মধ্যপ্রাচ্যে সভ্যতা সংঘাত
ড. আহমদ আনিসুর রহমান [প্রকাশ : আমার দেশ, ২৮ জুন ২০২৫]

মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক-সামরিক সংঘাতের এক ভয়ংকর জটাজালে আটকে পড়ে নিরীহ শিশু, নারী, বয়োবৃদ্ধ, যাজক-সাধক, বিজ্ঞানী-গবেষকসহ কোটি কোটি মানবসন্তান যে ভয়াবহ ধ্বংসের মুখোমুখি, তা শুধু একটি স্থান-কালসীমিত সমসাময়িক রাজনৈতিক-সামরিক সংঘাতই নয়। এই সংঘাতের ভেতর দিয়ে যা প্রকাশিত, তা হলো, বৈশ্বিক মানবসভ্যতা আজ এক মহা সভ্যতা সংকটে।
মানবসভ্যতার সূচনা মধ্যপ্রাচ্য থেকে, তার সমাপ্তিও সেখান থেকেই প্রতিভাত । সভ্যতার সংঘাতের সূচনাও সেখানেও, শেষও সেখানেও। আশা করি, এই শেষটি বর্তমানের এই সংঘাত দিয়ে না হয়ে সংঘাত নিরসনে সভ্যতার স্থিতি ও প্রগতি নিশ্চিত হোক।
মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান সমসাময়িক রাজনৈতিক-সামরিক সংঘাতের ঘটনাবলি মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে, আর নানা ধরনের সংবাদমাধ্যম ও বিশ্লেষক তার খুঁটিনাটি খবর ও বিশ্লেষণ দিয়ে যাচ্ছেন। এ হলো ‘মাইক্রো-পলিটিক্যাল (micro-political)’ বর্ণনা ও বিশ্লেষণ, তা মোটামুটি যথেষ্ট পাওয়া যাচ্ছে। আমি এখানে তাতে আর কালক্ষেপণ করব না। বরং যা পাওয়া যাচ্ছে না, এসবের যে ব্যাপকতর বৈশ্বিক সভ্যতা—গত মহাকালীন প্রেক্ষিতে তার প্রতিস্থাপন ছাড়া এসবকে ঠিকমতো বোঝা অসম্ভব, তার একটি যথাসম্ভব সংক্ষেপ উপস্থাপনা প্রদানের চেষ্টা করব। তা হবে একটি ম্যাক্রো-পলিটিক্যাল (macro-political) উপস্থাপনা।
সভা থেকে সভ্যতা। সভার মাধ্যমে পারস্পরিক সমস্যা সমাধানে সক্ষমতাই সভ্যতা। এই সক্ষমতা হারানোর ফলই হয় সংঘাত। আর এই সংঘাতই সভ্যতা ভেঙে পড়ার সূচনা।
মধ্যপ্রাচ্যে এখন সেইরূপ লক্ষণ।
মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান যুদ্ধ বস্তুত দুই সভ্যতার সংঘাতের প্রকাশ । এমন এক প্রাচীন সংঘাত, যার সূচনা হাজারো বছর আগে।
একক মনুষ্যসভ্যতা
নূহ, মহানূহ, মনুর প্লাবন বলে প্রসিদ্ধ যেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানবসভ্যতা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়, তা থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত মনুষ্যকুলের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি সংস্করণ মাত্র বাকি থাকে। সবই নূহের পরিবার অনুসারীদের ভেতর একেশ্বরবাদী বিশ্বাসী ৭০-৮০ জন তাদের পিতৃতুল্য নেতৃত্বে জগতে নিজস্ব নতুন সমাজ ও সভ্যতা সৃষ্টি করেন। সম্ভবত বাব-এলাহুন, সংক্ষেপে বাবেলন বা ব্যাববিলনকে কেন্দ্র করে এ সভ্যতা গড়ে উঠতে শুরু করে। নূহ-নবীর পরবর্তী নেতৃত্বে আসেন তাঁর তিন প্রধান পুত্র—সাম, শ্যাম, শেম বা সেম; য়াফেস; আর হাম। কালে