মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ১২ দিনের যুদ্ধ
ড. ফরিদুল আলম [সূত্র : ইত্তেফাক, ২৮ জুন ২০২৫]

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় হলো-'১২ দিনের যুদ্ধ'। যুদ্ধটি শুরু করার কেন প্রয়োজন দেখা দিল এবং ১২ দিনের মাথায় কেনই-বা এই যুদ্ধটি শেষ হয়ে গেল, সেসব বিস্তারিত গবেষণার দাবি রাখে। এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে. আগামী দিনের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই যুদ্ধের একটি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা থাকবে। আপাতত এই যুদ্ধের অবসানের পর এর সঙ্গে জড়িত পক্ষগুলোর সবাই এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে বলে দাবি করছে। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে সমসাময়িক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণ আমাদের অবশ্য অন্য কিছু ভাবতে প্ররোচিত করে। এই ভাবনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে পরাজিত শক্তি পরাজিত হলেও তারা নতুন শক্তি নিয়ে পুরোনো পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে। গত আড়াই বছরাধিককাল ধরে চলমান ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যকার যুদ্ধ এ ধরনের পুরোনো জিঘাংসারই ফল।
ইরানের অভ্যন্তরে এমন একটা সময় ইসরাইল হামলা করে বসে, যখন দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ৫ম দফা আলোচনা শেষ করে ৬ষ্ঠ দফা আলচনার জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। এই হামলার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরাইলের প্রতি নিন্দা না জানিয়ে বরং সাধুবাদ জানানো হয়েছে এবং ইরানের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পরমাণু বিজ্ঞানী এবং সেনা কমান্ডার হত্যা এবং সামরিক অবকাঠামোর ক্ষতিসাধনের জন্য ইসরাইলের প্রতি অভিনন্দন জানানো হয়, যার মধ্য দিয়ে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আলোচনা নয় বা আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান নয়, ইরানের ডানা ছেঁটে ফেলা, যেন পরমাণু কর্মসূচি তথা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের পথ থেকে সরে এসে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে না পারে, যা ইসরাইলের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ, প্রকারান্তরে মধপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য দীর্ঘ কাঙ্ক্ষিত। ইরানের এ ধরনের ক্ষতির পর ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে, পালটা যুদ্ধ করার মতো মনোবল তারা হারিয়ে ফেলেছে। বাস্তবে ঘটল তার উলটো। ইসরাইলের শক্তিশালী প্রতিরক্ষাকে ভেদ করে ইরানের মিসাইল সিস্টেমও অনেকগুলো অভীষ্ট লক্ষ্যে আঘাত করে। ছোট এই দেশটির অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতির একপর্যায়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দেনদরবার করতে শুরু করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের দরবারে, ইরানের ওপর পালটা আঘাত করে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি সাধন করে যুদ্ধবিরতিতে আসতে। এর আগে তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ইরানের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে তাদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে হত্যা করার ঘোষণা দিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র অবশেষে ইসরাইলের মেনে তাদের অত্যাধুনিক বি-২ বোমারু বিমান দিয়ে আঘাত হানে ইরানের তিনটি এই ১২ দিনের যুদ্ধে ইরানের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা অনেক। তবে স্বয়ং ইসরাইলের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়েছে যে, ইরান আগামী দুই বছরের মধ্যে তার পরমাণু কর্মসূচিতে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে সক্ষম হবে। ইরানের পক্ষ থেকে হয়তো দাবি করা হবে যে, এটা আসলে তেমন কিছুই নয়। এটাই যদি হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য শঙ্কাটা তো থেকেই গেল!
