যম আয়ের দেশের বন্ধনীতে বন্দি হয়ে পড়ে আছে, তাই খাঁচা ভেঙে বের হওয়ার পথ খুঁজছে। এ নিয়ে অনেক গবেষণার জল ঘোলা হয়েছে। তবে সম্প্রতি বিআইডিএসের ২০২৪ এবিসিডি কনফারেন্সে ইন্দারমিত এস গিল ও সমিক ভি লাল ওই বিষয় নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ এবং উপদেশ উপস্থাপন করলেন, তা এমনকি বাংলাদেশকেও বিবেচনায় নেওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি।

 

 

মধ্যম আয়ের ফাঁদ থেকে মুক্তির উপায়দুঃখজনক হলেও সত্যি যে মিকসের এখন বড্ড দুঃসময়। জল ভরা খানাখন্দে পতিত সেসব দেশ সময়ের বিপরীতে দ্রুত ধাবিত, বহিঃস্থ প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে জাপটাজাপটি করছে। সুতরাং অবাক হওয়ার মতো সংবাদ নয় যে সর্বমোট মাত্র ২৫ কোটি মানুষ নিয়ে ৩৪ বছরে মাত্র ৩৪টি দেশ মধ্যম থেকে উঁচু আয়ের দেশে উন্নীত হতে পেরেছে। কয়েক দশক ধরে দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় মাথাপিছু আয় স্থবির; দুর্ভোগ ধেয়ে আসছে তিন দিক থেকে—নিম্নগামী প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত সংকট এবং সংকুচিত সুযোগ।

 

 


বলা হয় যে একটি উঁচু আয়ের দেশের তুলনায় মধ্যম আয়ের দেশের মন্দার মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা তিন গুণ বেশি। এটি হলো মধ্যম আয়ের ফাঁদ—ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে...। অবশ্য বিজ্ঞজনদের ধারণা, বের হওয়ার পথ বিলকুল খোলা যদি নৈরাজ্য সৃষ্টি না হয়, মেধার দাম দেওয়া হয় এবং সংকটকে পুঁজি করা যায়।
দুই.

 

 

প্রথমত, এসব দেশে পুঁজিসম্ভার (ক্যাপিটাল) অনেক কম। আবার এই কম পুঁজি ব্যবহৃত হয় খুব অদক্ষভাবে। যদি যথেষ্ট পুঁজি পুঞ্জীভবন ঘটত, তাহলে ওখানকার কাজে পারিতোষিক হতো যুক্তরাষ্ট্রে থাকা পারিতোষিকের তিন-চতুর্থাংশ; এখন মাত্র এক-পঞ্চমাংশ। স্মর্তব্য যে এসব দেশে কর্মীপ্রতি জিডিপি যুক্তরাষ্ট্রের কর্মীপ্রতি জিডিপির এক-পঞ্চমাংশ; ভৌত ও মানব পুঁজি ৭০ শতাংশ। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে কর্মীপিছু জিডিপি যুক্তরাষ্ট্রের কর্মীপিছু জিডিপির যথাক্রমে ৯, ১৩ ও ১৪ শতাংশ; ইন্দোনেশিয়া ও চীনে ১৮-১৯ শতাংশ। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ভৌত ও মানব পুঁজির তুলনায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে এই হিস্যা যথাক্রমে ৫৮, ৩২ ও ৬১ শতাংশ; ইন্দোনেশিয়া, চীন ও পোল্যান্ডে ৭৮ থেকে ৮৭ শতাংশ। 

 


দুই. শুধু যে পুঁজির স্বল্পতা তা নয়, মিকসে পুঁজির অদক্ষ ব্যবহার প্রবৃদ্ধির প্রসারণ তো ঘটায়ই না, বরং প্রবৃদ্ধিকে পিছু টেনে ধরে, উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহ করে। এসব দেশে উৎপাদনশীল কারখানাগুলো খুব একটা বিস্তার লাভ করে না, অদক্ষ কারখানাগুলো আবার বাজার ছাড়ে না। অধিকসংখ্যক উৎপাদনশীল শিল্প-কারখানা হওয়ার ক্ষেত্রে পদে পদে পর্বতপ্রমাণ বাধা। এ ধরনের উৎপাদনশীলতানির্ভর বিকৃতি কেনিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে মানবপুঁজি এবং মেধার অপ ও অদক্ষ ব্যবহারের উদাহরণের অভাব নেই এবং সংরক্ষণবাদী শক্তিশালী শক্তি এসব দেশে নতুন কিছু সৃষ্টির পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।