তাঁদের বংশধর ও অনুসারীরা তিন প্রধান গোত্র রূপে আবির্ভূত হয়—যথাক্রমে, সামী, শামী, শ্যামল, শেমিতি বা সেমিটিক; য়াফেতীয়, বা য়াপেতী বা য়াপেটিক; আর হামি, বা হ্যামিটিক। তাঁদের যৌথ সভ্যতার ওই কেন্দ্রভূমি ছিল আজকের ইরাক ও সিরিয়ার সন্ধিস্থলের কাছাকাছি, দজলা ও ফুরাত নদীর অববাহিকায়। তাঁদের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকলে য়াফেসের বংশধরেরা উত্তর দিকে আজকের তুরস্কের দিকে, আর হামের বংশধরেরা দক্ষিণ ওমান ও ইয়েমেনের দিকে সরে যায় জীবিকার সন্ধানে। শামীরা থেকে যায় মূল আবাসস্থল, আর সেখান থেকে বিস্তৃত হয় আজকের আরব্যোপদ্বীপ ও তার উত্তরের এলাকায় আজকের ভূমধ্যসাগর থেকে নিয়ে দজলা-ফুরাত অববাহিকা পর্যন্ত এলাকায়। য়াফেসের বংশধর, যারা কালে ‘আর্য’ নামে পরিচিত হয়, তারও উত্তরে, আজকের তুরস্ক থেকে একদিকে উত্তর-পশ্চিমে আজকের গ্রিস হয়ে আরো দূরে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইউরোপে।
অন্যদিকে পশ্চিমে আজকের মধ্য এশিয়া হয়ে পরে কাশ্মীর থেকে একদিকে দক্ষিণে গিয়ে দুভাগ হয়ে এক ভাগ ছড়িয়ে পড়ে আজকের উত্তর ভারতে এবং সেখান থেকে আজকের আফগানিস্তান আর পারস্য বা আজকের ইরানে। অন্য ভাগ পূর্ব ও উত্তর-পূর্বমুখী সফরে ছড়িয়ে পড়ে আজকের তিব্বত, সিন্কিয়াং, চীন এবং তারও পরে আজকের দূরপ্রাচ্যের বাদবাকি সব জায়গায়। যেসব জায়গায় তারা ছড়িয়ে পড়ে, সেসব জায়গায় তারা তাদের মূল বাবেলীয় সভ্যতারই যার যার গোত্র মোতাবেক কিঞ্চিৎ ভিন্ন ভিন্ন উপসভ্যতা গড়ে তোলে। কালে এসব উপসভ্যতা ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার রূপ ধারণ করে—প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের শামী, শ্যামল বা ‘সেমিটিক’; দূরপ্রাচ্যের প্রধানত চৈনিক-আর্য আর ইউরোপ, উত্তর ভারত, আফগানিস্তান ও পারস্য বা ইরানের মূল-আর্য; আর আফ্রিকা ও দক্ষিণ ভারতের হামীয় বা ‘হ্যামেটিক’ সভ্যতা। কালে ওমান ও ইয়েমেন হয়ে পূর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়া শামী বা সেমিটকদের হামীয় প্রভাবে কিঞ্চিৎ হামায়িত রূপ হিসেবে দার-আবীর তথা দ্রাবিড়-শ্যামল সভ্যতার উদ্ভব হয়, যারই এক শাখা হিসেবে কালে বাঙালিদের উদ্ভব। একইভাবে ইয়েমেন থেকে আফ্রিকার উত্তরপূর্বে উদ্ভব হয় আফগান, যারা কালে ‘পাঠান’ বলে পরিচিত হয় তাদের সভ্যতার।
প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যে থেকে যাওয়া শামী, শ্যামল বা সেমিটিকরা কালে প্রধানত দুভাগে ভাগ হয়ে যায়—বিশালতর সংখ্যাগুরু আরব আর হিব্রু। কালে হিব্রুদের একটি অংশ ‘মুসতা’রব’, অর্থাৎ ‘আরবায়িত’ হয়ে আরবদেরই অন্তর্ভুক্ত শুধু নয়, তাদের নেতৃস্থানীয় হয়ে সেমিটিক সভ্যতার প্রধানতম শাখা হিসেবে গড়ে তোলে আরব্য বা বনি-ইসমায়িলীয় উপসভ্যতা । আর হিব্রু নামীয় ক্ষুদ্রতর সংখ্যালঘুর বাদবাকি কালে বনি-ইয়কুব রূপে গড়ে তোলে ভিন্নতর বনি-ইয়কুবী উপসভ্যতা। ইয়কুব নবীর জ্যেষ্ঠপুত্র য়হূদের নামে, কালে তাদের য়হূদও বলা হয়।
