নীতি বদলায়নি সম্পর্ক বদলেছে
প্রকাশ :রূপান্তর , ০৩ জানুয়ারি ২০২৫

সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪ সালে ভারতের বেশির ভাগ প্রতিবেশী দেশেই রাজনৈতিক উথাল-পাথাল ঘটেছে। এমন কিছু ঘটনাও হয়েছে কয়েকটি দেশে, যার ফলে ভারতের সঙ্গে সেই দেশগুলোর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এসেছে টানাপড়েন। ভারতকে সমস্যায় পড়তে হয়েছে বেশ কয়েকটি জায়গায়। অবশ্য এ সময়ে চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদ নিয়ে অগ্রগতিও দেখা গেছে। নরেন্দ্র মোদি যখন ২০১৪ সালে প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদে শপথ নেন, তখন প্রায় সব প্রতিবেশী দেশের সরকারপ্রধানরাই ভারতে এসেছিলেন। শপথ গ্রহণের পর থেকে গোড়ার দিকে কয়েক বছর মোদি শুধুই প্রতিবেশী দেশগুলোতেই সফর করেছিলেন। তা থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ভারতের বিদেশনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোকেই সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে ওই নীতিকে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ বা ‘প্রতিবেশীই প্রথম’ নাম দেওয়া হয়। তবে এই নীতির প্রথম ধারণাটা এসেছিল ২০০৮ সালে। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার জন্য এই নীতি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এক দশক পরে এসে সে পরিস্থিতি পুরো উল্টে গেছে। বিবিসির দিল্লি প্রতিনিধি অভিনব গোয়েলের এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারত সরকারের বর্তমান সম্পর্কের চিত্র।
বাংলাদেশের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি দুবার বাংলাদেশ সফরে গেছেন। একবার ২০১৫ সালের ৬ জুলাই, দ্বিতীয় বার ২০২১ সালের ২৬। তবে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক আমূল বদলে গেছে। শেখ হাসিনা পাঁচ আগস্ট থেকে ভারতে অবস্থান করছেন। তখন থেকেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ভারত লাগাতার অভিযোগ করে আসছে যে তারা সে দেশে হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। দুই দেশের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। ভারতীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের তুলনায় চলতি বছরের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক উথাল-পাথাল সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় তবে সে কারণে ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতিতে কোনো বদল ঘটেনি। তার কথায়, সব সময়েই ভারতের নীতি এটাই থেকেছে যে দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবেশী দেশগুলোও যাতে অর্থনৈতিকভাবে মজবুত হয় আর সেখানে রাজনৈতিক সুস্থিরতা বজায় থাকে।’
তিনি মনে করেন যে বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের পর থেকে সেখানে জামায়াত এবং আওয়ামী লীগ-বিরোধী শক্তিগুলো মজবুত হয়েছে, যার ফলে তারা পাকিস্তানের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।
তবে পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং ‘দ্য ইমেজ ইনস্টিটিউট’-এর অধ্যক্ষ রবীন্দ্র সচদেভ মনে করেন, ২০২৪ সালে ভারতের সব থেকে বড় ধাক্কা লেগেছে প্রতিবেশী বাংলাদেশের ঘটনায়। এটা ‘নেইবারহুড ফাস্টর্’ নীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার বাংলাদেশে না থাকার ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতে উগ্রপন্থি কার্যকলাপ বেড়ে যেতে পারে, কারণ তার আমলে উগ্রপন্থিরা সে দেশে আশ্রয় পেত না। তবে এখন তারা নিজেদের অবস্থান মজবুত করার একটা সুযোগ পেল।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক কোন পথে?
বিশ্বের এমন কয়েকটি দেশ আছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদি মাত্র একবারই সফর করেছেন। এরই মধ্যে অন্যতম হলো পাকিস্তান। নিজের প্রথম শপথ-গ্রহণ অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আবার নওয়াজ শরিফের জন্মদিনে হঠাৎই লাহোর গিয়েছিলেন মোদি। তবে পাঠানকোট, উরি, পুলওয়ামা এবং বালাকোটের ঘটনার ফলে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, তা এখনো চলছে।
এ রকমই একটা পরিস্থিতিতে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে পাকিস্তান ভারতকে আমন্ত্রণ করেছিল এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সেখানে হাজির হয়েছিলেন। এর আগে সুষমা স্বরাজ যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন, তখন একবার তিনি ইসলামাবাদে গিয়েছিলেন।
পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্র সচদেভ বলছেন, ভারত আর পাকিস্তানের সম্পর্ক বহু বছর ধরেই শীতল হয়ে রয়েছে আর ২০২৪ সালে সেই পরিস্থিতিতে বিশেষ কিছু পরিবর্তন আসেনি। তিনি বলেন, যতক্ষণ পাকিস্তান ভারত-বিরোধী প্রচারণা আর সীমান্তের ওদিক থেকে সন্ত্রাসবাদ আটকাতে না পারবে, ততক্ষণ দুই দেশের সম্পর্ক সহজ হবে না।
নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে টানাপড়েন
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদি এখন পর্যন্ত পাঁচবার নেপাল সফর করেছেন। তবে এখন নেপালে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (সংযুক্ত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) ক্ষমতায় রয়েছে, যার শীর্ষে আছেন দলটির সভাপতি কেপি শর্মা ওলি। ভারত-বিরোধী বলে তিনি পরিচিত। ওলি চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে প্রথম সফরটি করেছিলেন চীনে। যদিও চিরাচরিত ভাবে নেপালের প্রধানমন্ত্রীরা দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রথম বিদেশ সফরে আসেন ভারতে। তার সরকার ক্ষমতায় আসার পরে চীনের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর নতুন কাঠামোগত চুক্তিতে শামিল হয়েছে নেপাল।অবশ্য অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ মনে করেন যে ভারত আর চীন দুই দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক ‘ব্যালান্স’ করে চলার চেষ্টা করছে নেপাল। তার কথায়, ‘কেপি শর্মা ওলি চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান, কিন্তু ভারতকেও ছাড়তে চান না। চীন থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাবে তার দেশ, সেগুলো হাতছাড়া করতে চাইছেন না তিনি। তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছরে নেপালের সঙ্গে ভারতের বিরোধ সামনে এসেছে, কিন্তু ২০২৪ সালে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি বা বড় কোনো বিতর্কও সামনে আসেনি।
মালদ্বীপের সঙ্গে কি সম্পর্ক সহজ হলো?
