কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

নারী ক্ষমতায়নে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব

এম এম মাহবুব হাসান । সূত্র : কালবেলা, ১০ মার্চ ২০২৫

নারী ক্ষমতায়নে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব

গত শনিবার বিশ্বব্যাপী পালিত হয়েছে নারী দিবস। নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অধিকার এবং সমান সুযোগের জন্য সংগ্রামের দিন হিসেবে এটি পালন করা হয়। নারী অধিকারের অগ্রযাত্রার প্রায় একশ সতেরো বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে তথা নারীদের যথাযথ ক্ষমতায়ন পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এমনকি বিশ্বব্যাপী নারী শ্রমশক্তির যথাযথ ব্যবহারের চ্যালেঞ্জগুলো এই ক্ষমতায়নে বরাবরের মতোই বাদ সাধছে। সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪৭ শতাংশ নারী শ্রমশক্তির অংশ, যেখানে পুরুষদের মধ্যে প্রায় ৭২ শতাংশ। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এ পার্থক্য ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। চীনের মতো দেশগুলোতে নারী শ্রমশক্তি ৬০ শতাংশ এবং যেখানে ভারতে মাত্র ২৫ শতাংশ নারী শ্রমশক্তি।

 

 

তবে ২০২২ সালের বিবিএস জরিপে উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ৪২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রামে ৫০ দশমিক ৮৯ ও শহরে ২২ দশমিক ৫৯ শতাংশ নারী শ্রমশক্তি। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই পরিসংখ্যান কিছুটা হলেও আশাব্যাঞ্জক। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা, মজুরি ও আয়ের বৈষম্য, আইনি বৈষম্যসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও অহরহ ঘটছে। যেটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য একটি বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি শুধু নারীর আর্থিক স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির জন্য নয়; বরং সমগ্র সমাজের জন্যও লাভজনক।

 

 

এ ছাড়া এটি নারীর জীবনমান উন্নত করতে সাহায্য করে এবং তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের সুযোগ প্রদান করে। যদিও এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৭৪ শতাংশ পুরুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, যেখানে নারীদের মাত্র ৬৮ শতাংশ, যা ৬ শতাংশ লিঙ্গ-বৈষম্যকে নির্দেশ করে। উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে এই ব্যবধান ৯ শতাংশ, যেখানে ৭৪ শতাংশ পুরুষ এবং মাত্র ৬৫ শতাংশ নারীর অ্যাকাউন্ট আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় লিঙ্গ-বৈষম্য ১৮ শতাংশ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা (মেনা) ১৩ শতাংশ এবং সাব-সাহারা আফ্রিকায় ১২ শতাংশের মতো লিঙ্গ বৈষম্য বিরাজমান।

 
 
 

এই বৈষম্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কোনো অংশে কম নয়। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ নারী ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে, যার মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে উল্লেখযোগ্য লিঙ্গবৈষম্য ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের যে তিন কোটি মানুষ ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে তাদের বেশিরভাগই গ্রামে বাস করেন। এই গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশই নারী, যারা এখনো অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

 
 

অথচ নারীকে সুযোগ দিলে তারাও হতে পারেন অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৪ সালের এপ্রিল-জুন মাসের এজেন্ট ব্যাংকিং পরিসংখ্যানে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আউটলেটের মাধ্যমে মোট আমানতের ৪৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ নারী, ৪৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ পুরুষ ও বাকি ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ আসে ‘অন্যান্য’ খাত থেকে। বিশ্বব্যাপী নারীদের ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে থাকার আরও যেসব বিষয়গুলো সামনে এসেছে তা হলো নারী অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারার শিকার। সমাজে তাদের অবস্থান ও ভূমিকা নিয়ে প্রাচীন ধারণাগুলো এখনো প্রচলিত।

 
 

সামাজিক ও পারিবারিক অনেক ক্ষেত্রে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারকে উপেক্ষা করা হয়। কিছু কিছু সংস্কৃতিতে নারীকে এখনো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা হয়। এটি নারী অধিকারকে কুক্ষিগত করে রাখে। যেটি তাদের আর্থিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। এ ছাড়া কিছু দেশে নারীর অ্যাকাউন্ট খুলতে পুরুষের অনুমতির প্রয়োজন হয়। সৌদি আরবেও এই নিয়ম চালু ছিল, যা ২০১৯ সাল থেকে তুলে নেওয়া হয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৪ সালের আগে নারীর অ্যাকাউন্ট খুলতে পুরুষের কাউন্টার সিগনেচার লাগত। অনেক নারীই ব্যাংকিং পণ্য ও পরিষেবা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। বৈশ্বিক আর্থিক সাক্ষরতার ক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশ পুরুষ আর্থিকভাবে শিক্ষিত যেখানে নারী ৩০ শতাংশ, যা নারী-পুরুষের মধ্যে ৫ শতাংশ পার্থক্য নির্দেশ করে।

 

 

বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ৪৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ নারী আনুষ্ঠানিক আর্থিক পরিষেবা গ্রহণ করছেন, যেখানে ৬২ দশমিক ৮৬ শতাংশ পুরুষ আনুষ্ঠানিক আর্থিক পরিষেবা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন। যদিও নারীর ক্ষমতায়ন ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং সুবিধার গুরুত্ব অপরিসীম। সেক্ষেত্রে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা নারী উদ্যোক্তা, চাকরিজীবী ও গৃহিণীদের আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করছে।

 

 

তবে বিশ্বের প্রায় ১৮টি দেশে এখনো নারীদের চাকরি করার ক্ষেত্রে পুরুষের অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে, যা কিছুটা হলেও নারীকে যোগ্যতা অনুযায়ী সমসুযোগ লাভে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সে হিসেবে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৪ সালে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ, যা মোট শ্রমশক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। অন্যদিকে, পুরুষের অংশগ্রহণের হার ৮১ দশমিক ৯ শতাংশ।

 

 

তৈরি পোশাক খাতে, নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ খাতে বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৫৯ দশমিক ১২ শতাংশ নারী যেটি আমাদের নারী অগ্রগতির অনন্য উদাহরণ। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করলে বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারীর পিছিয়ে পড়ার এখনো অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন সেক্টরে কর্মক্ষেত্রে নারীর এখনো এগিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের নারী অর্থনৈতিকভাবে আরও ক্ষমতাশীল হয়ে উঠতে পারেন। যেমন গত ২০২৪ সালের জানুয়ারি-জুনে ৬১টি ব্যাংকের জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতে কর্মরত ২ লাখ ৭ হাজার ৯৬৬ জন জনবলের মধ্যে মাত্র ৩৪ হাজার ৩৬৮ জন বা ১৬.৫৩ শতাংশ নারী।

 

 

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নারী যখন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হন, তখন তা শুধু ব্যক্তিগত উন্নয়নেই নয়, বরং গোটা সমাজের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

সকলের জন্য ব্যাংকিং সুবিধার সহজলভ্যতা নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি, সঞ্চয় বৃদ্ধি, বিনিয়োগের সুযোগ এবং আত্মনির্ভরশীলতা গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। নারী যদি তার নিজের আর্থিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তবে নারীর ক্ষমতায়নও অনিবার্য হয়ে উঠবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

 

লেখক: ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক