নারী নির্যাতন : বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ন্যায়বিচারের প্রতিবন্ধক
ড. রাশেদা আখতার । সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ১০ মার্চ ২০২৫

দেশে নারীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির বিষয়টি সম্প্রতি ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। নারী এখন স্বাবলম্বী এবং প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও উদ্যোক্তা হিসেবে, শিক্ষার্থী হিসেবে এমনকি শহরে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও নারীর ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু নারীর নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার প্রাপ্তি এবং সড়কে নিরাপদভাবে চলাচলের পথও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে অনিশ্চয়তার মুখে। এ অনিশ্চয়তার সঙ্গে নারীর রাজনৈতিক অধিকারের প্রসঙ্গটি সঙ্গতই নানাভাবে জড়িত। সমস্যা হলো, সারা দেশেই জননিরাপত্তা ঘাতের মুখে। এ সমস্যাটি আজকের নয়। গত বছর সেপ্টেম্বর থেকেই জননিরাপত্তা ও নারীর নিরাপত্তা ক্রমেই হ্রাস পাওয়ায় বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করেছে। গত বছর অক্টোবরে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে দেশে ধর্ষণ ও গণপিটুনি বেড়েছে। সেপ্টেম্বরে গণপিটুনির সংখ্যা ছিল ২০টি। আর অক্টোবরে ঘটে ২৬টি।
এ ছাড়া সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে শিশু ধর্ষণ বৃদ্ধি পায় ৯১ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং নারী ধর্ষণ ৪৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপরাধ ও ধর্ষণ বেড়েছে। সমাজে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মনে সরকারের দায়িত্বশীলতায় ঘাটতির বিষয়টিই ইঙ্গিত করছে বেশি। অন্যদিকে, বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘুণধরা সমাজের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কেও আমাদের ওয়াকিবহাল করে তুলছে। সম্প্রতি প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ সহযোগী সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনে বলা হয়, মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষিত, রাজশাহীগামী এক বাসে ডাকাতির সময় এক নারীকে তিন ঘণ্টা ধর্ষণ করা হয়। আবার শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে রংপুরের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফুল সংগ্রহ করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়। এছাড়া রাজধানীসহ সারা দেশে ছিনতাই-ডাকাতির যে বীভৎস দৃশ্য প্রতিনিয়ত পাওয়া যাচ্ছে, তা শঙ্কা বাড়িয়েই চলেছে। বিশেষত সাধারণ মানুষের মনে এখন রাতে কোথাও যাতায়াতের বিষয়টি আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। আর এমনটি অনেক নারীর জন্য আরও বড় সমস্যা।
নারীর জন্য রাত গভীর হওয়া সব সময়ই একটি বড় সমস্যা। সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এ দুটি আঙ্গিকে বিচার করলেও আমরা দেখি, জননিরাপত্তাজনিত সংকট নারীর ক্ষতিই বেশি করে। দেশে নারী বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা না থাকলেও অনেকটা নিশ্চিতরূপেই বলা যায়, নারী এমন অনেক কাজের সঙ্গে জড়িত যেখানে তাদের রাতে বাড়ি ফিরতে হয়। এখন অনেক নারী সাংবাদিকতা, করপোরেট প্রতিষ্ঠান, আইটি প্রতিষ্ঠান এমনকি কল সেন্টারেও চাকরি করে। তা ছাড়া তৈরি পোশাক শিল্পে নারী যেহেতু এ খাতের প্রাণশক্তি, তাই তাদেরও অনেক সময় ওভারটাইম করে অনেক রাত হয়ে যায় ফিরতে। এ সময় যাতায়াতে তাদের বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। প্রথমত. মেট্রোরেল বা নিজস্ব যানের সুবিধা যারা পায় না, তাদের গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হয়। সেখানে যৌননিপীড়নের মুখোমুখি তাদের প্রায়ই হতে হয়। আবার এখন সেমিলোকাল হয়ে থাকা বাসে যাত্রীর এত ভিড় থাকে যে, নারী যাত্রী তোলাও হয় না। বাসেও নারী নিরাপদ নয়।