মোহামেদ মইজ্জু ২০২৩ সালের নভেম্বরে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট হন। নির্বাচনী প্রচারণায় ‘ইন্ডিয়া আউট’, অর্থাৎ ভারতকে তার দেশ থেকে বার করার সেøাগান দিয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পরে ভারত আর মালদ্বীপের মধ্যে সম্পর্কে চরম উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি ২০২৪-এর গোড়ায় লাক্ষাদ্বীপে গিয়েছিলেন এবং সেখানকার কিছু ছবি শেয়ার করে মানুষকে সেখানে বেড়াতে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই আবেদনের পরে মালদ্বীপের কয়েকজন মন্ত্রী মোদি ও ভারত নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন, যার ফলে দুই দেশের মধ্যে নতুন এক বিবাদ শুরু হয়ে গিয়েছিল।
রবীন্দ্র সচদেভের কথায়, মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্কই ছিল, কিন্তু মইজ্জু ক্ষমতায় আসার পরে তাতে চিড় ধরে। তিনি এমন সব ভারত-বিরোধী মন্তব্য করতে থাকেন, যা তার আগে কখনও কেউ করেননি। সচদেভ বলেন, মালদ্বীপ সরকার চীনের দিকে ঝুঁকে ছিলই, তবে ভারত এই প্রথমবার একেবারে ব্যাকফুটে চলে গেল। এটা ভারতের কাছে দুশ্চিন্তার বিষয়। ভারতের পক্ষে উদ্বেগের বিষয়। তিনি বলেন, সামাজিক মাধ্যমে যেসব বিবৃতি আসছিল, তাতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু ভারত খুবই সুচিন্তিত বক্তব্য প্রকাশ করেছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ২০২৪ সালের আগস্টে তিন দিনের সফরে মালদ্বীপ গিয়েছিলেন। সেসময়ে বেশ কিছু চুক্তি সই হয়। এখন মনে হচ্ছে ভারতের ব্যাপারে মালদ্বীপ অনেকটা নমনীয় হয়েছে।
আফগানিস্তানের তালেবানের সঙ্গে আলোচনা
ভারত আর আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্কটা ঐতিহাসিক। ভারতের সীমানা ১৯৭৪ সাল পর্যন্তও আফগানিস্তানের লাগোয়া ছিল। তালেবান যখন ক্ষমতায় এল ৯০-এর দশকে, তখন ভারত তাকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু ৯/১১-র হামলার পরে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে প্রবেশ করার পরে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হয়। এই সময়েই ভারত আবারও একবার আফগানিস্তানে হাজির হয়। কিন্তু ২০২১ সালের আগস্ট মাসে, যখন তালেবান দ্বিতীয়বার আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে নেয় তখন মনে হচ্ছিল, তালেবান শাসনে ভারত সেই জায়গাটা পাবে না, যেটা আগে পেয়েছে। কারণ, ভারত তালেবানকে আগেও স্বীকৃতি দেয়নি, এখনও দিচ্ছে না। রবীন্দ্র সচদেভ বলেন, ২০২৪ সালে কাতারের মাধ্যমে ভারত আর আফগানিস্তানের মধ্যে আলোচনা এগোয়। দুই দেশই পর্দার আড়ালে থেকে ভালোই হোমওয়ার্ক করেছে, যার ফল হয়তো আমরা ২০২৫ সালে দেখতে পাব।
শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট যে বার্তা দিলেন
শ্রীলঙ্কার বিদেশ নীতিতে ভারত যতটা গুরুত্বপূর্ণ, আবার ভারতের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ওই দ্বীপরাষ্ট্র। ভারত আর চীন দুই দেশই নিজেদের বাণিজ্যিক আর পররাষ্ট্র বিষয়ের সম্পর্কে শ্রীলঙ্কাকে অগ্রাধিকার দেয়। এর একটা বড় কারণ হলো ভারত মহাসাগরে শ্রীলঙ্কার ভৌগোলিক অবস্থান কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালে ব্যাপক সরকার-বিরোধী বিক্ষোভ হয়। সাধারণ মানুষ প্রেসিডেন্টের বাসভবন-সহ অনেক সরকারি ভবন দখল করে নেয় এবং প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। আর্থিক সংকটে ডুবতে থাকা শ্রীলঙ্কাকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে ভারত এবং শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালে সে দেশে এক নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। বামপন্থি নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়েকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন।অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজের কথায়, দিসানায়েকে তার প্রথম বিদেশ সফরে ভারতকে বেছে নিয়ে এই বার্তা দিয়েছেন যে শ্রীলঙ্কা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন চায়। তবে রবীন্দ্র সচদেভ বলছেন, অর্থনৈতিক সংকট আর ঋণ পুনর্গঠনের ব্যাপারে যেভাবে ভারতের সহায়তা পেয়েছে শ্রীলঙ্কা, তাতে ভারত এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যেকোনো দেশ তাদের প্রকৃত বন্ধু!