জন্মগত নাগরিকত্ব
কোনো ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করলে তাকে জন্ম থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি ১৮৬৮ সালে সংবিধানে যুক্ত হওয়া ১৪তম সংশোধনীর নাগরিকত্ব ধারার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত। সংশোধনীতে বলা হয়েছে :
সমস্যার শুরু যেখানে
ট্রাম্পের আদেশে বলা হয়েছে যে, যারা যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী নয়, যদি তাদের মা অবৈধভাবে দেশে অবস্থান করে থাকেন এবং তাদের বাবা নাগরিক বা আইনগত স্থায়ী বাসিন্দা না হন। এ ছাড়া আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নাগরিকত্ব তাদেরও অস্বীকৃত হবে, যাদের মা বৈধভাবে কিš‘ সাময়িক সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেছেন, যেমন শিক্ষার্থী বা পর্যটক ভিসায় এবং যাদের বাবা নাগরিক বা আইনগত স্থায়ী বাসিন্দা নন। যদি আদেশটি কার্যকর হয়, তবে ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এর পরে জন্মগ্রহণকারী সব শিশুর জন্য নাগরিকত্ব বন্ধ করে দেওয়া হবে, যাদের অন্তত একজন পিতা-মাতা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বা আইনানুগ স্থায়ী বাসিন্দা নন। একইভাবে, সেসব শিশুর নাগরিকত্বও অস্বীকার করা হবে, যাদের মা সাময়িক কাজের ভিসা, শিক্ষার্থী ভিসা বা পর্যটক ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন এবং যাদের বাবা নাগরিক বা স্থায়ী বাসিন্দা নন। একটি মামলার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে আনুমানিক দেড় লাখ শিশু জন্মগ্রহণ করে, যাদের পিতা-মাতা উভয়ই মার্কিন আইনব্যবস্থার বাইরে। মামলায় বলা হয়েছে, ‘তারা সবাই দেশ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে এবং অনেকেই রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বে।’
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের ইতিহাস
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের ব্যাপারটি বেশ জটিল। বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের ধারণা এক দিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘকালের আইনগত প্রক্রিয়া, সামাজিক আন্দোলন, সংস্কার ও নীতিমালা সংশোধনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে ‘নাগরিক’ ধারণাটি বাস্তব রূপ পেয়েছে।
ঔপনিবেশিক যুগ এবং প্রাথমিক ভিত্তি (১৬০৭-১৭৭৬)
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের ইতিহাস প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার পূর্বেই শুরু হয়েছে। ঔপনিবেশিক যুগে, ‘নাগরিকত্ব’ ধারণাটি আজকের মতো একক ও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত ছিল না। ব্যক্তির মর্যাদা মূলত ঔপনিবেশিক রীতিতে ইংরেজ কর্র্তৃত্বের অধীনে গঠিত হয়। ঔপনিবেশিক যুক্তরাষ্ট্রে ইংরেজ বসতি স্থাপনকারীরা মূলত ব্রিটিশ মুকুটের অধীন হিসেবে বিবেচিত হতো, যেখানে ইংরেজ আইনের অধীনে তাদের অধিকার ছিল। কিছু উপনিবেশ যেমন মাসাচুসেটসে ‘স্বাধীনতা’ ধারণাটি আরও গঠনমূলক ছিল। সেখানে বসতির অধিবাসীরা ধর্মীয় পরিচিতি বা জমির মালিকানার ওপর ভিত্তি করে অধিকারের বা নাগরিকত্বের দাবি করতে পারতেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা এবং প্রাথমিক গণতন্ত্র (১৭৭৬-১৭৯০)
আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম ১৭৭৬ সালে আমেরিকা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। সে বছর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তখনো বর্তমান ৫০ অঙ্গ রাজ্যের সব রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি ঘটেনি। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নাগরিকত্বের ধারণা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে নাগরিকের নতুন একটি রাজনৈতিক পরিচয় তৈরি হওয়া সত্ত্বেও আইনগত ও সাংবিধানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের ধারণা তখনো সংজ্ঞায়িত হয়ে ওঠেনি। তখন নাগরিক বলতে কেবল রাজ্য পর্যায়ের সদস্যপদ ও অধিকারের বিষয়গুলো নির্ধারণ করা হয়েছিল। নাগরিকের ধারণায় তখন রাজ্যভিত্তিক ভিন্নতা ও সীমাবদ্ধতাও ছিল। ১৭৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান নাগরিকত্বের ধারণাটিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে শুরু করে। তবে তখনো নাগরিকত্বের মৌলিক প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে প্রদান হয়নি। যেমন- নাগরিক হতে হলে কী কী যোগ্যতা দরকার? নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যগুলো কী হবে? ফলে এসবের কোনো বিশদ ও সুস্পষ্ট বর্ণনা জাতীয় ও রাজ্যভিত্তিক সংবিধানে ছিল না। আরও চিন্তার বিষয়, তৎকালীন আইন ও সংবিধান ছিল শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের জন্য সুবিধাজনক, এটি দাসপ্রথাকেও সুরক্ষা দিত। প্রথম নাগরিকত্ব আইন ১৭৯০ সালে পাস হয়, যা বিদেশি নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের জন্য একটি প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করেছিল। এটি নাগরিকত্ব শুধু ‘স্বাধীন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির’ জন্য সীমাবদ্ধ করেছিল, যাদের কাছে ভালো চরিত্র রয়েছে। ফলে দাস, আদিবাসী এবং অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের নাগরিকত্ব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব আইনে বর্ণবাদী শ্রেণি বিভাগের ছায়া রয়েই গেল। তবে তা ১৭৮৭ সালের কার্যক্রম নাগরিকত্বের আইনি কাঠামোর সূচনা করল। এই কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী সময় নাগরিকত্বের ধারণা সম্প্রসারিত হয়। যেমন ১৭৯৫ সালের ন্যাচারালাইজেশন আইনে জাতীয় নাগরিকত্বের প্রক্রিয়া বর্ণিত হয় এবং নাগরিকত্ব পেতে হলে ‘ন্যূনতম পাঁচ বছর বসবাস’ সম্পর্কিত শর্তটি যুক্ত হয়।
গৃহযুদ্ধ এবং পুনর্গঠন (১৮৬১-১৮৭৭)
আমেরিকার গৃহযুদ্ধ (১৮৬১-১৮৬৫) এবং তার পরবর্তী সময় যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব সম্পর্কিত বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। বিশেষত বর্ণ ও নৃতাত্ত্বিক পরিচিতির দিক থেকে এই পরিবর্তনটি আসে।
১৮৬৫ সালে ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে দাসপ্রথা বাতিল করা হয়, যা আফ্রিকান-আমেরিকানদের স্বাধীনতা প্রদান করেছিল, তবে নাগরিকত্ব নিশ্চিত করেনি। ১৮৬৮ সালে ১৪তম সংশোধনী নাগরিকত্বের ভিত্তিকে আরও ব্যাপকভাবে সংজ্ঞায়িত করে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী বা ন্যাচারালাইজড সব ব্যক্তি’ নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তবে আদিবাসীদের নাগরিকতা তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ১৮৭০ সালের ন্যাচারালাইজেশন আইন ১৮৭০ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত জনগণকে নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যবস্থা শুরু করে, তবে তখনো এশীয় নাগরিকদের নাগরিকত্বে নিষেধাজ্ঞা ছিল।
২০ শতক এবং অভিবাসন (১৯০০-১৯৪০)
