কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

নির্বাচন ও জনগণের ক্ষমতায়ন ছাড়া অর্থনীতির আশানুরূপ উন্নতি সম্ভব নয়

ড. এম এম আকাশ । সূত্র : বণিক বার্তা, ১৮ মার্চ ২০২৫

নির্বাচন ও জনগণের ক্ষমতায়ন ছাড়া অর্থনীতির আশানুরূপ উন্নতি সম্ভব নয়

অর্থনীতিতে দুটি আপাত ইতিবাচক লক্ষণ আছে। প্রথমত, রেমিট্যান্স পুনরুদ্ধার হয়েছে। দ্বিতীয়ত, রফতানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু রাজনীতি দুর্বল, অস্থির ও অনিশ্চিত হওয়ায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে অগ্রগতি হয়নি।

 

দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক অবস্থা কেমন দেখছেন?

 

 

অর্থনীতিতে দুটি আপাত ইতিবাচক লক্ষণ আছে। প্রথমত, রেমিট্যান্স পুনরুদ্ধার হয়েছে। দ্বিতীয়ত, রফতানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু রাজনীতি দুর্বল, অস্থির ও অনিশ্চিত হওয়ায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে অগ্রগতি হয়নি। তাছাড়া অতীতে ব্যাংক খাতের যে সংকটে অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিল সেটিকে ঠেকানো গেছে। কিন্তু Soft Budget Constraint এড়ানোর কথা বলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তা এড়াতে পারেননি। তাকে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে বা অন্য কোনোভাবে সংগ্রহ করে প্রায় দেউলিয়া ব্যাংকগুলোকে দিতে হয়েছে। এতে আর্থিক খাতে দেউলিয়াত্বের ধস না নামলেও অনেকে বলছেন, এটা ফুটো পাত্রে জল ঢালার শামিল। যদি পরবর্তী সময়ে আবারো এসব ব্যাংককে টাকা জোগাতে হয় তাহলে বিপদ আরো বড় হয়ে ফিরতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছিলেন, টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অর্থ সরবরাহ করা হবে না। কিন্তু তিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছিলেন। পরে আমরা দেখেছি মূল্যস্ফীতি অব্যাহত ছিল। সম্প্রতি কিছু পণ্যের দাম একটু কমেছে বটে, তবে সবকিছু ঠিক থাকা সত্ত্বেও চালের দাম বাড়ছে। কোন চালকল মালিক বা চাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এজন্য দায়ী তা সরকারকে অবিলম্বে খুঁজে বের করে বাজারে চাল সরবরাহ বাড়াতে হবে। সব মিলিয়ে বিপদের আশঙ্কা রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে এখনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি অর্জন হয়নি।

 

অনেকেই বলছেন মূল্যস্ফীতি কমেছে। বাস্তবে মূল্যস্ফীতির আঁচ কতটা কমেছে?

 

 

 

বাস্তবে মূল্যস্ফীতি কমেনি। কারণ মূল্যস্ফীতি হচ্ছে সব পণ্যের দাম একসঙ্গে বৃদ্ধি। সামগ্রিকভাবে সব পণ্যের দাম যে পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল সে অনুযায়ী কমেনি। মৌসুমি শাকসবজির ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি কমলেও একটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ পণ্য চালের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি কমেনি। বাস্কেটের কোনো পণ্য যেমন শীতের শাকসবজিতে মূল্যস্ফীতি মৌসুমি সরবরাহ বাড়ার কারণে সাময়িকভাবে কমেছে। যেহেতু উৎপাদন খরচ বেশি, চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, মজুদদারি ও ব্যয়বৈষম্য অব্যাহত রয়েছে সেহেতু বিকল্প বাজার-বহির্ভূত সরবরাহের ব্যবস্থা করতে না পারলে নিম্ন আয়ের মানুষকে রক্ষা করা যাবে না। আসলে একই সঙ্গে সিন্ডিকেট ভাঙা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো গেলে মূল্যস্ফীতি কমতে পারে। এসব সমস্যা দ্রুত সমাধান করার সম্ভাবনা কম। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ডিসেম্বর বা বড়জোর জুন পর্যন্ত। তার ওপর তারা মুক্তবাজার নীতির বাইরে এখন পর্যন্ত আসতে অপারগ। সুতরাং তারা এর চেয়ে বেশি স্থিতিশীল বাজার অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না।

 

 

বিগত সরকারের পতনের পর অনেকেই ভেবেছিলেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে এবং মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। কিন্তু তা হলো না কেন?

অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক কোনো ভিত্তি নেই। রাজনৈতিক সরকারকে জনগণকে মবিলাইজড করে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। আর রাজনৈতিক সরকার ছাড়া অন্য কেউ জনগণকে মবিলাইজড করতে পারবে না। ড. ইউনূসের পক্ষে গ্রামে গ্রামে গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে জনগণকে মবিলাইজড করা সম্ভব নয়। সেই ম্যান্ডেট তার নেই।

 

 

অন্তর্বর্তী সরকারের সময় অর্থনীতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি?

প্রথমত, লুটপাটের অর্থনীতি আটকানো এবং লুটপাটের অর্থ উদ্ধারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সরকার লুটপাটের অর্থ উদ্ধারের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। লুটপাটের অর্থনীতি ম্যাক্রো পর্যায়ে কিছুটা আটকেছে। মাইক্রো পর্যায়ে এক দখলদারত্বের পরিবর্তে আরেক দখলদারত্বের সৃষ্টি হয়েছে। মাইক্রো পর্যায়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আগে যে ঐক্য ছিল সেটি ভেঙে গেছে। এখন চলছে যুদ্ধ জয়ের পর মালে গনিমতের ধন-সম্পদ-পদের ভাগবাটোয়ারা ও প্রতিশোধের নতুন পর্ব। যে কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমেনি এবং অর্থনীতির উন্নতি আশানুরূপ হয়নি। নির্বাচন ও জনগণের ক্ষমতায়ন ছাড়া তা হবেও না।

 

 

এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে দেশের অর্থনীতিতে কি প্রভাব পড়বে?

এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হলে আমাদের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। কিন্তু এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন না হলে আমাদের ক্ষতি নেই। এর অর্থ হচ্ছে, আমরা এখনো নিম্নমধ্যম আয়ের ফাঁদের মধ্যেই আছি। এ ফাঁদ থেকে বেরোতে গেলেই আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। সুতরাং আমরা একটি অসম বিশ্বায়নে আছি, সেখানেই থাকতে চাই!

 

 

তাছাড়া এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য আমরা প্রস্তুত নই এবং আমাদের ক্ষতিও হবে—এটা সত্য। পিছিয়ে দেয়া হলে আমাদের সমস্যা কোথায়? এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হলে যেসব প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হব, তাতে আমাদের ক্ষতি হবে। সাইনবোর্ডে লেখা থাকল আমরা ধনী দেশ এবং ভেতরে আমরা সে ধরনের ব্যবস্থা করতে পারিনি, তাহলে লাভ কী? তার চেয়ে সাইনবোর্ড না থাকাই ভালো। যেসব কারণে আমাদের নিচের দিকে রাখা হয়েছে সেগুলো ভাঙতে পারলে তখন না হয় আমাদের নাম পরিবর্তন করে নেয়া যাবে। এটাও ভাবা যেতে পারে।

 

 

সরকারি হিসাবে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখের বেশি। কর্মসংস্থান সম্প্রসারণও আশানুরূপ হচ্ছে না। এটি অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে?

কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আশু কোনো উন্নতির লক্ষণ দৃশ্যমান নয়। মূলত এর জন্য দরকার বিনিয়োগ। কিন্তু বর্তমানে দেশে দেশীয় কিংবা বিদেশী বিনিয়োগ কোনোটিই হচ্ছে না। যা রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় অর্জিত হচ্ছে তার সিংহভাগ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণশোধ ও ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্যই চলে যাচ্ছে। বিনিয়োগযোগ্য তহবিল কমই থাকছে। থাকলেও বিনিয়োগ না হওয়ার জন্য অন্য দুটি কারণ রয়েছে। এক. রাজনৈতিক এবং দুই. আইএমএফের পলিসির কারণে সুদহার বেড়ে গেছে। এসব কারণে উদ্যোক্তারা যথাযথ উৎসাহ-উদ্দীপনা পাচ্ছেন না, ব্যাংক থেকে টাকা পাচ্ছেন না বা নিচ্ছেন না। শাসক শ্রেণী আগামীতে কারা হবেন সে বিষয়ে নিজস্ব সঞ্চয়ের মালিক বিনিয়োগকারী ধনিক শ্রেণী এখনো কোনো নিশ্চয়তাও পাচ্ছে না। তারা ভাবছেন, কোন সরকার ক্ষমতায় আসে, এখনই আমরা বড় কোনো বিনিয়োগ করব না!