 

 

বলা বাহুল্য যে এই পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমশক্তির দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানোর বিকল্প নেই। এমনিতেও এসব দেশে মোট শ্রমশক্তিতে উঁচু মানের দক্ষ শ্রমের অবদান খুব কম এবং পেশাগত সেবায় নারীদের অংশগ্রহণ যৎসামান্য। জ্বালানির অদক্ষ ব্যবহার এবং নির্ভরশীল জ্বালানির অভাবে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর ৬০ শতাংশ কারখানায় ঘন ঘন বিদ্যুিবভ্রাট ঘটে এবং প্রায় ৪০ শতাংশ জেনারেটর ব্যবহার করে।

 

 

উঁচু আয়ের দেশের তুলনায় এসব দেশে নিঃসরণ এবং জ্বালানি নিবিড়তা যথাক্রমে সাড়ে তিন ও আড়াই গুণ বেশি। সুতরাং এসব দেশের জন্য যে অর্থনৈতিক অত্যাধুনিকতা প্রয়োজন, তা বোধ করি বলা বাহুল্য। অন্যদিকে বিশ্বপরিসরে বাণিজ্য সুযোগ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। বলতে গেলে মিকস এখন সরাসরি বিপরীত দিক থেকে আসা বাতাসের মুখোমুখি। এর কারণ ধনী দেশগুলো একের পর এক সংরক্ষণবাদী নীতির নীড়ে আশ্রয় নিতে চলেছে। উন্নত দেশের বাজার হারিয়ে রিক্ত বেশির ভাগ উন্নয়নশীল অর্থনীতি আগের চেয়ে প্রকট ঋণগ্রস্ত।

 

 

যা হোক, মধ্যম আয়ের ফাঁদ থেকে বের হতে হলে দেশগুলোকে কেবল একটি নয়, দুটি রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যেতে হবে বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে প্রথমটিকে ঘিরে আছে বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগের সঙ্গে সংমিশ্রণ বা ইনফিউশন। দ্বিতীয়টিতে থাকবে বিনিয়োগ, সংমিশ্রণ বা ইনফিউশন এবং নবধারা। সংমিশ্রণ পাশ কাটিয়ে নবধারার দিকে অগ্রসর হওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিং; অকালিক ব্যাঙের মতো লাফিয়ে ‘জ্ঞান-অর্থনীতি’ বানানোর প্রচেষ্টা উন্নয়নকে খোঁড়া করে দিতে পারে (উদাহরণ কোরিয়া বনাম ব্রাজিল)।

 

 

তিন.

তাহলে রাহুমুক্তির রাস্তা কোন দিকে? ধীরগতির প্রবৃদ্ধিতে আটকা পড়া অবস্থান থেকে বাঁচতে হলে মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও ধ্বংসের মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে (ব্যালান্স অব ক্রিয়েশন, প্রিজারভেশন, ডেস্ট্রাকশন)। অর্থনৈতিক শক্তির সৃষ্টি নিজে সবচেয়ে বড় সমস্যা নয়, তবে এর জন্য প্রয়োজন (অপ্রতুল) পুঁজি, প্রতিভা এবং শক্তির অন্তক্ষেপ। সংরক্ষণের জন্য দাবিদাওয়া প্রায়ই রাষ্ট্র দ্বারা প্ররোচিত হয় এবং সংকট ছাড়া ধ্বংস হলো সবচেয়ে দুর্বল শক্তি।

 

 অন্যদিকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সীমান্তে সম্পূর্ণ দক্ষতা অর্জনের জন্য চিন্তা-ভাবনার গুরুতর পরিবর্তন প্রয়োজন; যেমন—বড় আকারের কারখানা থেকে মূল্য সংযোজনকারী শিল্পের চিন্তা করা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে গুরুত্ব প্রদান, অসমতা থেকে সামাজিক গতিশীলতা এবং শক্তির উৎস থেকে শক্তি দক্ষতা ও নির্গমনের তীব্রতা বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। প্রথাগত ধ্যান-ধারণার ওপর ভিত্তি করে নীতিমালা অত সহজে ফাঁদ থেকে মুক্তি মিলবে বলে মনে হয় না।