সড়কেও নয়। ফলে অনেক নারীকে পারিবারিক চাপেই তাদের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে হচ্ছে। অনেকে কোনোমতে আঁকড়ে থাকলেও তাদের সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়। অর্থাৎ এ মুহূর্তে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এমনকি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাজনিত কোনো সুবিধাই নারীর পক্ষে নেই। এমনটি যদি চলমান থাকে তাহলে দেশের বেশ কয়েকটি খাত দুর্বল হয়ে পড়বে। যেমন স্বাস্থ্য খাত। এ খাতে নারী একটি বড় সম্পদ। আবার তৈরি পোশাক শিল্পেও নারীর বড় অবদান রয়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের বিকাশেও নারীর অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু নারীর নিরাপত্তাজনিত ঘাটতি উৎপাদনব্যবস্থায় যেমন একটি ঘাটতি তৈরি করছে, তেমন আমাদের অভ্যন্তরীণ শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ সরে যাওয়ার মতো শূন্যতাও বাড়াচ্ছে। এমনটির নেতিবাচক প্রভাব দুটি আঙ্গিকে আমাদের প্রভাবিত করতে পারে। তাছাড়া নারীর নিরাপত্তাসংকটটি শুধু নারীকে কেন্দ্র করেই শেষ হয়ে যায় না। কারণ, নারী ও শিশুরাও এর সঙ্গে জড়িত। ফলে আমরা শুধু নারীর নিরাপত্তাসংকটের দিকেই তাকিয়ে রয়েছি।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ এবং নারী-শিশুসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ-সমাবেশ-মানববন্ধন হয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অনলাইন সংস্করণের প্রতিবেদন অনুসারে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বেসরকারি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভ সংঘটিত হয়। নতুন বাংলাদেশে কেউ যেন আর ধর্ষণের শিকার না হয়, সে দাবি জানান তারা। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এমন দাবি-বিক্ষোভ-আন্দোলন হওয়া স্বাভাবিক।
কিন্তু নারীর এ নির্যাতন সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমত নাগরিক সচেতনতা, রাষ্ট্রকাঠামোর আইন প্রয়োগ ও বাস্তবয়নে গাফিলতি না করাসহ নানা বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। এসব সমস্যা এক দিনে শেষ করা সম্ভব হবে না। কিন্তু সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা জরুরি। যখন দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতির পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি বা বর্তমানে কার্যকর নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন তার আভাস আমরা পাই। কিন্তু এখনও এ বিষয়ে আমরা সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি। ফলে সামনে কী ঘটতে চলেছে, এ বিষয়েও আমরা স্পষ্ট কোনো বিশ্লেষণ করতে পারছি না।
ধর্ষণের ঘটনাগুলোর তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ নষ্ট করে দেয়। একজন ধর্ষিতা যখন আদালতে বিচার চাইতে যান তখন তিনি একই সঙ্গে চারটি চাপ কাঁধে বোঝাই করে সৎসাহস দেখান। তার মানসিক টানাপড়েন, সামাজিক মন্তব্যকে মুখোমুখি হয়ে সামলানো, পারিবারিক অসহযোগিতা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষক রাজনৈতিক আশ্রয় পেলে হুমকি দিয়ে থাকে
পটপরিবর্তনের পর নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচনের যে প্রত্যাশা রয়েছিল, এ বিষয়ে এখন কোনো বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা দেখেছি, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নারীর অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল। সঙ্গত কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারে নারীর প্রতিনিধিত্বের হার বেশি থাকার বিষয়টিও আলোচনায় ছিল। সম্প্রতি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিষয়টি দৃশ্যমান হয়েছে। সে বন্দোবস্তে নারী কোথায়, নারীর নিরাপত্তা কোথায়Ñ এমনটি ইতোমধ্যে সচেতন একটি মহলের নিয়মিত প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ আমরা দেখছি, নারী ও শিশু ধর্ষণ একের পর এক ঘটে যাচ্ছে। গত ১৫ বছর বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমরা দেখেছি। কিন্তু ৫ আগস্টের পরও এ ঘটনাগুলো বারবার ঘটছে। এ ক্ষেত্রে যারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত তারা পুলিশের নাগালের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর আরেকটি প্রতিবেদনে জুলাই অভ্যুত্থানের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা নারী একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। জুলাইয়ে নারী এসবের জন্য কি সামনের সারিতে থেকে আন্দোলন করেছিল?