আরো পরে তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিককালে চৈনিক-মঙ্গোলীয় আর্যদের মধ্য এশিয়ায় বসত করা খাজার গোত্র এহুদদের পরবর্তী কালের কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত ধর্ম গ্রহণ করে শ্যামায়িত-আর্য রূপে একসময় ইউরোপের আর্যদের দেশ রাশিয়া, পোল্যান্ড, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড প্রভৃতিসহ সেসব দেশেরই বিস্তার রূপ আমেরিকায়ও প্রসারিত হয়।
সভ্যতার বিভাজন
কালে যার যার পারিপার্শ্বিকতা, তার ভেতর দিয়ে লব্ধ জীবনাভিজ্ঞতা, অন্যান্যের প্রভাব প্রভৃতির ফলে মূলত একই নূহীয় বা মহানূহীয়, তথা মহানুষ্য বা মনুষ্যসভ্যতার তিন প্রধান উপসভ্যতা—সামীয়, সেমেটিক বা শ্যমল, য়পতীয় বা আর্য, আর হামীয়—কিঞ্চিৎ ভিন্ন ভিন্ন রূপে বিকশিত বা বিকৃত হয়ে বিভিন্ন স্বকীয় সভ্যতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিস্তৃত হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, তৎসংশ্লিষ্ট বিশ্বাসমালা, আর দুয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জীবনধারায় উল্লেখযোগ্য পার্থক্যের উদ্ভব হয়। এর ভেতর প্লাবন-পরবর্তী মনুষ্যসমাজের আদি নিবাস, বাবিলন ও তার বিস্তার-রূপ আরব্যোপদ্বীপ আর তার উত্তরে ভূমধ্যসাগর আর তুরস্ক পর্যন্ত দজলা-ফুরাত উপত্যকায়ই প্রধানত থেকে যায় যে সামীয়, শ্যামল বা সেমেটিকেরা, তাদের সভ্যতাটিই বিকশিত হয় সে মূল নূহীয়, মহানূহষ্য বা মনুষ্য সভ্যতার নিকটতম। এই মূল-মনুষ্য সভ্যতা ও তার নিকটতম পরবর্তী সংস্করণ, তথা সেমিটিক, বা শ্যামল বা শামী সভ্যতার মৌলিক বিষয় ছিল এবং মোটামুটি থেকে যায় দীর্ঘকাল কয়েকটি অপরিহার্য ধারণা।
সেগুলো ছিল, বা দীর্ঘকাল ধরেই থেকে যায়—১. বাবিল্হুন-এর ইল্হ, তথা এক খোদা বা একেশ্বরবাদের বিশ্বাস, যার শিক্ষার প্রতিষ্ঠা ছিল ছিল নূহ বা মহানু, বা মনুর প্রায় সহস্র বছরের সংগ্রামের মূল প্রতিপাদ্য; ২. সেই ইল্হ বা ইলাহ বা একেশ্বরের সৃষ্ট জগতে তারই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে মনুষ্যকুলের ওপর অর্পিত সমগ্র সৃষ্ট জগতের সব সৃষ্টির রক্ষণাবেক্ষণ ও মঙ্গল সাধনের দায়িত্বের ধারণা; ৩. তার জন্য পরিবারের ‘মাথা’ বা ‘রা’স’-রূপ পরিবারপ্রধানদের প্রধানতমের দায়িত্বশীল স্নেহ-প্রেমময় জ্ঞানবৃদ্ধ অভিভাবকের প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে, তাঁর নেতৃত্বে সমগ্র সমাজ ও সৃষ্টির সৃজনশীল, সুশৃঙ্খল কর্মসাধনার ব্যবস্থাপনা; ৪. এসবকে আঁকড়ে ধরে রাখার মূল্যবোধ সমন্বিত ঐতিহ্যের লালন; ৫. অন্তর্দৃষ্টিমূলক বোধ-জাত জ্ঞানসাধনা।