 

 

সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও ধ্বংস—এই তিনটি শক্তির মধ্যে একটি সুস্থ ভারসাম্য বজায় রাখা এবং সৃষ্টিকে শক্তিশালী করা যায় কেবল মেধাকে (মেরিট) মূল্যায়ন করে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে। সংকটকে পুঁজি করে পুরনো নীতিগুলো ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ধ্বংসের মাত্রা হ্রাস করা যেতে পারে। সংরক্ষণবাদকে দুর্বল করার জন্য পদাধিকারে থাকা মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে অভ্যস্ত করা প্রয়োজন। মোটাদাগে, নীতিমালাবিষয়ক ব্যবস্থাপত্র নিম্নরূপ হতে পারে :

 

১. বিনিয়োগ : অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করা দরকার।

২. বিনিয়োগ+ইনফিউশন : ক. উন্মুক্ত করে বাজারগুলোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করে তোলা; খ. উপকরণ ও পণ্য বাজারের অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ হ্রাস এবং গ. ব্যাবসায়িক গতিশীলতাকে উদ্দীপিত করার জন্য মূল্য সংযোজন সংস্থাগুলোকে পুরস্কৃত করা।

৩. বিনিয়োগ+ইনফিউশন+উদ্ভাবন : ক. পুঁজিবাজারকে গভীরতর করা এবং ইকুইটি অর্থায়ন প্রসারিত করা; খ. একচেটিয়া ব্যবসাবিরোধী আইন এবং প্রতিযোগী সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করা এবং গ. বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার সুরক্ষা দেওয়া। এ ছাড়া উপকরণ ও পণ্য বাজারের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করে বাজারগুলোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা গুরুত্বপূর্ণ।

 

 

শিক্ষা, সামাজিক গতিশীলতা এবং উদ্যোক্তা উত্তরণকল্পে নীতিমালাসংক্রান্ত সুপারিশ নিম্নরূপ হতে পারে; যেমন— ১. বিনিয়োগ : ভিত্তি দক্ষতা প্রসারিত এবং শেখার ফলাফল উন্নত করে মানবপুঁজিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি।

২. বিনিয়োগ+ইনফিউশন : নারী, সংখ্যালঘু এবং সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর জন্য সমান সুযোগ প্রদান করে অভিজাতদের উদ্বুদ্ধ করা, উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থান সম্প্রসারণের জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার, স্থানীয় ও বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সংযোগ গড়ে তোলা এবং শিক্ষিত কর্মীদের দেশত্যাগে সাহায্য করা, যাঁদের দক্ষতার মূল্য নেই দেশীয় বাজারে।

 

 

৩. বিনিয়োগ+ইনফিউশন+উদ্ভাবন : শিল্প-শিক্ষা সংযোগগুলোকে দেশীয়ভাবে শক্তিশালীকরণ, উন্নত অর্থনীতিতে প্রবাসীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য প্রগ্রামগুলো প্রসারিত করা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা বিস্তৃত করা।

জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতাকে সাহায্য করার জন্য নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য শ্রমবাজারের বৈষম্য হ্রাস করার লক্ষ্যে উপযুক্ত নীতি বিকল্পের মাধ্যমে প্রতিভা সংগ্রহ এবং প্রতিভা বরাদ্দ প্রয়োজন।

 

 

স্থানান্তর : শক্তি, নির্গমন এবং সংকট ব্যবস্থাপনা।

বিনিয়োগ : লভ্যতা এবং গ্রিড নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে এবং ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে নিয়ন্ত্রক কাঠামোর সংস্কার।

বিনিয়োগ+ইনফিউশন : বাজেটের সীমাবদ্ধতা কঠোর করে সরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শৃঙ্খলাবদ্ধকরণ।

মোটকথা, মধ্যম আয়ের ফাঁদ থেকে বের হতে গেলে প্রথাগত চিন্তা-ভাবনা চলবে না, বরং বিনিয়োগ, ইনফিউশন এবং নবধারামূলক কর্মসূচি নিয়ে এগোতে হবে। নতুবা ওই বিখ্যাত গানের মতো অবস্থা হবে—‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে...।’

 

 

লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়