পারমাণবিক স্থাপনা ইস্পাহান, নেতাঞ্জ এবং ফোরদোতে। এই হামলায় ইরানের পরমাণু কাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে বলে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর তথ্য, ইরান তার পরিশুদ্ধ ইউরেনিয়ামগুলো আগে থেকেই অন্যত্র সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা পেন্টাগনের পক্ষ থকে যখন এ ধরনের গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং সব গোপনীয়তা ছাপিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ বিভিন্ন গণমাধমে এটা প্রকাশ এবং প্রচার হতে শুরু করে, ট্রাম্প এসব অস্বীকার করলেও গত ২৬ জুন ন্যাটোর সম্মেলনে একপর্যায়ে স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, ইরানে ক্ষয়ক্ষতির বিষয় নিয়ে তিনি সন্দিহান। একই কথা বলেন তার প্রতিরক্ষামন্ত্রীও। উভয়েই পরে আবার তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে ইরানে তাদের হামলা সফল হয়েছে বলে দাবি করতে থাকেন।
আমরা জানি দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের অভ্যন্তরে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তার ডানপন্থি শরিক ওপর থেকেও কয়েকটি শরিক ইতিমধ্যে সমর্থন প্রত্যাহার করেছে, যা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, অতিসত্বর পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে তিনি পরাজিত হবেন। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন এবং ইসরাইলের স্বার্থকে নির্বিঘ্ন করতে তাদের ইরান ফোবিয়া থেকে মুক্ত হতে হবে-এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে বিষয়টি নিয়ে নেতানিয়াহু যেভাবে কাজ করতে আগ্রহী, অন্তত তার পতনশীল অবস্থাকে সামাল দেওয়ার স্বার্থে, পরবর্তী সরকার এসে এ নিয়ে এতটা কঠোর না হয়ে যদি শান্তিপূর্ণ বিরোধ নিষ্পত্তির প্রচেষ্টাকে বেছে নেন, তাহলে ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের ইরান আক্রমণের আকাঙ্ক্ষায় জল ঢেলে দেওয়ার মতো অবস্থা হবে। আর তাই নেতানিয়াহুর এই প্রচেষ্টায় সমর্থন দিতে দেরি করেননি ট্রাম্প। বি-২ বোমারু বিমান দিয়ে হামলা করলেন এবং সফল হামলা পরিচালিত হয়েছে বলে দাবি করলেন।
এর পরপরই কাতার এবং ইরাকে মার্কিন ঘাঁটি উদ্দেশ করে হামলা করে বসে ইরান। এ ধরনের হামলা মধ্যপ্রাচ্যের অপর মার্কিন ঘাটিগুলোতেও হতে পারে, যা ইরানের সহজ লক্ষ্যবস্তু। এরপর ট্রাম্প তড়িঘড়ি করে যুদ্ধবিরতির ডাকে দেন। তাহলে দাঁড়াল? এই যুদ্ধ কীভাবে ইসরাইল বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তারা উভয়েই জয় দাবি করতে পারে! অন্যদিকে ইরান এই যুদ্ধে আগে থেকে জড়ায়নি, কেবল আত্মরক্ষার স্বার্থে পালটা আক্রমণ করেছে এবং এটাও বলেছে যে, তাদের ওপর আক্রমণ বন্ধ হলে তারাও আক্রমণ বন্ধ করবে। হলোও তাই। অথচ ডোনাল্ড ট্রাম্প একপর্যায়ে ইরানকে নিঃশর্ত 'আত্মসমর্পণ' করতে বলেছিলেন। যুদ্ধবিরতির ডাক দিয়ে তো প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলই আত্মসমর্পণ করল।
তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে-ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র এই দুই শক্তির সঙ্গে ইরানকে একা যুদ্ধ করতে হয়েছে। এ কথা সত্য যে, এই ১২ দিনের যুদ্ধে ইরানের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা অনেক। তবে স্বয়ং ইসরাইলের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়েছে যে, ইরান আগামী দুই বছরের মধ্যে তার পরমাণু কর্মসূচিতে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে সক্ষম হবে। ইরানের পক্ষ থেকে হয়তো দাবি করা হবে যে, এটা আসলে তেমন কিছুই নয়।
এটাই যদি হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য শঙ্কাটা তো থেকেই গেল! তাহলে কি এটা দাঁড়ায় না যে এমন পরিস্থিতির অবতারণা ঘটলে আবারও ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সংঘাত হবে? এই প্রশ্নের উত্তর 'হ্যাঁ' এবং 'না' উভয়ভাবেই দেওয়া যায়। ফিলিস্তিন সংকটকে ইসরাইল যেভাবে পুরোপুরি এলোমেলো করে ফেলেছে, সেই সঙ্গে ইরানের প্রক্সি হুতি এবং হিজবুল্লাহকে দমনের নামে তাদের ওপরও যেভাবে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হয়েছে, এর থেকে বের করে আনতে হলে কেবল গাজা বা গোটা ফিলিস্তিন নয়, লেবানন, ইয়েমেন, ইরানসহ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে দৃঢ় আপসের প্রয়োজন রয়েছে। খুব বেশি নয়, ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধানের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হওয়া আলোচনাই অপরাপর সমস্ত সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় নিশ্চয়তা হতে পারে। মনে রাখতে হবে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিষয়টি রাশিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত। ভবিষ্যতেও যদি এটিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের তরফ থেকে একমাত্র টার্গেট করা হয়, তাহলে পরিস্থিতি সুখকর হবে না।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়