কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

নেতানিয়াহুর যুদ্ধে নিজেকে জড়ালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

ড. ফরিদুল আলম [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৩ জুন ২০২৫]

নেতানিয়াহুর যুদ্ধে নিজেকে জড়ালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

দুই সপ্তাহের সময় নিয়েছিলেন ট্রাম্প। তিনি বলেছিলেন, কূটনীতির জন্য এই সময়টা দিতে চান তিনি। সেভাবেই ইউরোপীয় তিন দেশ ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক হয় জেনেভায়। ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন ও জতিসংঘের সনদ ভঙ্গ করে ইরানে এই হামলা চালিয়েছে এবং আত্মরক্ষার্থে ইরান পাল্টা হামলা চালাতে বাধ্য হয়েছে।

 


ইসরায়েলের পক্ষ থেকে হামলা বন্ধ হলে ইরান পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় বসতে সম্মত, এমনটা জানানোর পর ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে এই বৈঠকটি সাময়িক স্থগিত করে। এখানে উল্লেখ্য যে ইউরোপীয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য হামলা ঠেকানো। এই সময়ের মধ্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু একাধিকবার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা চালানো উচিত বলে মন্তব্য করেন।

 


সবাইকে অবাক করে দিয়ে দুই সপ্তাহ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করে বসল।

 


অনেকের ধারণা ছিল, হামলা না করতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলকে এই হামলা বন্ধের অনুরোধ করে ইরানকে আবারও আলোচনার টেবিলে বসাতে চাইবেন এবং আলোচনাপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির একটা লাগাম টানতে চাইবেন, যাতে দেশটি অদূর ভবিষ্যতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে যেতে না পারে। এসবের কোনো কিছুই না করে মার্কিন বি-২ বোমারু বিমান দিয়ে সরাসরি হামলা করা হলো ফারদো, ইস্পাহান ও নাতাঞ্জের পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে। এই বি-২ স্টেলথ বিমান সহজেই রাডার ফাঁকি দিয়ে যেকোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম, যা ৩০ হাজার পাউন্ড অস্ত্র বহন করে মাটির ৬০ মিটার পর্যন্ত গভীরে গিয়ে যেকোনো স্থাপনা ধ্বংস করতে পারে। হামলা করেই ক্ষান্ত হননি ট্রাম্প, তিনি ইসরায়েল ও তার বাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং ইরানকে তাঁর ভাষায় শান্তির পথে ফিরে আসতে আহবান জানিয়েছেন।

 

 

এই হামলার বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ডে দেখতে হলে এককথায় এটিই বলা যায় যে ইসরায়েলের পথ ধরে যুক্তরাষ্ট্র যে কাজটি করেছে, তা আন্তর্জাতিক আইন, জতিসংঘ সনদ এবং কূটনীতির জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে একটি কূটনৈতিক আলোচনা চলমান থাকা অবস্থায় প্রথমে ইসরায়েল ইরানে হামলা করে জানিয়ে দিয়েছে যে মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সেটিই মেনে চলতে হবে। দ্বিতীয় যে ঘটনাটি ঘটল, জেনেভায় ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের আলোচনায় কোনো চূড়ান্ত সমাধানের আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের চাওয়ার মূল্য দিতে গিয়ে শান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টাকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করল। এর মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদ, যেখানে কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রে অপর রাষ্ট্রের আঘাত না করার বিষয়টি রয়েছে, তা চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।

 

 

অন্যদিকে জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদে বহিঃশক্তির হামলা থেকে আত্মরক্ষার অধিকারের বিষয়টি লিপিবদ্ধ থাকায় ইরানের পক্ষ থেকে পাল্টা হামলাকে আইনের ব্যত্যয় বলা যায় না।

 

 


তবে এ ক্ষেত্রে সনদের ২৪ ও ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে আন্তর্জাতিক শান্তি এবং নিরাপত্তার স্বার্থে কোনো হুমকি সৃষ্টিকারী দেশের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে সমন্বিত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সেই পথে হাঁটেনি। বরং তারা এটিই প্রমাণ করল যে এ ক্ষেত্রে তারা আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদ কোনো কিছুুরই তোয়াক্কা করে না। এর আগে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত একজন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে যোগ দিয়ে ট্রাম্প কি নিজেকেও একজন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রমাণ করতে চলেছেন?

 


যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলায় আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। নিন্দার ঝড় বইছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি প্রয়োগের ঘটনায় আমি মারাত্মকভাবে শঙ্কিত।’ সৌদি আরব, কাতার, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে।

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়