কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়িয়ে দেয়া সমাধান নয়

মোহাম্মাদ মুস্তফা হায়দার । সূত্র : বণিক বার্তা, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়িয়ে দেয়া সমাধান নয়

সারা বিশ্বে দুই ধরনের বাজার পরিচালিত হয়—নিয়ন্ত্রিত ও মুক্তবাজার। সরকার নিয়ন্ত্রিত বাজারে বেসরকারি কোম্পানির কোনো অধিকার থাকে না। সরকারই দাম নির্ধারণ করে, যেমন ইরান ও ভেনিজুয়েলায় নিয়ন্ত্রিত বাজার। সেসব দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় এ রকম নীতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। কারণ প্রতি বছরই এসব দেশের মুদ্রার ১০০-১৫০ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটে। ফলে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হয়।

 

 


বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে মুক্তবাজার পরিচালিত হচ্ছে। মুক্তবাজার কেন এত জনপ্রিয়? নিয়ন্ত্রণ ও দাম নির্ধারণ কৌশল খুবই ভালো কৌশল। এ বাজারে চাহিদা-জোগান, নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক বাজারসহ বিভিন্ন ফ্যাক্টর কাজ করে। বাজারকে খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করলে তখন এ উপাদানগুলো আয়ত্ত করা সম্ভব হয় না। বাজার যত দ্রুত ওঠানামা করে এবং বাজারের উপাদানগুলো যত দ্রুত ওঠানামা করে, সেটি রেগুলেশনের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করা যায় না। এ কারণে মুক্তবাজারে হয় বেশি নতুবা কম কাজ করে। এর ফলে বাজারে স্পেকুলেশন বাড়ার সুযোগ থাকে।

 

 


অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৫৬ এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ, ২০১১—দুটো আইনেই সরকারের দাম নির্ধারণ করে দেয়ার অধিকার রয়েছে। তবে শুধু প্রয়োজন হলে বলা হয়েছে। তার মানে, দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের সর্বোচ্চ কম চেষ্টা করার কথা রয়েছে।

 

 

পৃথিবীর অন্য দেশগুলো কীভাবে মুক্তবাজার নিয়ন্ত্রণ করে। মুক্তবাজারে ট্যারিফ-শুল্ক সমন্বয়ের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যেটা আমাদের তেল ও চিনিতে হয়েছে কিছুদিন আগে। দ্বিতীয়ত, কৌশলগত মজুদ। অনেক ক্ষেত্রে চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের একটা কৌশলগত মজুদ থাকে। স্থানীয় বাজারের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না থাকলে সরকার মজুদ পণ্য বাজারে ছেড়ে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।

 

 

এরপর সরকারের ভর্তুকি। দেশে টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) মাধ্যমে এ কাজ করা হয়ে থাকে। সরকারের ন্যূনতম বিক্রয় দাম নির্ধারণ। এটি সাধারণত উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে কৃষকদের একটি সুবিধার্থে ন্যূনতম বিক্রয় দাম নির্ধারণ করা হয়।

 

 

কিন্তু কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কিছু আন্তঃবিভাগীয় স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে। কৃষি মন্ত্রণালয় চায় উৎপাদন বাড়াতে, আর খাদ্য মন্ত্রণালয় চায় কত সস্তায় তারা মজুদ পূর্ণ করতে পারবে। এ বছর সরকার প্রতি কেজি চাল ৪৭ টাকায় কিনবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ চালের অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে ধানের দামে গেলে তা ৩০ টাকার নিচে আসতে হবে। এখন ৩০ টাকার নিচে দাম দিয়ে কোনো কৃষক পোষাতে পারবেন কিনা? এ দাম দিয়ে আমরা কৃষকদের মূল্যস্ফীতিকে সমন্বয় করতে পারছি না। মূলত তাদেরই বঞ্চিত করছি আমরা।

 

 

সরকার গত চার-পাঁচ বছরে চালের দাম সমন্বয় করেছে। কিন্তু সেই দামের মাধ্যমে কৃষকদের মূল্যস্ফীতিকে সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি। কারা বঞ্চিত হচ্ছে? ধান ও চালের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাকে বঞ্চিত করব? নাকি কৃষকদের সমর্থন করব? অর্থনীতিতে সঠিকভাবে চার্জ করা দরকার। এ জায়গাটি আমাদের দেখা উচিত। রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ। অনেক সময় সরকার কৌশলগত কারণে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং এদের মাধ্যমে সামান্য লাভে ব্যবসা করে।

 

 

