কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

মিউনিখ সম্মেলন ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ

ড. সুজিত কুমার দত্ত । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০১ মার্চ ২০২৫

মিউনিখ সম্মেলন ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ

৬১তম মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন (এমএসসি) শুধু একটি আলোচনার মঞ্চ ছিল না, বরং বৈশ্বিক রাজনীতির সংকট ও উত্তরণের একটি জীবন্ত দর্পণ। সম্মেলনের প্রতিটি বক্তব্য, প্রতিটি প্রতিক্রিয়া এবং নীতিগত ঘোষণা বিশ্বব্যাপী চলমান ভূ-রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের দিকে ইঙ্গিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের যুগের অবসান, চীনের উত্থান, ইউরোপের স্বাধীনচেতা নীতির সন্ধান এবং রাশিয়ার ভূমিকা—এই সমস্ত প্রশ্ন মিউনিখের মঞ্চে নতুন মাত্রা পেয়েছে। বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত।

 

 

তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, বিশ্ব এখন এক বহুমেরু শক্তির সমীকরণের দিকে এগোচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে। ২০২৫ সালের ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সের বক্তব্য, ইউরোপীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া এবং ট্রাম্প-পুতিন প্রসঙ্গে আলোচনা বৈশ্বিক শক্তির গতিপথকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার ইঙ্গিত দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের যুগের অবসান, ইউরোপের স্বাধীনতার সন্ধান এবং রাশিয়া-চীনের উত্থান—এসব প্রশ্ন মিউনিখের মঞ্চে ধ্বনিত হয়েছে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স তাঁর ভাষণে মিউনিখ সম্মেলনের আয়োজকদের কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। তাঁর মতে, বাম ও ডান—উভয় ধারার জনপ্রিয়তাবাদী দলগুলোর প্রতিনিধিদের আলোচনা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যা গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির পরিপন্থী। ভ্যান্স জোর দিয়ে বলেন, ‘আমরা কারো কথার সঙ্গে একমত না হতে পারি, কিন্তু যখন কোনো রাজনৈতিক নেতা একটি বড় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন, তখন তাঁদের সঙ্গে সংলাপে বসাটা আমাদের দায়িত্ব।’ এই মন্তব্য ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ, বিরোধী দলের নেতা ফ্রিডরিশ মের্ত্স, ভাইস চ্যান্সেলর রবার্ট হাবেক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক একযোগে ভ্যান্সের বক্তব্যকে ‘অবাস্তব’ ও ‘বিচ্ছিন্নতার রাজনীতি’ বলে আখ্যায়িত করেন।

 

 

এমনকি মধ্যম ডানপন্থী ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টির মারি-অ্যাগনেস স্ট্রাক-জিমারম্যান ভ্যান্সের ভাষণকে ‘বিজড়িত বুদ্ধিবৃত্তিক তল’ বলে বর্ণনা করেন।
মিউনিখ সম্মেলন ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার ভবিষ্যৎশীতল যুদ্ধের পর থেকে গ্লোবাল অর্ডারের কেন্দ্রবিন্দু ছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০২৫ সালের মিউনিখ সম্মেলনে এই ধারণাটি ম্লান হয়ে গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সংঘাত এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রভাব হারাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রতি ট্রাম্প ও বাইডেন প্রশাসনের দোলাচল ইউরোপ ও এশিয়ার মিত্রদের মধ্যে অনাস্থা তৈরি করেছে।

 

 

উদাহরণস্বরূপ, ন্যাটো জোটে ইউরোপীয় দেশগুলোর বর্ধিত সামরিক ব্যয় এবং স্বাধীন প্রতিরক্ষা কৌশল গঠনের উদ্যোগ আমেরিকান নেতৃত্বের প্রতি তাদের সংশয়কেই প্রতিফলিত করে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা হ্রাস পাওয়ার বিপরীতে চীন তার ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে তৎপর। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই), দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ এবং আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় অর্থনৈতিক অংশীদারির মাধ্যমে চীন একটি বিকল্প বিশ্বব্যবস্থার রূপরেখা দিচ্ছে। মিউনিখ সম্মেলনে চীনের প্রতিনিধি লি ঝাওশিংয়ের বক্তব্য ছিল প্রাসঙ্গিক, ‘বহুপক্ষীয়তাবাদই শান্তি ও উন্নয়নের চাবিকাঠি। কোনো একক দেশের আদর্শই বিশ্বের জন্য মানদণ্ড হতে পারে না।’ তবে চীনের এই উত্থান নিয়ে উদ্বেগও কম নয়। তাইওয়ান প্রণালি, হংকং এবং উইঘুর মুসলিমদের বিষয়ে চীনের নীতিকে পশ্চিমা দেশগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে।

