নারীর জন্য কী আছে বেলেম জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যানে
সানজিদা খান রিপা [প্রকাশ : সমকাল, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫]

কপ৩০ সম্মেলনের পর্দা নেমেছে ২২ নভেম্বর ২০২৫। ব্রাজিলের বেলেম শহরে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজন জঙ্গলের মুখে আয়োজনটা হওয়ায় প্রকৃতির প্রভাব ছিল সর্বত্র স্পষ্ট। ভ্যাপসা গরমে চারপাশ ভারি হয়ে থাকত। আবার প্রায়ই হঠাৎ আকাশ অন্ধকার হয়ে আসত। তারপর ঝুম বৃষ্টি নেমে মুহূর্তেই চারদিক ভিজিয়ে দিত। এই অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া অংশগ্রহণকারীদের বিস্মিত এবং সম্মেলনের পরিবেশে এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছে।
এবারের সম্মেলনে আদিবাসী নারী-পুরুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। শুধু ব্রাজিল নয়; বিশ্বের নানা দেশ থেকে তারা এসেছিলেন। তাদের জন্য আলাদা মঞ্চ থাকায় মূল আলোচনায় তাদের উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় দিনে প্রবেশদ্বার অবরোধ করে আদিবাসীরা বিক্ষোভে নামেন এবং ‘ব্লু জোন’-এ প্রবেশের চেষ্টা করেন। এর পরদিন থেকেই কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়।
এই প্রথম আমি জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিলাম। তাই সবকিছুই আমার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। বিশেষভাবে চোখে পড়েছে নারীর উপস্থিতি; সংখ্যায় তারা ছিল যথেষ্ট। যদিও আগের সম্মেলনের সঙ্গে তুলনা করার সুযোগ নেই, তবুও এবারের দৃশ্যমান অংশগ্রহণ আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। সব মিলিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে, কপ৩০ কেবল জলবায়ু নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি সামাজিক ন্যায্যতা, নারী অধিকার এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ভিত্তিক অংশগ্রহণের এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চে পরিণত হয়েছিল।
মূল কথায় ফিরে আসি। কপ৩০-এর শেষের দিকে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো নতুন বেলেম জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যান (জিএপি-গ্যাপ) অনুমোদন করেছে। এই পরিকল্পনা ২০২৬ থেকে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত ন্যূনতম লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এবং পুরোনো এনহান্সড লিমা ওয়ার্ক প্রোগ্রাম অন জেন্ডার আপডেট ও শক্তিশালী করেছে। নতুন পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হলো জলবায়ু নীতি, পরিকল্পনা, প্রকল্প ও অর্থায়নের প্রতিটি স্তরে লিঙ্গভিত্তিক সমতা এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
এখানে ‘নারী’ বলতে কেবল সাধারণ নারী নয়; আদিবাসী, গ্রামীণ, কৃষিজীবী, প্রতিবন্ধী এবং অন্যান্য প্রান্তিক ও উপেক্ষিত গোষ্ঠীর নারীর অংশগ্রহণ ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এ ছাড়া নারীমুখী ও কমিউনিটিভিত্তিক প্রকল্প এবং জেন্ডার সংবেদনশীল জলবায়ু অর্থায়ন (জেন্ডার রেসপন্সিভ ক্লাইমেট ফিন্যান্স) ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতিও এসেছে।
এই আলোচনায় একটি সংবেদনশীল মোড় আসে, যখন বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের প্রতিনিধিরা ‘জেন্ডার’ শব্দের সংজ্ঞা এবং ‘ইকুয়ালিটি’ ও ‘ইনডিজিনাস উইমেন’ শব্দগুলো অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক করেন। এগুলো দেখে বোঝা যায়, কিছু কিছু শব্দ কতটা গভীর রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে।
