নির্বাচনে সেনাবাহিনীর প্রাসঙ্গিকতা
মোস্তফা কামাল [সূত্র : ইত্তেফাক, ২১ আগস্ট ২০২৫]

নির্বাচন, ভোট, ভোটারের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা অত্যন্ত গভীর মনোযোগ এদিকে। সেই প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশ ও আনসারের পাশাপাশি মোতায়েন করা হবে সেনাবাহিনীর ৮০ হাজারেরও বেশি সদস্যকে। থাকবে র্যাব বিজিবি ও নৌবাহিনীর সদস্যরাও।
এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। নির্বাচনকালীন প্রয়োজন ও আবশ্যকতাদৃষ্টেই আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে সরকারের এমন প্রস্তুতি। সেই সঙ্গে জন-আকাঙ্ক্ষার বিষয়ও রয়েছে। গেল আন্দোলনের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সন্ধিক্ষণে সেনাবাহিনীর ভূমিকা মানুষকে কেবল স্বস্তি দেয়নি, আগামী নির্বাচনে বাহিনীটির যথাযথ ভূমিকার আশাও জাগিয়েছে। এছাড়া, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অভিপ্রায় সেই আশাবাদে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে।
কোনো ব্যত্যয় না ঘটলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনের পর নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নেবে অন্তর্বর্তী সরকার-এই অপেক্ষায় নির্বাচনমুখী দল ও ভোটাধিকার প্রয়োগে আগ্রহী মানুষ। ৮ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের বর্ষপূর্তিতে পরিষ্কার করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মালয়েশিয়া সফরকালে আরো খোলাসা করে বলেছেন, 'আমরা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছি, যাতে জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়।' কথার মাঝে আর কোনো ফাঁক বা 'তবে-কিন্তু-যদি'র ব্যবহার করেননি তিনি।
নির্বাচনকে ঐতিহাসিক, প্রশ্নমুক্ত, অবাধ, সুষ্ঠু করতে গেলে নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার কোনো বিকল্প নেই। আর আইনশৃঙ্খলার প্রতীক বলতে মানুষের সবার আগে চোখ যায় পুলিশের দিকে। পুলিশ কোন দশায় আছে তা ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই। সেখানে বিশেষ ভরসা সশস্ত্র বাহিনী। তারা ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে মাঠে আছে বলেই জননিরাপত্তা আজকের অবস্থায় রয়েছে। নইলে পরিস্থিতি কোথায় গড়াত, তা ভাবনায় অকুলান। আশা করা যায়, আসন্ন নির্বাচনের সময়ও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়েই তারা মাঠে থাকবে, যা নির্বাচনে হাইভোল্টেজ কোরামিন হয়ে কাজে দেবে।
টানা গত তিনটি নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে রাখা হয়েছিল স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে। সেনাবাহিনীকে নির্বাচনে সম্পৃক্ত করা হলে চিত্র ভিন্ন হতে পারত। এবার একদিকে জন-আকাঙ্ক্ষা, আরেক দিকে মাঠের বাস্তবতা বুঝে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানোর একটি সুযোগ ও বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচনগুলোর নানা ত্রুটিবিচ্যুতি, দখলবাজির পর ১৯৯১ সালে তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সুষ্ঠু নির্বাচনের সদিচ্ছা নিয়েও এমন ভাবনা ও সংশয় ছিল। উৎকণ্ঠা ছিল তখনকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি রউফেরও। তবে বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সুষ্ঠু-অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের নজির তৈরি হয় ১৯৯১ সালে। ঐ নির্বাচনে সেনাবাহিনীর নেপথ্য ভূমিকা উহ্যই ছিল।
কিছুদিন আগে, ঐ সময়কার সেনাপ্রধান জেনারেল নূরউদ্দিন খান কিঞ্চিৎ মুখ খুলেছেন ঐ নির্বাচনে সেনাবাহিনীর নেপথ্য ভূমিকা নিয়ে। বলেছেন, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন একদিন তাকে বলেছিলেন, তাকে একটি চমৎকার নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তা সেনাশাসন দিয়ে নয়, সেনাবাহিনীর অধীনে বা তত্ত্বাবধানে নয়, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বেও নয়। নূরউদ্দিন খান যা বোঝার বুঝে নেন। পুলিশ থেকে শুরু করে আনসার পর্যন্ত সবার সঙ্গে সেনাবাহিনীকে মিলিয়ে দিয়ে তিনি এমন একটা ম্যাজিক্যাল ব্যবস্থা করেন, যা ঐ নির্বাচনটিকে ঐতিহাসিক মানদণ্ডে নিয়ে যায়।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যকর ঐক্য এখনো আসেনি। ফ্যাসিস্টের পতন হলেও বিদায় নেয়নি। স্বাধীন দেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম নির্বাচনেই আচানক মডেল দেখেছে মানুষ। ব্যালট বাক্স লুট থেকে শুরু করে দলের প্রায় সব প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণার নির্বাচনের ঐ মডেল ভোটের জন্য আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর ইমেজে চরম আঘাত হানে। খাস পছন্দের খন্দকার মোশতাককে (পরবর্তী নাম খুনি মোশতাক) জয়ী দেখাতে ব্যালট বাক্স কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এনে অধিকতর সঠিক ফলাফল দেওয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত। এরপর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে হ্যাঁ-না ভোট, আওয়ামী লীগকে নৌকা-মই ইত্যাদি চার ভাগে সিট বণ্টনসহ নানা মডেল শো। এ শোতে আরো নতুনত্ব আসে জেনারেল এরশাদের জমানায়। নির্বাচনের এই সিরিজ মডেল শোতে প্রথম ব্যতিক্রম আসে এরশাদ পতনের পর ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে।