 

 

মিউনিখ সম্মেলনের প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি বিতর্কিত প্রস্তাব আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করে। তিনি ঘোষণা দেন যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আবার জি৮ গ্রুপে ফিরিয়ে আনা উচিত। উল্লেখ্য, ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। ট্রাম্পের এই প্রস্তাব পশ্চিমা জোটের মধ্যে নতুন করে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। অনেক ইউরোপীয় নেতা এটিকে রাশিয়ার আগ্রাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন।

 

 

মিউনিখ সম্মেলনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল হলো ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’-এর ঘোষণা। জার্মানি, ফ্রান্স ও পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ ন্যাটোর ছত্রচ্ছায়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে। ইউক্রেন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপ এখন নিজস্ব প্রতিরক্ষা কৌশল গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ এরই মধ্যে ‘ইউরোপীয় সেনাবাহিনী’ গঠনের প্রস্তাব পুনরুজ্জীবিত করেছেন। ট্রাম্প যদি পুতিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেন, তবে ইউরোপে স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে পারে।

 

 

তাদের যুক্তি, পুতিনকে পূর্ব ইউক্রেনের আংশিক নিয়ন্ত্রণ দিয়ে সন্তুষ্ট রাখলে মধ্য ইউরোপে রাশিয়ার হুমকি কমবে। তবে এই ধারণার বিরোধীরা সতর্ক করেছেন যে রাশিয়ার সঙ্গে আপস করলে মস্কোর আগ্রাসন আরো বিস্তৃত হবে। পোল্যান্ড ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো এই দ্বিতীয় মতটিকেই সমর্থন করে। ইউক্রেন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত নীতির কারণে জার্মানি, ফ্রান্স ও পোল্যান্ডের মতো দেশগুলো এখন নিজেদের প্রতিরক্ষাকাঠামো শক্তিশালী করতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইউরোপ কি সত্যি ন্যাটো ছাড়া নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম? বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিন্ন প্রতিরক্ষানীতির অভাব এবং সদস্য দেশগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য এই পথে বড় বাধা।

 

 

মিউনিখ সম্মেলন স্পষ্ট করেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের দিন প্রায় শেষ। চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক উত্থান, রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক চাল এবং ইউরোপের স্বাধীনতাকামী নীতি—এসব শক্তি একটি বহুপক্ষীয় বিশ্বের দিকে ইঙ্গিত করছে। তবে এই রূপান্তর শান্তিপূর্ণ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ, তাইওয়ান প্রণালিতে উত্তেজনা এবং দক্ষিণ চীন সাগরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখিয়ে দিচ্ছে যে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

 

 

মিউনিখ সম্মেলন বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য তিনটি মূল বার্তা দিয়েছে—১. সহযোগিতার অপরিহার্যতা : জলবায়ু পরিবর্তন, সাইবার যুদ্ধ এবং মহামারির মতো আন্তঃসীমান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ২. নমনীয় কূটনীতি : শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে সংলাপের মাধ্যমেই কেবল সংঘাত এড়ানো সম্ভব। ৩. বৈশ্বিক দক্ষিণের ক্ষমতায়ন : উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্তই টেকসই হবে না।

 

 

বিশ্ব আজ একটি ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে। একদিকে বহুপক্ষীয়তাবাদের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ; অন্যদিকে শক্তি প্রতিযোগিতার অন্ধকার গহ্বর। মিউনিখ সম্মেলন আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে এই পথের নির্বাচন শুধু নীতিনির্ধারকদের হাতে নয়, বরং প্রতিটি জাতির সচেতন সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। এই উত্তরণকালে ইউরোপকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণ করতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক জোটে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং এশিয়াকে সংঘাত এড়াতে কূটনৈতিক পথ খুঁজতে হবে। মিউনিখ সম্মেলন যদি আমাদের কিছু শিখিয়ে থাকে, তা হলো বৈশ্বিক নিরাপত্তা এখন কোনো একক দেশের হাতে নেই, বরং এটি সম্মিলিত দায়িত্বের ফল।

 

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়