মিয়ানমারের ওপর ভূরাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে হবে
ড. আমেনা মহসিন । সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ১৯ মার্চ ২০২৫

১৭ মার্চ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফর দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার বাইরে থাকা রোহিঙ্গাসংকট সমাধানের পথ খুলে দেবে। কিন্তু বর্তমানের ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার নিরিখে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার সম্ভাবনা কম। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির দায় দীর্ঘদিন ধরে বহন করছি আমরা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে টানাপড়েন আমাদের রয়েছে এবং তা নিষ্পত্তির গতি ক্ষীণ। আমরা দেখছি, বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের দাবি জানানো সত্ত্বেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে তারা কোনো ভূমিকা রাখছে না। অথচ এ অবস্থায় অভিন্ন মিত্ররা সংকট নিরসনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত। ভূরাজনীতির নানা সমীকরণের হিসাব কষতে গিয়ে আন্তর্জাতিক মহল এ ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। শুধু তাই নয়, পটপরিবর্তনের পর রোহিঙ্গাসংকট অনেকাংশে আলোচনার বাইরে চলে গিয়েছিল। এও সত্য, ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট একটি বা গুটিকয় উপাদান দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা ঠিক হবে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গটি ইতোমধ্যে জটিল আকার ধারণ করেছে এবং অন্যদিকে বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে ভূরাজনৈতিক সংকটের পেছনে অনেক কারণ রয়ে গেছে।
আমরা বলে থাকি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা একটি ঐতিহাসিক ও ভূরাজনৈতিক সমস্যা। তাদের আমরা বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী বলে দাবি করি। তবে শুধু ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরে এ সমস্যার সমাধান আসবে এমন প্রত্যাশা ঠিক নয়। আন্তোনিও গুতেরেস আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রধান হিসেবে মিয়ানমারকে এ সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু নির্দেশনা দিতে পারেন। তাতে শিগগিরই আমরা এ সমস্যার কোনো সমাধান পাব বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। তবে এ সফরের একটি ইতিবাচক দিক, দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার বাইরে থাকা এ সংকটটি আবার সবার নজর পেতে শুরু করেছে। এ সময়ে কূটনৈতিক পদ্ধতিতে মিয়ানমারের ওপর আমাদের চাপ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ বিগত সময়ে বেশিরভাগ রোহিঙ্গাকে নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করতে পারলেও ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা কয়েক দশক ধরে শরণার্থী হিসেবে কক্সবাজারের উখিয়ায় রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে বসবাস করছিল।
২০১৭ সালে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্যও অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ নতুন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি বটে কিন্তু এতসংখ্যক রোহিঙ্গার নিরাপত্তা, আবাসন, খাদ্য নিরাপত্তা থেকে শুরু করে অনেক কিছুরই দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ। বিগত সরকারের সময় আমরা দেখেছি, রোহিঙ্গাদের আবাসন ব্যবস্থাপনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো কাজই করা হয়নি। বিগত সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যাটি দুটি বড় কারণে আরও জটিল একটি জায়গায় চলে গেছে। এর একটি হলো মিয়ানমারে সামরিক ক্যু; এবং দ্বিতীয়টি হলো সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনে আরাকান আর্মির উত্থান। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের ভিন্নতর কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে, যেটি হতে হবে কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত। এ প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলিসংক্রান্ত হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ আরও কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় রাখবেন বলে প্রত্যাশা করা যায়। প্রতিনিয়ত বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক ব্যর্থতা বেশি দেখা গেছে। রোহিঙ্গাসংকট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি বড় সমস্যা হিসেবে উপস্থাপনের কাজটিতেও ব্যর্থ হয়েছি আমরা। বিশেষত মিয়ানমারের ওপর আমরা বস্তুত কোনো চাপ তৈরি করতে পারিনি। পাশের দেশ ভারতের কাছেও সহযোগিতা মেলেনি।
রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি গুরুতর হলেও বিগত সময়ে আমরা একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে পারিনি। পারিনি একটি সামগ্রিক শরণার্থী পলিসি বা জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে। রোহিঙ্গা সমস্যাটা আন্তর্জাতিক পরিসরে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরার কথা বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হয়েছে। যাতে আমরা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘসহ অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তা পেতে পারি। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, রোহিঙ্গা সমস্যা সামনে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের কাজ চলছে। এতসব বিষয় আঙ্গিকভাবে বিশ্লেষণ করলে রোহিঙ্গাসংকট নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তরিকতাকে প্রশংসা করতে হয়। তবে আমাদের মূল কাজ মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি করা। আর এ মুহূর্তে গুতেরেসের সফরের এ বিষয়টির মাধ্যমে কূটনৈতিক চ্যানেলকে একটি সূত্র ধরিয়ে দেওয়া, যাতে রোহিঙ্গাদের জন্য বিদেশি সহায়তা ও ত্রাণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়।
আমরা জানি, মিয়ানমারে চীনের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। পাশাপাশি মিয়ানমারে দেশটির ব্যাপক বিনিয়োগও রয়েছে। চীনের জাতিগত স্বার্থের ভিত্তিতে তাদের মিয়ানমারের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হচ্ছে। শুধু চীনই নয়, মিয়ানমারে জাপান ও সিঙ্গাপুরেরও বিনিয়োগ রয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার বিষয়টি তারা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। এসব বিষয় আমাদের কূটনৈতিক চ্যানেলকে আরও গভীরভাবে আমলে নিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অধিকতর জোরদারভাবে উপস্থাপন করতে হবে। কারণ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা যেন নিশ্চিত হয় এজন্য এসব দেশ তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে। তা ছাড়া মিয়ানমার আসিয়ানভুক্ত দেশ। এ কারণে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ আসতে পারে। আমাদের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিষয়গুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে থাইল্যান্ডেরও সীমান্ত রয়েছে। সেখানেও অনুপ্রবেশ ঘটছে। যদিও থাইল্যান্ড এ বিষয়ে সরব নয় এবং বরাবরই নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু আমাদের জন্য রোহিঙ্গারা জাতীয় সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের কূটনৈতিক চ্যানেলের জন্য এখন একটি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। এ সময় আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করার বিষয়টিতেও বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষত চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও উন্নয়ন করতে হবে। চীনের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক ও নিয়মিত যোগাযোগ ইতিবাচক। কিন্তু এ ইতিবাচকতা কূটনৈতিক সফলতায় রূপ দেওয়ার জন্য কাজ করতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ‘স্ট্যান্ডালোন’ ইস্যু হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। সচরাচর দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় অন্যান্য প্রসঙ্গের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুও জোর দিয়ে উপস্থাপন করা হয়। তবে আমি মনে করি, এ বিষয়টি স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপন করা জরুরি। পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে সভা-সেমিনার এবং আলোচনা ধারাবাহিকভাবে চালাতে হবে। দীর্ঘদিন শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারাও স্বভূমে ফিরতে চায় এবং এটা তাদের অত্যন্ত সঙ্গত দাবি। এ বিষয়টি এখন নতুনভাবে ভিত্তি করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন স্ট্যান্ডালোনভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও ত্বরিৎ করতে এবং নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলো নিয়ে আসিয়ান কিংবা অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে এগোতে হবে। মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি যে বাড়তি উদ্বেগ সৃষ্টি ও সংকট আরও বহুমাত্রিক হয়ে ওঠার আশঙ্কা তৈরি করেছে এ প্রেক্ষাপটে কূটনৈতিক দূরদর্শিতার প্রতিফলন জরুরি। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিবের এ সফরটি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এটি রোহিঙ্গাদের সম্মেলন আয়োজন ও তহবিল গঠনে ভূমিকা রাখবে। জাতিসংঘের তরফ থেকে এটি একটি বড় সফর। বিশ্বে বড় দুটি যুদ্ধ নিয়ে এখনও জল ঘোলা পরিস্থিতি বিরাজমান। বিশেষত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার কারণে গোটা বিশ্ব সেদিকে মনোযোগ দিয়ে রেখেছে। এ সফরের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র, জাতিসংঘের অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্র যাদের শরণার্থীদের বিষয়ে সহানুভূতি থাকে তারা কিছুটা নড়েচড়ে বসবে। কিন্তু আমাদের এ সমস্যা সমাধান করতে হলে অবশ্যই মিয়ানমারের ওপর ভূরাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে হবে। যদি তা না করা যায়, তাহলে এ সফরের মাধ্যমে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তার সুফল আমরা নিতে পারব না।
- কূটনীতি-বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়