কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

মিসাইল কূটনীতি ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা

ড. সুজিত কুমার দত্ত । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০৭ জানুয়ারি ২০২৫

মিসাইল কূটনীতি ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা

মিসাইল কূটনীতি আধুনিক আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত অধ্যায়। এই কৌশল মূলত সামরিক শক্তি প্রদর্শন ও ভৌগোলিক-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানে চীনের মিসাইল স্থাপন এবং ফিলিপিন্সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসাইল মোতায়েন এই কূটনীতির উদাহরণ। চীনের লক্ষ্য হলো পাকিস্তানের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের সামরিক এবং কৌশলগত উপস্থিতি শক্তিশালী করা, যা ভারতের জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।

 

অন্যদিকে ফিলিপিন্সে মার্কিন মিসাইল স্থাপন চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলার প্রচেষ্টা, বিশেষত দক্ষিণ চীন সাগরে। এ ধরনের মিসাইল কূটনীতি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়, যার প্রভাব সরাসরি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এবং অর্থনীতিতে পড়ে। বড় শক্তিগুলোর এই প্রতিযোগিতা ছোট রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের ভৌগোলিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আরো সংকটে ফেলে।

 

মিসাইল কূটনীতি শুধু সামরিক শক্তির প্রদর্শন নয়, বরং এটি রাজনৈতিক এবং কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের একটি অস্ত্র। ফলে এটি শান্তি স্থাপনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তাকে জটিলতর করে তোলে।

 

গত মাসে মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলোর কারণ হিসেবে মিসাইল প্রযুক্তি বিস্তারের আশঙ্কা তুলে ধরা হয়।

 

নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কমপ্লেক্স (এনডিসি), যা পাকিস্তানের মিসাইল এবং পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির কেন্দ্রস্থল। এ ছাড়া নিষেধাজ্ঞার তালিকায় এমন কিছু রহস্যজনক প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো সংবেদনশীল প্রযুক্তি স্থানান্তরের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব নিষেধাজ্ঞা সরাসরি পাকিস্তানকে লক্ষ্যবস্তু করলেও এর প্রভাব চীনের ওপরও পড়বে। কারণ চীন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে জটিল এক ভূ-রাজনৈতিক চিত্র বিদ্যমান।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাকিস্তানের উন্নত মিসাইল প্রযুক্তি, বিশেষ করে দীর্ঘ পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি নতুন হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এনডিসিসহ চারটি পাকিস্তানি সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, পাকিস্তানের এই প্রযুক্তি উন্নয়ন বৈশ্বিক স্থিতিশীলতায় একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। চীন দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা অবকাঠামোতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। পাকিস্তানের মিসাইল এবং পারমাণবিক কর্মসূচির উন্নয়নে চীনের ভূমিকা অনেক সময় স্পষ্ট আবার অনেক সময় আড়ালে থেকে যায়। চীন এই অঞ্চলে তার প্রভাব বজায় রাখতে পাকিস্তানকে একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে ব্যবহার করছে।

 

২০২৪ সালের শুরুতে মার্কিন সেনাবাহিনী ফিলিপিন্সের উত্তরাঞ্চলে একটি মাঝারি পাল্লার মিসাইল সিস্টেম স্থাপন করে। এটি বার্ষিক যৌথ সামরিক মহড়ার অংশ হিসেবে সেখানে নেওয়া হলেও পরে এটি স্থায়ীভাবে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চীন এই পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করে এবং এটিকে এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করে। ফিলিপিন্সের সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল রয় গালিডো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এই মিসাইল সিস্টেমটি অত্যন্ত কার্যকর এবং আমাদের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর চীনের দাবি চ্যালেঞ্জ করার জন্য এটি ব্যবহার করা হতে পারে।

 

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধু পাকিস্তান ও ফিলিপিন্সের মতো দেশগুলোকেই প্রভাবিত করছে না, বরং সমগ্র এশিয়া এবং বিশ্বরাজনীতিকে একটি অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এই প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

 

 

চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই মিসাইল প্রতিযোগিতা নতুন মেরুকরণ তৈরি করছে। একদিকে চীন-পাকিস্তান জোট এবং অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ফিলিপিন্স জোট বিশ্বরাজনীতিতে একটি বিভাজন তৈরি করছে। এই বিভাজন বৈশ্বিক সহযোগিতার পরিবেশকে বিঘ্নিত করছে এবং নতুন সংঘাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। নিরাপত্তার অজুহাতে অস্ত্র প্রতিযোগিতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশগুলো তাদের মিত্র দেশগুলোকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে আরো তীব্র করে তুলবে। এই প্রতিযোগিতা শেষ পর্যন্ত একটি বড় সংঘাতের দিকে ধাবিত হতে পারে।

 

 

বিশ্বব্যাপী মিসাইল কূটনীতির নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে সংলাপ বৃদ্ধি করতে হবে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এই সংলাপকে এগিয়ে নিতে একটি প্ল্যাটফরম তৈরি করতে পারে। আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির আওতায় নতুন মিসাইল প্রযুক্তির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এই চুক্তির মাধ্যমে অস্ত্র প্রতিযোগিতার ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক শান্তি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এসব উদ্যোগ অস্ত্র প্রতিযোগিতার চেয়ে উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করবে।

 

মিসাইল কূটনীতি একটি জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়, যা বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানে চীনা মিসাইল এবং ফিলিপিন্সে মার্কিন মিসাইল স্থাপনের ফলে এশিয়ার নিরাপত্তা পরিবেশ আরো জটিল হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই ঝুঁকি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

লেখক : সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়