কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতার নতুন যুগ নাকি ঝুঁকি?

ডা. নীল এন টিঙ্কু, নিউ ইয়র্ক থেকে [প্রকাশ : দেশ রূপান্তর, ২৯ মে ২০২৫]

মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতার নতুন যুগ নাকি ঝুঁকি?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘গোল্ডেন ডোম’ মিসাইল প্রতিরক্ষা কর্মসূচি ঘিরে আবারও উত্তাল হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি। প্রায় ১৭৫ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পের লক্ষ্য মহাকাশে অস্ত্র বসিয়ে বিশ্বের যেকোনো দিক থেকে আসা পরমাণু ও সাধারণ ক্ষেপণাস্ত্র মাঝ আকাশেই ধ্বংস করে দেওয়া। ইসরায়েলের বিখ্যাত ‘আয়রন ডোম’ সিস্টেমের অনুপ্রেরণায় এই ‘গোল্ডেন ডোম’ পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন এই প্রকল্প চালু হলে তা মহাকাশে নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা উসকে দেবে এবং আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির মুখে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এই কর্মসূচি একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা জোরদার করবে বলে দাবি করা হচ্ছে, অন্যদিকে মহাকাশের সামরিকীকরণের আশঙ্কাও বাড়িয়ে তুলছে।

 

 

কেন এই ‘গোল্ডেন ডোম’ : ২০২৫ সালের ২০ মে ঘোষণা করা এই প্রকল্প ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন প্রতিরক্ষা নীতির দিকনির্দেশ করছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন, আগামী তিন বছরের মধ্যেই এই মহাকাশভিত্তিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু হবে। প্রথম দফায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং বাকি ১৫০ বিলিয়ন ডলার ধীরে ধীরে যুক্ত হবে একটি বিশাল সামরিক বাজেটের আওতায়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের ‘মহাকাশে আধিপত্য’ প্রতিষ্ঠার নীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে চায়। এই পরিকল্পনায় ট্রাম্প উল্লেখ করেন, পৃথিবীর নিরাপত্তা এখন শুধু স্থল, জল বা আকাশে সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমান হাইপারসনিক অস্ত্র প্রযুক্তি এবং ফ্রাকশনাল অরবিটাল বোম্বার্ডমেন্ট সিস্টেম (ঋঙইঝ) যেমন দ্রুত মহাকাশ অতিক্রম করে, তেমনই প্রচলিত মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ। ফলে মহাকাশেই থাকতে হবে এমন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে আসা আক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম। এই প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইউএস স্পেস ফোর্সের জেনারেল মাইকেল এ. গেটলাইনকে। মূলত চারটি ধাপে কাজ করবে ‘গোল্ডেন ডোম’ ১. প্রি-লঞ্চ (মিসাইল উৎক্ষেপণের আগেই শনাক্ত); ২. লঞ্চ (মিসাইল ছোড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আঘাত); ৩. মিড-কোর্স (মহাকাশের মধ্যপথে ধ্বংস); ৪. ডিসেন্ট (মিসাইল লক্ষ্য বরাবর নামতে শুরু করলে)। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ৪ ধাপের প্রতিরক্ষা পদ্ধতি অত্যাধুনিক হাইপারসনিক ও ফ্রাকশনাল অরবিটাল বোম্বার্ডমেন্ট সিস্টেম প্রতিহত করতে পারবে। এ ছাড়া এটি মহাকাশ থেকে বিভিন্ন উচ্চগতির ড্রোন, রোবোটিক অস্ত্র, এমনকি ছোট স্যাটেলাইট বিস্ফোরকও নির্ধারণ ও ধ্বংস করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

 

গোল্ডেন ডোমের কারিগরি কাঠামো ও সম্ভাব্য সুবিধা : গোল্ডেন ডোমের মূল ধারণা হলো মহাকাশে এক বিশাল স্যাটেলাইট-ইন্টারসেপ্টর নেটওয়ার্ক তৈরি করে, পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে আসা মিসাইল মাঝ আকাশেই ধ্বংস করা। এটি একাধিক ধাপে কাজ করবে। প্রথমত, পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করা হবে হাজার হাজার ক্ষুদ্র কিন্তু অত্যাধুনিক সেন্সর স্যাটেলাইট। এগুলো মিসাইল উৎক্ষেপণের মুহূর্তেই তার সিগনেচার শনাক্ত করবে। এরপর একই কক্ষপথে অবস্থানরত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন লেজার বা কাইনেটিক ইন্টারসেপ্টর স্যাটেলাইট সেই মিসাইলটিকে লক্ষ করে আঘাত হানবে। এই প্রযুক্তি চালু হলে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি অনেকাংশে কমানো যাবে বলে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে। একই সঙ্গে এটি আমেরিকার সামরিক আধিপত্যকে আরও সুদৃঢ় করবে। গোল্ডেন ডোমের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র শুধু ভূমি বা সমুদ্রভিত্তিক নয়, মহাকাশে সামরিক সক্ষমতাও দেখাতে পারবে। এ ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসনের পরিকল্পনায় রয়েছে, গোল্ডেন ডোমের মাধ্যমে মহাকাশ থেকে প্রতিপক্ষ দেশের স্পাই স্যাটেলাইট, হাইপারসনিক অস্ত্র এবং সাইবার ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধ সরঞ্জামও ধ্বংস করার ব্যবস্থা। এমনকি স্যাটেলাইট হাইজ্যাক এবং মিসডিরেক্টেড ডেটা সিগন্যালও প্রতিহত করা যাবে।

 

 

কারিগরি চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা : বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন কিছু বাস্তবায়ন করতে গেলে বিশাল সংখ্যক স্যাটেলাইট দরকার হবে। আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির মতে, মাত্র ১০টি আইসিবিএম ঠেকাতেই প্রয়োজন পড়বে প্রায় ১৬,০০০ মহাকাশ-ইন্টারসেপ্টরের। এই স্কেল বাস্তবে কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এ ছাড়া ইউএস স্পেস ফোর্স, মিসাইল ডিফেন্স এজেন্সি এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা হবে বিশাল চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন অরবিটাল প্লেনে সঠিকভাবে সেন্সর সিস্টেম সাজানো এবং ডেটা শেয়ার করা এই বিশাল নেটওয়ার্ক পরিচালনা করা সহজ কাজ নয়। শুধু তাই নয়, মহাকাশের আবহাওয়া, সৌরঝড়, মহাজাগতিক বিকিরণ ইত্যাদিও এই ইন্টারসেপ্টর সিস্টেমের কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে। এ ছাড়া বিদ্যমান স্পেস ল’ এবং আউটার স্পেস ট্রিটি অনুযায়ী মহাকাশে ধ্বংসাত্মক অস্ত্র স্থাপন নিষিদ্ধ। এই প্রকল্প সেই চুক্তির আওতায় পড়তে পারে এবং আইনগত জটিলতা তৈরি করবে।

 

 

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া : গোল্ডেন ডোম ঘোষণার পরপরই চীন এর কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা বলছে, এই প্রকল্প সরাসরি মহাকাশের ভারসাম্য নষ্ট করবে এবং নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা করবে। চীনের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন ‘এটি স্নায়ুযুদ্ধের যুগের ভয়ংকর স্মৃতি ফিরিয়ে আনবে।’ রাশিয়া তো এক ধাপ এগিয়ে এটিকে ‘মহাকাশে সামরিক সংঘাতের আহ্বান’ বলেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন ‘মস্কোও মহাকাশভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হবে।’ অন্যদিকে কানাডা জানিয়েছে, তারা এই গোল্ডেন ডোম প্রকল্পে অংশ নেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি জানিয়েছেন, এ ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অংশ নেওয়া সময়ের দাবি। একই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য এবং ইসরায়েলও এ প্রকল্পে অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগও বাড়ছে। ১৯৬৭ সালের আউটার স্পেস ট্রিটি অনুযায়ী মহাকাশে কোনো ধরনের ধ্বংসাত্মক অস্ত্র বসানো নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, এটি শুধুই প্রতিরক্ষামূলক, কিন্তু অনেকে বলছেন, এই প্রকল্প সেই চুক্তির আত্মা লঙ্ঘন করবে। পাশাপাশি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই সিস্টেম সহজেই আক্রমণাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

 

 

দেশীয় রাজনীতি ও অর্থনৈতিক হিসাব : যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিরক্ষা কোম্পানি এই প্রকল্পে ইতিমধ্যে আগ্রহ দেখিয়েছে। এল-থ্রি হ্যারিস, স্পেসএক্স, প্যালান্টির, লকহিড মার্টি এরা সরাসরি যুক্ত হতে পারে বলে খবর। এই প্রজেক্ট থেকে এসব কোম্পানি কয়েকশ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রিপাবলিকান সিনেটররা ১৯.৫ বিলিয়ন ডলারের একটা বিল ইতিমধ্যেই এনেছেন। তবে বাজেট নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। অনেকে বলছে, বিশাল অংকের এই প্রকল্পে আগামী ২০ বছরে খরচ হতে পারে ১৬১ বিলিয়ন থেকে ৫৪২ বিলিয়ন ডলার। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন এই টাকা কোথা থেকে আসবে? এবং আদৌ এই গোল্ডেন ডোম জাতীয় নিরাপত্তা বাড়াবে নাকি আরও বিপদ ডেকে আনবে? বিশেষ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং পরিকাঠামো খাতে বাজেট সংকোচনের ফলে সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা।

 

 

অতীত মহাকাশ প্রতিরক্ষা উদ্যোগ ও বর্তমান প্রেক্ষাপট : মহাকাশে অস্ত্র স্থাপনের চিন্তাভাবনা নতুন নয়। ১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান ‘স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘স্টার ওয়ার্স’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকি মোকাবিলায় মহাকাশভিত্তিক লেজার এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল এটি। তবে তা কারিগরি এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে সফল হয়নি। গোল্ডেন ডোম সে পরিকল্পনার আধুনিক রূপ। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন চীন, রাশিয়া, ভারত, এমনকি ইরান পর্যন্ত নিজেদের মহাকাশ প্রযুক্তি এবং সামরিক সক্ষমতা বাড়িয়েছে। ফলে মহাকাশে আধিপত্যের লড়াই আরও তীব্র।

 

 

শেষ কথা : ট্রাম্পের গোল্ডেন ডোম নিঃসন্দেহে এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। মহাকাশভিত্তিক এই মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু হলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এর কারিগরি এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতা কতটা সম্ভব? এবং আন্তর্জাতিক আইন বা মহাকাশের ভবিষ্যৎ কি তাহলে আবার অস্ত্রের দখলে চলে যাবে? বিশ্ব যখন শান্তিপূর্ণ মহাকাশ ব্যবহারের স্বপ্ন দেখছে, তখন এই পরিকল্পনা এক নতুন মহাকাশ যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। অবশেষে দেখা যাক ভবিষ্যৎ মহাকাশ যুদ্ধের প্রথম সিস্টেম হিসেবে গোল্ডেন ডোম আসলেই কার্যকর হয় কি না, নাকি স্টার ওয়ার্সের মতো ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়।

লেখক: চিকিৎসক ও কলাম লেখক