সেমিটিক সভ্যতার সব উপসভ্যতাই হিব্রু, আরব্য, দ্রাবিড়, আফগান—মূল মনুষ্যসভ্যতার নিকটতম ধারক হিসেবে সাধারণত কোনো না কোনো আকারে, কম-বেশি এসব ধারণার আদর্শকে অন্তত আঁকড়ে ধরে রাখে।
আর্য ও হামীয় সভ্যতা
কিন্তু আদি নিবাস থেকে বহু দূরে চলে যাওয়া আর্য ও হামীয়দের সভ্যতায় এসব ধারণার আদর্শে ভাটা পড়ে তাদের নতুনতর নিবাসগুলোর স্থানীয় প্রকৃতির মুখে কঠিন জীবনসংগ্রামে, সে মূল অনেক ক্ষেত্রেই বিস্মৃত হয়ে পড়ে।
তার জায়গা নেয়, য়পতীয় বা আর্যদের ক্ষেত্রে, ইউরোপ, চীন, কাশ্মীর, উত্তর ভারত ও পারস্যের কঠিন শৈত্যপ্রধান নতুনতর আবাসভূমিগুলোতে টিকে থাকার জন্য অতীব আবশ্যক বলে দেখা সূর্যের আর আগুনের তাপের পূজা এবং তার সঙ্গে অন্যান্য জীবনরক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে অপরিহার্য মনে হওয়া অন্যান্য প্রাকৃতিক শক্তি বা বস্তু, বিশেষ করে মহাকাশীয় যা; যেমন আকাশ, বায়ু, গ্রহ-নক্ষত্র, বিজলি ইত্যাদির পূজা-অর্চনা।
আর হামীয়দের ক্ষেত্রে অনুরূপভাবেই একেশ্বরবাদের সে জায়গা নেয়, আফ্রিকা ও দক্ষিণ ভারতের গরম আর বর্ষায় অতিষ্ঠ করা শ্বাপদ ও সরীসৃপ-সংকুল বনবাদাড়-প্রধান নতুনতর আবাসভূমিগুলোয় টিকে থাকার জন্য অতীব আবশ্যক বলে দেখা শীতলতা দানকারী বিশাল বৃক্ষ, রাতের স্নিগ্ধ শীতল চাঁদের চন্দ্রিমা, আর নানা পশুপাখি ও রাক্ষস-খোক্ষস থেকে বেঁচে থাকার আরাধ্য আর বিপদে সম্ভাব্য শ্বাপদ-সরীসৃপের পূজা।
এভাবে মনুষ্যকুলে সামীয়-সেমেটিকরা একেশ্বরবাদী সভ্যতার প্রধান বাহক হিসেবে আবির্ভূত হয়, আর আর্য ও হামীয় সভ্যতাগুলো হয়ে পড়ে বহু-ঈশ্বরবাদী বিশ্বাস ও আচার-আচরণের ধারক-বাহক। মাঝেমধ্যে আর্য বা হামীয়দের নিকটতর এলাকায় বসবাসকারী বা সেখানে ভ্রমণ করা সামীয়-সেমেটিকরাও এসব বহু-ঈশ্বরবাদী বিশ্বাস, বা আচার-আচরণে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এ রকম ভিন্নমুখী ভাবাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত সভ্যতার সংঘাতকাল অনিবার্য হয়ে পড়ে। সে সংঘাতেরই এক নিকট ঐতিহাসিক উদাহরণ হয়ে আবির্ভূত হয় মধ্যপ্রাচ্যের শ্যামল সভ্যতার ভৌগোলিক অগ্রবর্তী ভাগ, হিব্রু জনগোষ্ঠী আর ইউরোপের আর্যদের রোমান সাম্রাজ্যের সংঘাত। এই সংঘাতের একপর্যায়ে খোদ হিব্রু জনগোষ্ঠীর ভেতর অভ্যন্তরীণ অন্তর্দ্বন্দ্বে শ্যামল-সেমিটিক সভ্যতার সংস্কৃত-পুনর্বাসিত মূলসুর প্রকাশক সংস্করণ হিসেবে খ্রিষ্টধর্মের অভ্যুদয় ও উত্থান হলে রোমক সভ্যতা-সাম্রাজ্যের দখলাধীন দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের সিরিয়া ও তুরস্কে বসবাসকারী আর্যরাও খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে তন্মাধ্যমে শ্যামায়িত—‘সেমেটাইজ্ড’ হয়। কালে তাদের বিস্তারের মাধ্যমে পুরো রোমান সাম্রাজ্যই খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়।