স্বাধীন দেশে প্রথম স্বাধীন নির্বাচনের স্বাদ পায় মানুষ। তারপর বিচারপতি হাবিবুর রহমান, লতিফুর রহমান, ফখরুদ্দীনদের তত্ত্বাবধায়ক জমানায় নির্বাচনের মোটামুটি একটি মডেল চলতে থাকে। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশে নির্বাচনি নাশকতা। হতে হতে ২০১৪ সালে বিনা ভোটেই ১৫৪ জনকে জয়ী ঘোষণার রেকর্ড। ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে এবং ২০২৪ সালে এসে যোগ হয় ডামি-আমি মডেল। মহাপরাক্রমশালী হওয়ার পরও ছাত্র-জনতা তাদের বিতাড়ন করেছে। এ কাজে দেশপ্রেমের
সারথি হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
এ প্রশ্নে সেনাবাহিনী আর সেনা থাকেনি। তারাও জনতা হয়ে গেছে। এখনো মাঠে আছে জনতার কাছাকাছি। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে খবরদারি করছে না; বরং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সহায়তা করছে। জননিরাপত্তা, অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজকতা প্রতিরোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কারসাজি রুখে দেওয়া, মিলকারখানা সচল রাখা, রাষ্ট্রের কেপিআইভুক্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাগুলোকে রক্ষা, সড়ক-মহাসড়ক বাধামুক্ত রাখা, অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনী যেভাবে করে যাচ্ছে, তা বিবেকবানরা উপলব্ধি করছেন মর্মে মর্মে। মাদক কারবারি ও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেফতার, বিভিন্ন চিহ্নিত অপরাধী ও নাশকতামূলক কাজের ইন্ধনদাতা-পরিকল্পনাকারীদের গ্রেফতারে পুলিশি কাজও করে চলছে সেনাবাহিনী।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ভূমিকা একটি বহুমাত্রিক এবং গভীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বাহিনীর গৌরবময় আত্মত্যাগ ও নেতৃত্ব একদিকে যেমন জাতীয় পরিচয় নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে পরবর্তীকালে বারবার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এই গৌরবময় ইতিহাসকে বিতর্কিত করে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঘটনার পর এবং ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে সশস্ত্র বাহিনী কেবল অংশীজন নয়, বিজয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারীও। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমে ও জনমনে বাড়তি ভরসা জুগিয়েছে।
তিনি বলেছিলেন, 'আমরা একটি গ্রহণযোগ্য নতুন সরকার দেখতে চাই। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের কোনো ইচ্ছা নেই। স্বাধীনতা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব; কিন্তু রাজনীতির নেতৃত্ব রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকা উচিত।'
সেনাপ্রধান স্পষ্টভাবে আরো বলেন, 'যথাশীঘ্রই সম্ভব একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।' বিশ্ব জুড়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা পরিবর্তিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ বেসামরিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে, যেখানে তাদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা কঠোরভাবে সংরক্ষিত। অন্যদিকে পাকিস্তান, তুরস্ক বা মিশরের মতো দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ এখনো রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশ। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী একটি মধ্যবর্তী পথে হাঁটছে। এখানে তারা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ভরসার নাম। এমন একসময়ে তারা পাশে দাঁড়িয়েছে, যখন সামনে একটি নির্বাচন এবং যখন ভোটের সংস্কৃতি বরবাদের হোতাদের বিচার চলছে। তাই সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উচ্চাশা এবার ব্যাপক।
নানা ঘটনা ও ভূমিকার কারণে শুধু নির্বাচন নয়, ভালো কিছুর জন্য মানুষের মধ্যে সেনাবাহিনীকে পাশে পাওয়ার তাড়নাও কাজ করে। সেনাবাহিনীর অধীনে নির্বাচনের কথা অনেক বার এসেছে। বিরোধী দলে থাকলে এ দাবি যত জোর দিয়ে উচ্চারণ করা যায়, সরকারে গেলে কথা ও সুরে বদল আসে। আবার বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন যত না 'রেওয়াজ', তার চেয়ে বেশি 'প্রয়োজন'। এবারের প্রেক্ষিত ভিন্ন। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান স্পষ্ট করার ইতিহাস তৈরি হয়েছে চব্বিশের গণআন্দোলনের চূড়ান্ত বা মোক্ষম সময়ে। তাদের এ গণতান্ত্রিক ভূমিকা একটি মডেল ও ইতিহাস হয়ে থাকবে। সামনে নির্বাচন এবং সেখানেও এই সশস্ত্র বাহিনীর কারণেই মানুষ মনে করছে এ দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ একটি গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার পথে নতুন যাত্রা শুরু করবে কাঙ্ক্ষিত নতুন বাংলাদেশ, যা আরো মাত্রা যোগ করবে কাঙ্ক্ষিত সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনে বাহিনীটির ভূমিকার মধ্য দিয়ে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট