কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

মহাকাশ ভ্রমণের একাল সেকাল

অনিন্দ্য নাহার হাবীব । সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০৭ জানুয়ারি ২০২৫

মহাকাশ ভ্রমণের একাল সেকাল

প্রাচীনকালে কোনো এক তারাভরা রাতের আকাশে তাকিয়ে প্রথম মানুষেরা যখন প্রথম প্রশ্ন তুলেছিল ‘ওখানে কী আছে?’সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল আমাদের মহাকাশ অভিযানের স্বপ্ন। আজ, আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ পেয়েছে। এ নিয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব

 

মানুষ আজ পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে মহাকাশে যায়। সে, চেষ্টা করে পৃথিবীর বাইরেও নিজের একটি বাসস্থান খুঁজে নেওয়ার। মানুষ শুধুমাত্র আকাশের দিকে তাকিয়ে, মহাবিশ্বের রহস্যময়তার ব্যাপারে ভাবনায় মগ্ন থাকার জন্য একটি নিরুপায় সভ্যতা নয়। মানুষের প্রযুক্তি তাকে মহাবিশ্বকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ দিয়েছে। মহাকাশকে জানার জন্য তৈরি করছে হাজার হাজার স্যাটেলাইট, উৎক্ষেপণ করছে মানুষবাহী ও স্বয়ংক্রিয় মহাকাশযান, প্রস্তুত করছে প্রচ- শক্তিশালী টেলিস্কোপ। তবে মহাকাশ আবিষ্কারের শুরু বেশিদিন আগে নয়; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়।

 

যুদ্ধ থেকে মহাকাশে যাত্রা
এই মহাকাশ অভিযানের অপ্রত্যাশিত সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪২ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্রান্তিলগ্নে। সেই সময় জার্মানির বিজ্ঞানীরা একটি বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করেছিলেন ভি-২ (Vengeance Weapon 2 ২) ব্যালিস্টিক মিসাইল। এটি প্রথম সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়, যা সেই যুগে যুদ্ধের পটভূমি পুরোপুরি পাল্টে দেয়। যুদ্ধকালে মোট ১,১০০টিরও বেশি ভি-২ মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়, যার কারণে প্রায় ৫,০০০ মানুষ মারা যায়। এই অস্ত্র মানবজাতির জন্য ধ্বংস ডেকে এনেছিল তবে যুদ্ধ শেষে, এই মিসাইল প্রযুক্তি মহাকাশ অভিযানের নতুন দিক উন্মোচন করেছিল।

 


যুদ্ধের পর মহাকাশে নজর


১৯৪৫ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জার্মানি পরাজিত হলে, যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মান বিজ্ঞানী এবং তাদের রকেট প্রযুক্তি নিজেদের কাজে লাগায়। যুদ্ধের এই ভয়াবহ আবিষ্কারকে তারা অন্য এক মহৎ উদ্দেশ্যে কাজে লাগায় আমাদের গ্রহের বাইরের বিশ্ব অন্বেষণের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শুরু হয় আরেকটি সংঘাত, যা প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে চলতে থাকে। এই সময়ের নামই হলো ‘শীতল যুদ্ধ’ (Cold War)। যদিও এটি সরাসরি যুদ্ধ নয়, এই দ্বন্দ্বের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় মহাকাশ। মহাকাশ ছিল একটি সম্পূর্ণ নতুন সীমান্ত একটি স্থান যা মানুষের উপস্থিতির বাইরে।

 

স্পেস রেস

‘স্পেস রেস’ বা মহাকাশ প্রতিযোগিতা শীতল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটেই শুরু হয়। এটি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার একটি শান্তিপূর্ণ কিন্তু তীব্র প্রতিযোগিতা। প্রথম দিকে, সোভিয়েতরা এই দৌড়ে এগিয়ে ছিল। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর, সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম কৃত্রিম স্যাটেলাইট স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণ করে। এই ঐতিহাসিক ঘটনার মাধ্যমে মহাকাশ যুগের সূচনা ঘটে। এর মাত্র চার বছর পর, ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল, সোভিয়েত নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন প্রথমবার মানুষের তৈরি যানবাহনে চড়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন। তার যান ভস্টক-১ পৃথিবীর কক্ষপথে ১০৮ মিনিট সময় অতিবাহিত করে। সেই সময় তার অবস্থান ছিল পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে ৩২৭ কিলোমিটার ওপরে। গ্যাগারিনের এই ঐতিহাসিক সাফল্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।

 

চাঁদে মানুষের পদচিহ্ন

গ্যাগারিনের সাফল্যের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়। প্রথমত, ১৯৫৮ সালে তারা ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NASA) প্রতিষ্ঠা করে। এরপর, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি আরও বড় একটি লক্ষ্য স্থির করেন তিনি ঘোষণা করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দশকের মধ্যেই মানুষকে চাঁদে পাঠাবে এবং নিরাপদে ফিরিয়ে আনবে। এই উচ্চাভিলাষী ঘোষণার পরপরই শুরু হয় অ্যাপোলো মিশন। যদিও এর শুরুটা ছিল বেশ কঠিন।

 

চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে এক মহৎ সাফল্য

১৯৬৭ সালে অ্যাপোলো ১-এর একটি ট্র্যাজেডি ঘটে। একটি মহাকাশযান প্রস্তুতির সময় আগুন লেগে যায় এবং তিনজন নভোচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এই ঘটনার কারণে কিছু সময়ের জন্য মিশন স্থগিত রাখতে হয়। এরপর অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই, ইতিহাস সৃষ্টি হয়। অ্যাপোলো ১১ সফলভাবে চাঁদে অবতরণ করে। নিল আর্মস্ট্রং সেই প্রথম ব্যক্তি যিনি চাঁদের বুকে পা রাখেন এবং তার সেই অমর উক্তি করেন, ‘মানুষের জন্য একটি ছোট পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির জন্য একটি বিশাল অগ্রগতি।’

 

স্পেস স্টেশন ও অন্য গ্রহে নজর

চাঁদে অবতরণের পর সোভিয়েত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একে অপরকে মহাকাশে নতুন করে চ্যালেঞ্জ জানায়। ১৯৭১ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম মহাকাশ স্টেশন স্যালুট ১ স্থাপন করে। ১৯৭৩ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্কাইল্যাব নামক তাদের মহাকাশ স্টেশন চালু করে। এরপর আসে আরও একটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত। ১৯৭৫ সালে আমেরিকান অ্যাপোলো এবং সোভিয়েত সয়ুজ মহাকাশযান একত্রে মহাকাশে প্রথমবারের মতো ডক করে। এটি দুই দেশের দীর্ঘ প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি সমাপ্তি এবং একটি নতুন যুগের সূচনা করে।

 

মহাকাশ বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কার

পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে আমরা অন্য গ্রহ এবং মহাজাগতিক বস্তুগুলো পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করি। ১৯৭৭ সালে, ভয়েজার মিশন (Voyager 1 I Voyager 2) উৎক্ষেপণ করা হয়, যা মহাজাগতিক গবেষণার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ভয়েজার মিশন আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে দূরের গ্রহ, ইউরেনাস এবং নেপচুন সম্পর্কে বিস্ময়কর তথ্য দেয়। তারপর ১৯৯০ সালে, উৎক্ষেপণ করা হয় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। এই টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের কিছু অসাধারণ ছবি ধারণ করে, যেমন পিলারস অফ ক্রিয়েশন, যা আজও মানুষকে মহাকাশের রহস্যময়তা নিয়ে ভাবায়।

বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ

নতুন শতাব্দীতে, বেসরকারি সংস্থা স্পেসএক্স ((SpaceX) মহাকাশ অনুসন্ধানে একটি নতুন বিপ্লব শুরু করে। তারপর আসে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (ঔডঝঞ), যা আমাদের মহাবিশ্বের আরও গভীর রহস্য জানতে সাহায্য করছে। এখন বিজ্ঞানীরা আমাদের পরবর্তী বসতি হিসেবে মঙ্গল গ্রহ নিয়ে গবেষণা করছেন।

ভারতের সাম্প্রতিক মহাকাশ মিশন

১. চন্দ্রযান মিশন : ভারতের চন্দ্রযান কর্মসূচি আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে।

চন্দ্রযান-২ (২০১৯) : এই মিশনের মূল লক্ষ্য ছিল চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের গবেষণা করা। যদিও বিক্রম ল্যান্ডার চাঁদে সফট ল্যান্ডিংয়ে ব্যর্থ হয়েছিল, তবে অরবিটার সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং চাঁদ সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য প্রদান করছে।

চন্দ্রযান-৩ (২০২৩) : চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণ করার মাধ্যমে ভারত এই ঐতিহাসিক কীর্তি অর্জনকারী প্রথম দেশ হয়।

২. মঙ্গলায়ন (মার্স অরবিটার মিশন) : ২০১৩ সালে চালু হওয়া এই মিশন ভারতকে প্রথম এশিয় দেশ হিসেবে মঙ্গলে মহাকাশযান পাঠানোর গৌরব এনে দেয়।

৩. আদিত্য-এল১ মিশন : ২০২৩ সালে লঞ্চ করা এই সূর্য গবেষণা মিশন সূর্যের করোনা, সোলার উইন্ড এবং চৌম্বক ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ভারতের হেলিওফিজিক্স গবেষণায় নতুন অধ্যায় উন্মোচন করেছে।

৪. গগনযান মিশন : গগনযান প্রোগ্রামের মাধ্যমে ভারত তার প্রথম মানব মহাকাশযাত্রার পরিকল্পনা করছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে তিনজন মহাকাশচারীকে পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর প্রাথমিক পরীক্ষাগুলো ইতিমধ্যে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

৫. বাণিজ্যিক মহাকাশ গবেষণা : ভারত ওঘ-ঝচঅঈব এবং স্কাইরুট অ্যারোস্পেসের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মহাকাশ গবেষণায় বাণিজ্যিক উদ্যোগ গ্রহণ করছে। ২০২২ সালে স্কাইরুট IN-SPACe  রকেট উৎক্ষেপণ করে যা ভারতের প্রথম বেসরকারি রকেট ছিল।

৬. ভবিষ্যৎ মিশন : শুক্রযান-১ : শুক্র গ্রহ অন্বেষণের জন্য ভারত একটি মিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। উন্নত স্যাটেলাইট কর্মসূচি যেমন ঘধাওঈ এবং এঝঅঞ সিরিজে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

চীনের সাম্প্রতিক মহাকাশ মিশন

১. চাং’ই প্রোগ্রাম : চীনের চাং’ই কর্মসূচি মহাকাশ গবেষণার অগ্রগতিতে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।

চাং’ই-৪ (২০১৯) : চাঁদের অন্ধকার দিকে প্রথম রোভার অবতরণ করিয়ে চীন বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

 

চাং’ই-৫ (২০২০) : চাঁদের মাটির নমুনা পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে চীন USA এবং USSR--এর পরে এই কৃতিত্ব অর্জনকারী তৃতীয় দেশ হয়ে ওঠে।

২. তিয়ানওয়েন-১: মঙ্গল মিশন : ২০২১ সালে চীনের তিয়ানওয়েন-১ মহাকাশযান মঙ্গলে সফলভাবে অবতরণ করে এবং ঝুরং রোভার মঙ্গলের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এবং আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ শুরু করে।

৩. তিয়াংগং স্পেস স্টেশন : ২০২২ সালে চীন তাদের প্রথম স্থায়ী স্পেস স্টেশন তিয়াংগং সম্পন্ন করে। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) থেকে আলাদা।

৪. মানব মহাকাশ মিশন : চীনের শেনঝো কর্মসূচির আওতায় মানব মহাকাশ অভিযান বৃদ্ধি পাচ্ছে। শেনঝো-১৪ এবং শেনঝো-১৫ মহাকাশচারীরা তিয়াংগং স্পেস স্টেশনে কাজ করছেন।

৫. গ্রহাণু ও গভীর মহাকাশ মিশন : চীনের ঝেংহে মিশন নিকটবর্তী গ্রহাণু থেকে নমুনা সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে এবং তিয়ানওয়েন-২ মিশন আরও উন্নত আন্তঃগ্রহ গবেষণার দিকে মনোযোগী।

৬. ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : ২০৩০-এর দশকের মধ্যে চীন এবং রাশিয়া যৌথভাবে একটি চন্দ্র বেস তৈরি করার পরিকল্পনা করছে। সুপার-হেভি রকেট লং মার্চ ৯ উন্নয়নে কাজ করছে।

 

ভারত বনাম চীন : মূল পার্থক্য ভারতের মিশনগুলো তুলনামূলক কম খরচে সফলভাবে সম্পন্ন হয়। অন্যদিকে, চীন তাদের মহাকাশ গবেষণায় বিশাল বিনিয়োগ করে। ভারতের উদ্যোগ বাণিজ্যিক ও আন্তঃগ্রহ গবেষণার দিকে বেশি মনোযোগী, যেখানে চীন মহাকাশ স্টেশন পরিচালনা এবং মানব মহাকাশ অভিযানের ওপর জোর দিচ্ছে।

 

বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণা

বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণার যাত্রা শুরু হয় বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। ১২ মে, ২০১৮ এটি উৎক্ষেপণ করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে, স্পেসএক্সের ফ্যালকন ৯ রকেটের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মূলত বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ, ব্রডকাস্টিং এবং ইন্টারনেট সার্ভিসকে শক্তিশালী করতে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিযোগাযোগ পরিষেবা বৃদ্ধি করেছে। বিদেশি স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করেছে। দূরবর্তী শিক্ষার প্রচারে এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।