বাহ্যত শ্যামায়িত পাশ্চাত্য সভ্যতা
কিন্তু শ্যামল-সেমিটিক সভ্যতার পুনর্বাসিত রূপ-স্বরূপ খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েও আর্য রোমান সাম্রাজ্য পূর্ণাঙ্গে সেমিটাইজ্ড বা শ্যামায়িত হয় না, কারণ যেসব রাজনৈতিক হিসাব-কেতাবের প্রথম ‘খ্রিষ্টান’ বলে পরিচয় দেওয়া রোমক সম্রাট, ‘সেইন্ট’ ‘কন্সটান্টিন’ খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন, তাতে তাঁর হিব্রুদের মূল খ্রিষ্টধর্মকে গ্রহণের একটি শর্ত ছিল, সেই হিব্রু-সেমিটিক খ্রিষ্টধর্মে গ্রিক-রোমান আর্য ধর্মের অনেক কিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে পরে তা-ই তিনি গ্রহণ করেবেন, আর তাঁর সাম্রাজ্যের সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। এভাবে আর্য ইউরোপ বা রোমান সাম্রাজ্যের মাধ্যমে এমন এক সংকর ‘খ্রিষ্টধর্ম’ প্রতিষ্ঠিত ও প্রচারিত হয়, যা বাহ্যিকভাবে দেখতে-শুনতে সেমিটিক-শ্যামল হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে মৌলিকভাবে তা আর্য সভ্যতারই ধারক-বাহক থেকে যায়। সেভাবে ইউরোপের রোমক সাম্রাজ্য এমন এক সেমিটাইজ্ড আর্য সভ্যতার ধারক-বাহক হিসেবে আবির্ভূত হয়, যা প্রথমে নিরঙ্কুশ আর্য সভ্যতার বাহক পারস্য সভ্যতার—আর পরে ওই আর্য সভ্যতার প্রতিপক্ষ মূল সেমিটিক সভ্যতার নবতর রূপ, আরব্য সভ্যতারও প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে সক্রিয় হয় ।
ওপরে বর্ণিত কারণগুলোর ফলে কালের প্রবাহে ইউরোপীয় সভ্যতার কিছু মৌলিক বিষয় আবির্ভূত হয় এবং মোটামুটি থেকে যায় দীর্ঘকাল—কয়েকটি অপরিহার্য ধারণা। সেগুলো হলো—১. বহুত্ববাদ; ২. প্রকৃতিকে জয় করে নিজস্ব বস্তুগত উন্নয়নের ভবিষ্যৎমুখী অগ্রযাত্রা; ৩. শক্তির ভক্তি ও শক্তিবৃদ্ধির সাধনা; ৪. পঞ্চেন্দ্রিয়ের সমীক্ষায় অনুভবযোগ্যকে মাত্র সত্য বলে গ্রহণের প্রবণতা; ৫. পঞ্চেন্দ্রিয়ের সমীক্ষায় অনুভবযোগ্যতা-ভিত্তিক (empirical) প্রামাণ্যের আলোকে যুক্তিনির্ভর জ্ঞানসাধনা।
শ্যামায়িত আর্য পারস্য সভ্যতা