 

 

শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ এখনো বেকার। তারা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কোনো কর্মসংস্থান পাচ্ছে না। চাকরিতে সমসুযোগ পাওয়ার জন্যই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সে আকাঙ্ক্ষা কতটুকু রূপ পেল?

যত দিন যাচ্ছে তারা তত আশাহত ও বিক্ষুব্ধ হচ্ছে। নির্বাচনের পরও ভালো ফল না পেলে দ্বিতীয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু করে কিনা সেটি দেখার বিষয়। নাকি আবার জায়গায় জায়গায় লুটপাটের বাহক হিসেবে বিভক্ত হয়ে একেক দলের মধ্যে ক্লায়েন্ট হয়ে ঢুকে যাবে? তার ওপর নির্ভর করবে আমরা কি আবার একটি পুরনো দ্বিদলীয় লুটপাটের বন্দোবস্তে ফিরে যাব নাকি একটি সুস্থ গণতন্ত্র তৈরি হবে যেখানে শাসককে শক্তিশালী জনগণের কাছ জবাবদিহি করতে হয়। বর্তমান সরকারের উচিত ছিল আগের সরকারের অপরাধীদের কঠোরভাবে ধরা, দ্রুত শাস্তি দেয়া, তাদের সম্পদ দ্রুত বাজেয়াপ্ত ও পুনর্বণ্টন করা এবং মৌলিকভাবে কতগুলো অর্থনৈতিক সংস্কার ও জনগণের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন করা। এ কথা সত্য যে সাত মাস এগুলো করার মতো যথেষ্ট সময় নয়। তবে এ সরকার তা চেয়েছে কতটুকু সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। আবার নিজেদের মধ্যে আদর্শ ও ইচ্ছার ঐক্য না থাকায় এবং আমলাতন্ত্রের অসহযোগিতার কারণেও সরকারের সর্বোচ্চ ক্ষমতা হচ্ছে একটি ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’। শিক্ষিত যুবকদের এখন আগামী নির্বাচনে জনগণ যাতে তার ভোটাধিকার ঠিকভাবে প্রয়োগ করে সে চেষ্টাই করা উচিত।

 

 

নির্বাচন নিয়ে আপনার মতামত কী?

আমি মনে করি, এ সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। অন্তর্বর্তী সরকার কোনো পদক্ষেপ ঠিকমতো নিতে পারছে না। নিজেদের মধ্যে অনৈক্য। এগুলোর বদলে একটি নির্বাচিত সরকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা, বিদেশীদের মধ্যে আস্থা, বিনিয়োগ বাড়াতে সক্ষম হলেও হতে পারে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হলে নির্বাচিত সরকারের প্রতি জনগণেরও আস্থা তৈরি ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে। দ্রুত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়া উচিত। এমন নির্বাচন যদি দেয়া হয় যার মাধ্যমে পুরনো স্বৈরাচার এবং তাদের দোসররাই পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় বা সে ধরনের দুর্নীতিপরায়ণ বা স্বজনপ্রীতিপরায়ণ লোক অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঢুকে নির্বাচিত হয়ে আসে, তাহলে হবে না। তাই নির্বাচন প্রক্রিয়াটি হতে হবে পেশিশক্তি, অর্থশক্তি ও ম্যানিপুলেশনমুক্ত। অর্থাৎ এই তিনের প্রভাবমুক্ত একটি নির্বাচন। সুতরাং নির্বাচনী সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটি করে দ্রুত নির্বাচন দেয়াই উত্তম। তাছাড়া অন্যান্য সংস্কারের কথা বললেই এ সরকার সেটি করতে পারবে না। আর অন্যান্য সংস্কার শুরু করলেও সেটি শেষ হবে না। বড় আকারের সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোও চায় না। বড় আকারের সংস্কার কেবল জাতীয় নাগরিক কমিটি ও জামায়াতে ইসলামী চায়। এ দুই দলের সমর্থন নিয়ে সংস্কার করতে গেলে আরেক ধরনের অগণতান্ত্রিক শাসন তৈরি হবে আর গৃহবিবাদও বাড়বে।