জলবায়ু আলোচনায় লিঙ্গসমতা অন্তর্ভুক্তির যাত্রা শুরু হয় ২০১৪ সালে কপ২০-এ ‘লিমা ওয়ার্ক প্রোগ্রাম অন জেন্ডার’ গ্রহণের মাধ্যমে। ২০১৭ সালে কপ২৩-এ প্রথম জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যান-গ্যাপ গৃহীত হয়, যা জলবায়ু নীতি ও কর্মসূচিতে নারীর অংশগ্রহণকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। ২০১৯ সালের কপ২৫-এ এটি ‘এনহান্সড লিমা ওয়ার্ক প্রোগ্রাম অন জেন্ডার’ হিসেবে আরও শক্তিশালী হয়। সবশেষে, বেলেমে অনুমোদিত নতুন গ্যাপ অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে ভবিষ্যতের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামো তৈরি করেছে, যা জলবায়ু নীতি ও অর্থায়নে নারীর সমতা ও অংশগ্রহণকে আরও সুসংহত করবে বলে আশা করা যায়।
বাংলাদেশে নারীর জন্য সুযোগ
নতুন গ্যাপের মাধ্যমে জলবায়ুনীতি, পরিকল্পনা ও অর্থায়নের সব স্তরেই লিঙ্গ-সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি বাধ্যতামূলক। ফলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্যাপ বাস্তবায়নের সকল পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের সুযোগ তৈরি হবে। যারা গ্রামীণ, আদিবাসী, ভূমিহীন, মৎস্যজীবী, ক্ষুদ্র কৃষক বা উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করেন, বিশেষত নারী এবং দরিদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়, তাদের জলবায়ু ঝুঁকি, অভিযোজন ও পুনরুদ্ধারে আগের তুলনায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। অর্থাৎ বিশেষ উদ্যোগ, কমিউনিটিভিত্তিক অভিযোজন এবং মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা (রেজিলিয়েন্স) প্রকল্পে এ গোষ্ঠীর নারীর অংশ নেওয়ার সুযোগ বাড়বে।
নারী নেতৃত্বাধীন কৃষি, পানি, বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ, খাদ্য নিরাপত্তা, বীজ সংরক্ষণ, স্থানীয় জ্ঞানের ব্যবহার– এসব ক্ষেত্রে নারীর অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের মূল্যায়ন হবে। এর ফলে জলবায়ু সহনশীলতা শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়; সামাজিক ও জেন্ডার সংবেদনশীল হয়ে উঠবে বলে মনে করছি।
ঝুঁকি ও সীমাবদ্ধতা
তবে গ্যাপ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। অনেক দেশ এখনও নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিতে নারাজ। বাংলাদেশেও অর্থায়ন সীমিত থাকলে নারীর প্রকল্প বা উদ্যোগ সহজে বাস্তবায়ন করা যাবে না।
নারীর নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা, ভূমি অধিকার ও খাদ্য নিরাপত্তার মতো জটিল বাস্তবতা উপেক্ষা করলে গ্যাপ কেবল কাগজেই থেকে যাবে। এ ছাড়া নারীর অংশগ্রহণ শুধু নগর বা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হলে গ্রামীণ, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের নারীর সুবিধা পৌঁছাবে না। মনিটরিং, তথ্য সংগ্রহ এবং জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে গ্যাপ দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর হবে না।
করণীয়
বাংলাদেশে গ্যাপ বাস্তবায়ন করতে হলে কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমত, নারীর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও নেতৃত্ব দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, নারী নেতৃত্বাধীন অভিযোজন, সহনশীলতা এবং কমিউনিটি প্রকল্পে সহজ প্রবেশাধিকার এবং জলবায়ু অর্থায়নে বরাদ্দ দিতে হবে। তৃতীয়ত, নারীর ভূমি অধিকার, স্থানীয় জ্ঞানকে জাতীয় নীতি ও প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শেষমেশ মনিটরিং, জেন্ডার-ডিজএগ্রিগেটেড ডেটা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার
বেলেম গ্যাপ সফল হলে নারীর ভূমিকা, নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ কেবল সামাজিক ন্যায়ের জন্য নয়, বরং জলবায়ু অভিযোজন, ক্ষতিপূরণ ও প্রকৃতি পুনরুদ্ধারে কার্যকরী প্রমাণিত হবে। তবে এ পরিকল্পনা কাগজে আটকে না রেখে বাস্তবতায় প্রয়োগ করতে হলে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অর্থায়ন, স্থানীয় নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
সানজিদা খান রিপা: প্রোগ্রাম ম্যানেজার, এএলআরডি