তার কিছু পরেই একপর্যায়ে সেমিটিক-আরব্য সভ্যতার সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত আর্য-পারস্য সভ্যতা সেমিটিক সভ্যতার নবতম প্রকাশ, ইসলামে দীক্ষার মাধ্যমে সেমিটাইজ্ড-শ্যামায়িত হয়ে সেমিটিক-আরব্য উপসভ্যতার সঙ্গে একাকার হয়ে সেমিটিক-শ্যামল সভ্যতার প্রতিষ্ঠা, প্রসার ও প্রচারে সক্রিয় হয়। অল্প পরেই চৈনিক-আর্য উপসভ্যতার একাংশ ‘তুর্কি’রাও আর্য-পারস্যদের মতোই ইসলামে দীক্ষার মাধ্যমে সেমিটাইজ্ড-শ্যামায়িত হয়ে সেমিটিক-আরব্য উপসভ্যতার সঙ্গে একাকার হয়ে সেমিটিক-শ্যামল সভ্যতার প্রতিষ্ঠা, প্রসার ও প্রচারে সক্রিয় হয়। আবার তুর্কিদেরই ক্ষুদ্রতর একাংশ মধ্য এশিয়ার ‘খাজার’ সাম্রাজ্য একসময় সেমিটিক-হিব্রু উপসভ্যতার প্রভাবে সেমিটাইজ্ড হয়, কিন্তু নানা ঐতিহাসিক কারণে তারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে সেখানে মিশে গিয়ে ইউরোপীয় সেমিটাইজ্ড আর্যদের প্রভাবে, তাদের মতোই প্রধানত আর্য রোমক-সভ্যতারই ধারক-বাহকই হয়ে ওঠে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাদের একাংশ মধ্যপ্রাচ্যের পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যের ছত্রছায়ায় অঞ্চলের উপকূলীয় এক ক্ষুদ্রাঞ্চলে বসতি স্থাপন করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতা-সাম্রাজ্যের প্রস্থানের পরেও থেকে যায়। যে স্থানীয় মূল সেমেটিক হিব্রুরা, যারা কয়েক হাজার বছর ধরে আদি খ্রিষ্টীয় সেমিটিক-হিব্রুদের খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে খ্রিষ্টান হয়ে গিয়ে আরব্য-শ্যামলদের ধর্ম গ্রহণ করে তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদেরই অংশ হয়ে গিয়েছিল; আর তাদের যে অত্যল্পসংখ্যক স্বকীয় সেমিটিক-হিব্রুই থেকে গিয়েছিল, তারাও মধ্যপ্রাচ্য, পারস্য, ভারত, মরক্কো, এমনকি সুদূর চীনসহ এশিয়া ও আফ্রিকার দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে তাদের পরিচয় ও সভ্যতার ধারক হিসেবে নিজেদের উপস্থাপিত করে। তা সত্ত্বেও তারা একই সঙ্গে পাশ্চাত্য সভ্যতারই ধারক-বাহক হিসেবে পাশ্চাত্য সভ্যতার ধারক ও অংশই থেকে যায়।
এত সব সংকরায়ণের ভেতর দিয়ে এমন এক জটিল সমীকরণের উদ্ভব হয়, যেখানে একদিকে সেমিটিক জনসংখ্যার প্রাণতম সেমিটিক-আরবের সঙ্গে সেমিটাইজ্ড আর্য পারস্য সাম্রাজ্য আর সেমিটাইজ্ড আর্য তুর্কি উপসভ্যতা মিলে সেমিটিক সভ্যতার সম্মিলিত মোর্চা—আর অন্যদিকে সেমিটাইজ্ড আর্য ইউরোপীয় পাশ্চাত্য, ডিসেমিটাইজ্ড বস্তুবাদী আর্য ইউরোপীয় পাশ্চাত্য, আর আর্যায়িত সেমিটাইজ্ড তুর্কি-খাজার উপসভ্যতার সম্মিলিত মোর্চার এক সংঘাতের উদ্ভব হয় অতিসাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোয়।