এটি সাধারণত চীনে করা হয়। এরপর আছে বেঁধে দেয়া দাম (প্রাইস ক্যাপ)। এটি খুব বেশি দেশ ব্যবহার করে না। কভিড-১৯ মহামারীর মতো জরুরি পরিস্থিতিতে এটি ব্যবহার হয়। ইরান ও ভেনিজুয়েলায় বেঁধে দেয়া দাম ব্যবহার হয়। এ কারণে বাজারে সঙ্গে সঙ্গে কালোবাজার বা ব্ল্যাক মার্কেট তৈরি হয়। এরপর আমদানি-রফতানি বিধি-নিষিধের মাধ্যমে সরকার পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। শেষত, বাজার হস্তক্ষেপ ও ভর্তুকি তহবিল। এটি সাধারণত পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে করা হয়। যেমন পেঁয়াজ, তরমুজ ও মরিচের দাম কমে গেলে কৃষককে সরকারের তহবিল থেকে সহায়তা দেয়া হয়। যাতে পরের বছর কৃষক এসব পণ্য উৎপাদনে উৎসাহী হন।

 

 

বাংলাদেশ চিনি ও তেলসহ অনেক পণ্য আমদানি করে। যদিও আইন অনুসারে, জাতীয় কমিটির মাধ্যমে একটি প্রক্রিয়া নির্ধারণ হবে। এরপর কোম্পানিগুলো সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দাম নির্ধারণ করবে। কিন্তু তেল ও চিনির দাম সরকার নিয়ন্ত্রিত। আমরা আলোচনা করতে পারি, সরকার আমাদের আলোচনা শোনেও। সরকার বাস্তবতাগুলো বোঝার চেষ্টা করে। সরকারের অনুমোদন ছাড়া পণ্য দুটির দাম নির্ধারণ করা যায় না। এক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। যেহেতু এ পণ্যগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাই সরকার বাস্তবতার নিরিখে অনেক সময় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

 

 

ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে বলা দরকার। সরকার শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। তার পরও ভোজ্যতেলের দাম কমছে না কেন? ভোক্তা কমিটির মাধ্যমে একটি ফর্মুলা করা হয়। সর্বশেষ এক মাসের এলসি, এক মাসের ইনবন্ড ও এক্সবন্ডের প্রাইস ও প্রক্রিয়াকরণের কোইফিশিয়েন্সির মাধ্যমে দামটি নির্ধারণ করা হয়। শুল্ককর বাদ দেয়ার পরও প্রতি টন ভোজ্যতেলের দাম আসে ১ হাজার ১২০ ডলার।

 

 

বর্তমান বাজারে প্রতি টন ভোজ্যতেলের দাম ১ হাজার ১৬০ ডলার, এটিই বাস্তবতা। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ক্রয় করে মুক্তবাজারে পণ্যের দামের যৌক্তিকতা তুলে ধরা যায়। কিন্তু দাম সরকার নিয়ন্ত্রণ করলে এর যৌক্তিকতা প্রয়োগ করা যায় না। কৌশলগত ও প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে সরবরাহের অভাবে বাজারে সংকট তৈরি হতে পারে। তাই সবার আগে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, তারপর দাম।

 

 

আমাদের উৎপাদন উপকরণের ব্যয় বেড়েছে। গ্যাসের দাম বেড়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে। এলসি খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ছয় মাসের ইউ-পাসের কমে এলসি খুলতে চায় না। এছাড়া সাইট এলসি খুলতে চায় না। ছয় মাস পর ডলারের দাম কী হবে তা আমাদের জানা নেই, কিন্তু বিক্রি করছি। চ্যালেঞ্জ থাকছেই। এক্ষেত্রে অবশ্যই সুদহার বাড়ছে।

 

 

 

আমরা যদি আমাদের অর্থনীতিকে পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাই, তাহলে আমাদের ভ্রম হতে পারে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়িয়ে দেয়া সবসময় সমাধান হতে পারে না। বাইরের অর্থনীতি ঋণভিত্তিক। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে তাদের ব্যয় অনেক কম। ঘরবাড়ি, গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে তাদের ব্যয়টা বেশি। বিপরীতে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়। বাড়ি-গাড়ি কেনার শেয়ার আমাদের খুবই ছোট।

 

 

সুদহার বাড়ানোর অর্থ হচ্ছে ভোগ কমানো। আমাদের ৭০ শতাংশ আয়ই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পেছনে ব্যয় হয়। সেক্ষেত্রে সুদহার বাড়িয়ে আমরা সুদভিত্তিক মূল্যস্ফীতি তৈরি করছি। এছাড়া আমাদের অনেকগুলো উৎপাদন উপাদানের ব্যয় বাড়ছে। কাঁচামাল ও চূড়ান্ত পণ্যের শুল্ক ব্যবধান কমে যাচ্ছে। কিন্তু সুদ বেড়ে যাচ্ছে, গ্যাসের দাম বেড়ে যাচ্ছে।

 

 

মোহাম্মাদ মুস্তফা হায়দার: গ্রুপ ডিরেক্টর, টি.কে. গ্রুপ