মধ্যপ্রাচ্যে উত্তাপ কি আরও বাড়ছে
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির উত্তাপ এবার কতটা ছড়াবে তা নির্ধারণ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। সিনওয়ারের মৃত্যুর পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক জটিলতা, আরব বিশ্বের ঐক্য এবং মিসরের সামরিক শক্তির পুনরুত্থান ইসরায়েলের জন্য বিপদের শঙ্কা তৈরি করছে। হামাসের প্রধান নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হওয়ার পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘গাজায় যুদ্ধ শেষ হয়নি। এটি কেবল শেষের শুরু।’ নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমাদের সামনে এখনও অনেক পথ বাকি। যুদ্ধ চলবে যতক্ষণ পর্যন্ত হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত না হয়।’ তবে তার এই কথার জবাব গতকাল শুক্রবার হামাস দিয়েছে। হামাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি ও স্থল অভিযান বন্ধ না হবে তত দিন পর্যন্ত জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে না।’

নেতানিয়াহু ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, আমাদের সামনে সুযোগ রয়েছে ‘অক্ষশক্তি’কে থামিয়ে এক ভিন্ন ভবিষ্যৎ নির্মাণ করার। অক্ষশক্তি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানপন্থি বিভিন্ন মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে উল্লেখ করেছেন তিনি। অর্থাৎ সরাসরি এখনও তিনি ইরানের সঙ্গে লড়াইয়ের হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছেন। তবে ইরান এ মুহূর্তে ইসরায়েলকে সরাসরি কোনো হুঁশিয়ারি দেয়নি। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হামাসের প্রধান নেতাকে হত্যা করার জন্য তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। দেশটির বার্তা সংস্থার বরাত দিয়ে মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলকে অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ শুরু হলে এর দায় যুক্তরাষ্ট্রকে নিতে হবে।
আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামাসের প্রধান নেতা নিহত হওয়ায় ইরান কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেবে এমনটি বলা যাচ্ছে না। কারণ হামাসকে তারা সহযোগী হিসেবে দাবি করলেও মুক্তিকামী সংগঠনটি ইরানের প্রক্সি নয়। ফলে ইরান এই মুহূর্তে কোনো পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করা যাচ্ছে না। তবে তেহরান প্রশাসন এ ঘটনায় মর্মাহত হয়েছে তা তাদের একাধিক বিবৃতিতে স্পষ্ট। আপাতত ইরান লোহিত সাগরে হুতিদের অক্ষ ধরে রাখায় ব্যস্ত। এক্ষেত্রে তারা ইসরায়েলের বিষয়ে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেবে। আটলান্টিক কাউন্সিলের এক খবরে বলা হয়েছে, তেহরান হুতিদের উন্নত অস্ত্র সরবরাহ করছে যাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, হুতিদের অ্যান্টি-মিসাইল জাহাজ সরবরাহের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে ইরান যোগাযোগ বাড়িয়েছে। ইরানের বিবৃতি পর্যালোচনা করে আটলান্টিক কাউন্সিল জানায়, অধিকাংশ আরব রাষ্ট্র এখন যুদ্ধবিরতির দাবিই করবে। তারা এই মুহূর্তে সংঘাতে জড়াতে চাইবে না।
লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ এ ঘটনার পর ইসরায়েলের সঙ্গে নতুন যুদ্ধের সূচনার বার্তা দিয়েছে। হিজবুল্লাহর দাবি, তারা প্রথমবারের মতো ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করেছে তারা। এরপরই বিবৃতিটি দিয়েছে হিজবুল্লাহ। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি হিজবুল্লাহর মিত্র হিসেবে পরিচিত। বিবৃতিতে অবশ্য হামাসপ্রধানের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। আপাতত ফিলিস্তিনে হামাসের শক্তি কিছুটা খর্ব হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, মধ্যস্থতাকারী হিসেবে থাকা মিসর এক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ নিতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মিসর এ বিষয়ে মন্তব্য করেনি।
প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভের সেক্রেটারি জেনারেল মুস্তাফা বারঘোতি বলেন, ‘ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আসলে জয়ের একটি প্রতীক চেয়েছিলেন। কিন্তু সিনওয়ার নিহত হওয়ায় তার সব মিথ্যা ধরা পড়েছে। হামাস সাধারণ মানুষের পেছনে লুকিয়ে আছে, এ কথাটি একদমই মিথ্যা প্রমাণিত হলো। এমনকি তারা জিম্মিদের সঙ্গে লুকিয়ে আছেনÑ এ কথাও মিথ্যা প্রমাণিত হলো। নেতানিয়াহুর ব্যর্থতা পশ্চিমা বিশ্ব এখনও বুঝতে পারেনি।’ কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ অন্যান্য নেতা সিনওয়ারের মৃত্যুকে সংঘাতের অবসানের একটি সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন। যুক্তরাষ্ট্র এখন যুদ্ধবিরতির আলোচনার পুনরুজ্জীবন এবং আটক জিম্মিদের মুক্তির লক্ষ্যে কাজ শুরুর করার কথা জানিয়েছে। তবে হামাসের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কাজটি আরও কঠিন হয়ে পড়বে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জানান, সিনওয়ার যুদ্ধবিরতির আলোচনায় রাজি হচ্ছিলেন না এবং তার মৃত্যুর ফলে সেই প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে সিনওয়ারের স্থলাভিষিক্ত নেতা যুদ্ধবিরতির জন্য রাজি হবেন। লেবাননে কর্মরত এক সিনিয়র কূটনীতিক রয়টার্সকে বলেছেন, আমরা আশা করেছিলাম যে সিনওয়ারের মৃত্যুর পর যুদ্ধ শেষ হবে। তবে আবারও আমাদের ভুল প্রমাণিত হতে হলো।
কিন্তু সংকট এখানেই শেষ হয়নি। হামাসের অন্তর্বর্তী সময়ে দায়িত্ব নিয়েছেন বিদেশে হামাসের অফিসের প্রধান খালেদ মেশাল। হামাস নেতৃত্ব তুর্কি, কাতারি ও মিসরীয় কর্মকর্তাদের তেল আল-সুলতানে একটি অপারেশনে সিনওয়ারের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে এবং জোর দিয়েছে যে তার মৃত্যুর পরে বন্দিদের বিনিময় এবং যুদ্ধ শেষ করার বিষয়ে আলোচনা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠবে।
মিডল ইস্ট কাউন্সিল অন ফরেইন অ্যাফেয়ার্সের গবেষক মিল্টন এডওয়ার্ডস জানান, হামাস তাদের নেতৃত্বের বিষয়ে একটি স্পষ্ট সিদ্ধান্তেও আসতে পেরেছে। তারা সম্ভবত প্যারালাল নেতৃত্ব গড়ে তুলেছে। এই কাঠামোর নেতৃত্বে অধিকাংশ নীতিনির্ধারকের পরিচয় ও কার্যক্রম থাকে গোপন। এই গবেষকের অনুমান, হামাস শিগগিরই ধ্বংস হচ্ছে না। বরং ভবিষ্যতে দুজন প্রধান দেখা যেতে পারে। ইতোমধ্যে ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগারে তাদের জ্যেষ্ঠ কর্মীরা বন্দি থাকলেও হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। তিনি এ-ও জানান, ১৯৮৭ সালে ইন্তিফাদার সময়েও হামাস এ ধরনের সংকটের মুখে পড়েছিল। কিন্তু তারা সমান্তরালে দুজন প্রধানের ভিত্তিতে কাজ করায় আজও টিকে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিতে এখনও মনে হচ্ছে ইসরায়েল অভিযান চালিয়ে যাবে। হামাস ও হিজবুল্লাহর প্রধানদের হত্যা করার পর এবার সম্ভবত হুতিদের নিশানা করবে তারা। আর এ বিষয় নিয়েই ইরান শঙ্কিত।
সূত্র : আলজাজিরা