আধুনিক প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান সভ্যতা সংঘাত হিসাবে পরিষ্কারভাবেই উপস্থিত হয়, সাক্ষাৎ ওপরে বর্ণিত ‘জটিল সমীকরণ’ মতে উদ্ভূত দুই ‘মোর্চা’র এমন এক সংঘাত, যা প্রাচীন রোমক ও পারস্য সভ্যতার সংঘাতেরই নবতর আধুনিক সংস্করণ। এই নবরূপে রোমক-পারস্য সভ্যতা সংঘাতে একদিকে আছে প্রধানত গৌরবময় পরিজ্ঞাত ইতিহাসের অতীতমুখী ঐতিহ্যবাদী প্রাচ্য সভ্যতার প্রধান মুখপাত্র রূপে আত্মোস্থাপনাকারী নতুন নামে ডাকা প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্য এবং তার বিভিন্ন স্থানীয় মিত্র বা করদ, যথা ইয়েমেন, ইরাক ইত্যাদি। আর এ সংঘাতে অন্যদিকে আছে ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী অজ্ঞাত সম্ভাবনার ভবিষ্যৎমুখী বস্তুবাদী প্রতীচ্য সভ্যতার প্রধান মুখপাত্র রূপে আত্ম-উপস্থাপিত নতুন নামে ডাকা প্রাচীন রোমক সাম্রাজ্যের নবতম রূপ, প্রধানত সাগর ও আকাশপথে উপস্থিত, ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য শক্তি জোট এবং তার বিভিন্ন স্থানীয় মিত্র, করদ বা উপনিবেশ, যথা মধ্যপ্রাচ্যের সাগরতীরবর্তী ছোট ছোট জনসংখ্যার কিছু রাজ্য বা রাষ্ট্র।
এই দুই আন্তর্জাতিক মোর্চার সংঘাতে সেসবই আছে, যা প্রাচীন রোমক ও পারস্য সভ্যতার সংঘাতে ছিল। থেমে থেমে সাক্ষাৎ যুদ্ধ, দুপক্ষেরই প্রতিপক্ষকে বিশাল গোয়েন্দা কার্যক্রমের জালে জড়িয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা, ঠান্ডা লড়াই, শক্তির ভারসাম্যহীনতায় টালমাটাল পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার সার্বক্ষণিক চেষ্টা, আর কূটনৈতিক চালে একে অন্যকে প্রতারিত বা বিপর্যস্ত করার চলমান প্রচেষ্টা। এই সংঘাতের সাক্ষাৎ ছোট-বড় অংশীদের নাম, বর্ণ, পরিচয় প্রভৃতি বদলাতে থাকলেও তার প্রধান এই দিকগুলো বিরাজমানই থাকে—যেমনটি, তার দুপক্ষের আদর্শিক গতিমুখের অপরিহার্য বিষয়বস্তু।
উপসংহার : আশা
যেমনটি সূচনার দিকে বলেছি, সভার মাধ্যমে পারস্পরিক সমস্যা সমাধানে সক্ষমতাই সভ্যতা—এই সক্ষমতা হারানোর ফলই হয় সংঘাত, আর এই সংঘাতই সভ্যতা ভেঙে পড়ার সূচনা, আর সামরিক যুদ্ধ সংঘাতের চূড়ান্ত বৈ নয়। অতীতেও ভিন্ন ভিন্ন যুদ্ধ সূচনা করেই রোমক সাম্রাজ্য ও পারস্য সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়েছিল। সঙ্গে তাদের তৎকালীন সভ্যতাও। যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা অনতিবিলম্বে সুসভ্য আলোচনা সভার মাধ্যমে আন্তরিক ও সততার সঙ্গে নিরসন না করলে আমরা আবারও সভ্যতা ধ্বংসের লক্ষণ দেখছি। আমরা সেরকম ভয়ংকর পরিণতি না ঘটারই আশা করি। ব্যাপকতর মানবসভ্যতায় পারস্য এবং পাশ্চাত্য উভয় সভ্যতা অনেক মহৎ অবদান রেখেছে—এরূপ মহত্ত্বের পুনরাভিষেকই এখন কাম্য, যার মাধ্যমে সব অন্যায়ের প্রতিকার হোক।
লেখক : হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক কেন্দ্র এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের সাবেক শিক্ষক। মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ ও বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা আন্দোলন-সমর্থক