মুসলিম বিশ্বের সংকট নিরসনে ওআইসি কতটা কার্যকর
মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৩ জুন ২০২৫]

ইসলামী চেতনার ভিত্তিতে মুসলিম দেশগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য নিজেদের মধ্যে একটি সম্মেলন সংস্থা গঠনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে অনেক আগে থেকে। এই উদ্দেশে ১৯৬৪ সালে কিছু মুসলিম দেশ ও রাষ্ট্রপ্রধানরা সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুতে মিলিত হন এবং এই ঐক্য ও সংহতির ভিত্তি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। এদিকে ১৯৬৯ সালের ২১ আগস্ট মুসলমানদের পবিত্র ঘর মসজিদুল আকসায় ইহুদিরা অগ্নিসংযোগ করলে মুসলিম ঐক্যের বিষয়টি তীব্রভাবে অনুভূত হয়। এই উদ্দেশে ওই বছরের ২২-২৫ সেপ্টেম্বর ২৪টি মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা মরক্কোর রাজধানী রাবাতে একটি শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হন।
বর্তমানে ওআইসির ৫৭টি সদস্য আছে, যার মধ্যে ৫৬টি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র এবং ৪৯টি রাষ্ট্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। পশ্চিম আফ্রিকাসহ বেশ কিছু দেশে যদিও অনেক মুসলিম জনসংখ্যা আছে; কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ নয়। আবার উল্লেখযোগ্য মুসলিম জনসংখ্যাসহ কয়েকটি দেশ, যেমন—রাশিয়া ও থাইল্যান্ড পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে আছে।
ওআইসি পরিচালিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যার একটি বাংলাদেশের গাজীপুরে অবস্থিত ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি)।
১. সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সার্বভৌম ও পৃথক সত্তা নিশ্চিত করা।
২. সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বিজ্ঞান গবেষণাসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহযোগিতা প্রসার করা।
৩. প্রতিটি জাতিসত্তাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং বর্ণবাদকে বিযুক্ত করাসহ যেকোনো ধরনের ঔপনিবেশিকতাবাদকে সমূলে উৎপাটন করা।
৪. আন্তর্জাতিক শান্তি, স্থিতি ও নিরাপত্তার জন্য আইনের ভিত্তিতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৫. পবিত্র স্থাপনাগুলোকে রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেওয়া। ফিলিস্তিনিদের অধিকার পুনরুদ্ধারসহ স্বাধীন ভূখণ্ডের আন্দোলনকে সমর্থন করা।
৬. বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মর্যাদা, স্বাধীন সত্তা এবং জাতীয় অধিকারের আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে সহযোগিতা করা।
৭. সদস্যভুক্ত দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক উত্তরণের পরিপ্রেক্ষিতকে আরো নিরবচ্ছিন্ন করা ছাড়াও অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা।
ইরানে ইসরায়েলের হামলা নিয়ে ৫১তম অধিবেশন
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ২১-২২ জুন ২০২৫ ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) ৫১তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কূটনৈতিক মতে, ইরানের অনুরোধে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। চলমান ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের প্রেক্ষাপটে এই বৈঠক ওআইসির ৫১তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের অধিবেশনের অংশ হিসেবে ইস্তাম্বুলে আয়োজন করা হচ্ছে। বৈঠকে প্রায় ৪০ দেশের কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছেন।
এই বৈঠকে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান বলেছেন, ‘ইসরায়েলের আগ্রাসন ইরানের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তাকে ক্ষুণ্ন করে এবং আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন করে।’
এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতি তীব্র নিন্দাও জানিয়েছেন তিনি।
ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিষদের ৫১তম বৈঠকের উদ্বোধনী অধিবেশনে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিস্তিনিদের প্রতিও তাঁদের অটল সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
বৈঠকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান ইরানের প্রতি সমর্থন জানান। একই সঙ্গে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারকে আঞ্চলিক শান্তির সবচেয়ে বড় বাধা বলে উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে এই হামলাকে বেআইনি ও আগ্রাসী আখ্যায়িত করে এর নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ। এ আগ্রাসনকে আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদ ও ইরানের সার্বভৌমত্বের মারাত্মক লঙ্ঘন উল্লেখ করে ইসরায়েলকে জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে ঢাকা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৫১তম সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এই দাবি জানান। ২১ জুন তিনি সম্মেলনে বক্তব্য দেন।
এসব নিন্দা ও প্রতিবাদ আসলে কতটা কাজে আসবে, তা সময়ই বলে দেবে।
ওআইসি কি কাগুজে বাঘ?
১৯৯০ সালের ৫ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক শেষে ইসলামে মানবাধিকারবিষয়ক কায়রো ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার পাশাপাশি মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সুশাসন ও সুষম উন্নয়নের অঙ্গীকার করা হয়। বিশ্লেষকদের দাবি, এই ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়নি ওআইসির বেশির ভাগ দেশে।
মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বেশির ভাগ সদস্য দেশেই রাজনৈতিক অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে।
আর যে রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ওআইসির প্রতিষ্ঠা, সে ক্ষেত্রে, এমনকি মুসলিম বিশ্বের কোনো রাজনৈতিক সংকটে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না ওআইসি। যেসব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রভাব খাটিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছিল সংগঠনটি, আজ ওআইসির নেতৃত্বদানকারী দেশগুলোর বড় অংশই সেসব দেশের পদলেহনে ব্যস্ত। বিশ্বরাজনীতিতে মুসলিম স্বার্থ সুরক্ষার প্রশ্নেও তাদের ভূমিকা রহস্যজনক। ধনী ও নেতৃস্থানীয় আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠতা ও নির্লিপ্ততা মুসলিম উম্মাহর জন্য উদ্বেগের বড় কারণ। তাই বলা যায়, ওআইসির সম্মেলন ও অঙ্গীকার ঘোষণাসর্বস্ব বিষয়ে পরিণত হচ্ছে দিন দিন।