২০ শতকের প্রথম ভাগেও নাগরিকত্ব আইনে জাতিগত সীমাবদ্ধতাগুলো ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক অভিবাসনের সময় আইনি কাঠামো প্রায়ই জাতিগতভাবে আলাদা ছিল। যদিও ১৮৯৮ সালের ওং কিম আর্ক বনাম রাষ্ট্রের মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করে যে, যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া কোনো ব্যক্তি (যে তার অভিবাসী বাবা-মায়ের সন্তান) ১৪তম সংশোধনীর অধীনে নাগরিক। ১৯২৪ সালের অভিবাসন আইন জাতিগত কোটা ব্যবস্থা স্থাপন করে। ১৯৩৪ সালে ক্যাবল আইন যার মাধ্যমে তারা বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে বিবাহ করলেও তবে তাদের নাগরিকত্বের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। পুরুষরা এসব ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব হারাতেন না।
মধ্য ২০ শতক সিভিল রাইটস এবং অভিবাসন সংস্কার (১৯৫০-১৯৬৫)
ষাটের দশকের সিভিল রাইটস আন্দোলন বর্ণবাদ-বৈষম্যবিরোধী ও ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রাম আন্দোলনের জন্য বিখ্যাত। যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্বের ধারণা পরিবর্তনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৫২ সালে ম্যাককারান ওয়াল্টার অ্যাক্ট অভিবাসন নীতিকে সমন্বিত করে। তবে এশীয়দের প্রতি তখনো বৈষম্যমূলক আইনি সীমাবদ্ধতা রয়ে যায়। ১৯৬৪ সিভিল রাইটস আইন এবং ১৯৬৫ সালের ভোটাধিকার আইন নাগরিক অধিকার অর্জনে পথ সহজ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্বের বিচারে সিভিল রাইটস আইন মূল্যবান পরিবর্তন নিয়ে আসে।
আইনি জটিলতা
এই সংশোধনীটি গৃহযুদ্ধের পর মূলত কৃষ্ণাঙ্গ সমাজকর্মী এবং দাসপ্রথাবিরোধীদের দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছিল। রিপাবলিকান পার্টি সিদ্ধান্ত নেয় যে, এটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে দাসপ্রথা থেকে মুক্ত মানুষ এবং তাদের উত্তরাধিকারীদের নাগরিকত্ব অধিকার সুরক্ষিত রাখা যায়। জন্মগত নাগরিকত্ব নিয়ে প্রধান মামলাটি ১৮৯৮ সালের। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে, ১৮৭৩ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে জন্মগ্রহণের কারণে আইনানুগ চীনা অভিবাসীদের পুত্র ওয়ং কিম আর্ক যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন। ওয়ং কিম আর্ক চীন সফরের পর যুক্তরাষ্ট্রে পুনঃপ্রবেশে বাধা পেয়েছিলেন, সেই সময়ে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল।
১৮৮৪ সালে, ভোটার নিবন্ধন নিয়ে একটি বিরোধের মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী জন এল্ক নাগরিক নন। কারণ তিনি একটি নেটিভ আমেরিকান গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। পরে ১৯২৪ সালে, কংগ্রেস নেটিভ আমেরিকানদের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একজন ফেডারেল বিচারক গত ২৩ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনকে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার সীমিত করার নির্বাহী আদেশ কার্যকর করা থেকে বাধা দিয়েছেন। তিনি বলেন, এই আদেশটি ‘স্পষ্টতই অসাংবিধানিক’।
সিয়াটলে অবস্থিত মার্কিন জেলা আদালতের বিচারক জন কফেনওয়ার চারটি ডেমোক্র্যাটিক নেতৃত্বাধীন রাজ্যের ওয়াশিংটন, অ্যারিজোনা, ইলিনয় এবং ওরেগন আবেদনের ভিত্তিতে একটি সাময়িক স্থগিতাদেশ জারি করেন। এই স্থগিতাদেশের ফলে প্রশাসন আদেশটি কার্যকর করতে পারবে না।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের ব্যাখ্যা ১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধী এবং এ বিষয়টি আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে শেষ হবে।