সহজ ভাষায় আমাদের উত্তর হবে, না। বরং রাষ্ট্রে নারীর রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দেওয়া জরুরি। এ কাজটিতে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। আমরা দেখছি, পটপরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে অভ্যন্তরীণভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পুলিশ অনেকটা জবুথবু অবস্থায় রয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের এমনভাবে ব্যবহার করেছে যে, পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আইন প্রয়োগ ও নাগরিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা সক্রিয় হতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে, পুলিশ প্রশাসনের বিশৃঙ্খল অবস্থার সমাধান এখনও হয়নি। নগরে যৌথ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে এবং অনেক অপরাধীকে শনাক্তও করা হচ্ছে। কিন্তু অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী পটপরিবর্তনের পর জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে। তাদের কারণে আন্ডারগ্রাউন্ড সরগরম। এমন পরিস্থিতিতে জননিরাপত্তা শুধু নারীই নয়, সবার জন্যই সমান। কিন্তু যেহেতু নারীর প্রতিবন্ধকতা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকÑদুটি ক্ষেত্রেই বিদ্যমান তাই সামাজিক পর্যায়ে এর নেতিবাচক প্রতিবন্ধকতা তাদের ভোগায় আরও বেশি।
দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মতৎপরতা বাড়াতে হবে। আমরা দেখছি, পুলিশ ও সেনাবাহিনী যৌথভাবেই অভিযান পরিচালনা করছে এবং অনেক আসামি পাকড়াও করেছে। কিন্তু এটিই সমাধান নয়। কারণ আমাদের দেশে সবাইকে ঘরে ঘরে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। জনসংখ্যাবহুল এ দেশে প্রযুক্তির ব্যবহার প্রাধান্য দিতে হবে। আমাদের কাছে প্রযুক্তি যেমন সিসিটিভি, সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ফুটেজ এমনকি ট্র্যাক করার সব সুবিধাই পুলিশ বাহিনীকে দেওয়া রয়েছে। কিন্তু পুলিশি তদন্তে এখনও মান্ধাতা সময়ের কাগুজে ব্যবস্থা বিদ্যমান। ধর্ষণের ঘটনাগুলোর তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ নষ্ট করে দেয়। একজন ধর্ষিতা যখন আদালতে বিচার চাইতে যান তখন তিনি একই সঙ্গে চারটি চাপ কাঁধে বোঝাই করে সৎসাহস দেখান।
তার মানসিক টানাপড়েন, সামাজিক মন্তব্যকে মুখোমুখি হয়ে সামলানো, পারিবারিক অসহযোগিতা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষক রাজনৈতিক আশ্রয় পেলে হুমকি দিয়ে থাকে। তাই নারীর জন্য কাজটি চ্যালেঞ্জের। এমন সময়ে যখন এ ধরনের বিচারে দীর্ঘসূত্রতা হয় তখন সঙ্গতই অনেক নারী পিছিয়ে যান। কিন্তু তার জীবন আর স্বাভাবিক হতে পারে না। অথচ এমনটি হওয়া উচিত নয়। আমাদের জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ালেই হবে না। প্রযুক্তির মাধ্যমে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত দ্রুত বিশ্লেষণ করে অপরাধীকে আটক করতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যারা ধর্ষণ, ছিনতাইয়ে জড়িত, তাদের কাছে একটি বার্তা পৌঁছানো দরকার। এ বিষয়ে বিলম্ব করা সঠিক কাজ হবে না। যত দ্রুত সম্ভব সবাইকে আইনের আওতায় আনার এ পদক্ষেপ সরকারকে বর্তমানে জনমনে থাকা প্রশ্ন থেকে রেহাই দিতে পারে। এতে দেশের সাধারণ মানুষ সুফলভোগী হবে।
- অধ্যাপক, নৃতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়