নির্বাচনী সংস্কারের কিছু ভাবনা
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সূত্র : আমাদের সময়, ১১ নভেম্বর ২০২৪

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে ৬টি প্রধান সংস্কারের ক্ষেত্র চিহ্নিত করে কাজ শুরু করেছে তার মধ্যে অন্যতম নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী আইন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা সংস্কার। যথার্থই এর দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়েছে তাদের বেশির ভাগ, প্রধানসহ এ কাজের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি তাতে সন্দেহ নেই। এরই মধ্যে আমার জানামতে কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি সেমিনারও অনুষ্ঠিত হয়েছে যার দু-একটিতে আমি উপস্থিত ছিলাম এবং এ বিষয়ে আমার কিছু মতামত তুলে ধরেছিলাম। এরই কিছু বিষয় তুলে ধরার প্রয়াসে আমার এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
প্রথম যে বিষয়টি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আর সেটি হলো নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া। স্মরণযোগ্য যে, ২০২২-এর আগে কোনো ধরনের আইন ছাড়া নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে মূলত ক্ষমতাসীন সরকারের পছন্দ-অপছন্দের তালিকা থেকে। এমনকি ২০২২-এর আগে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে একটি সার্চ কমিটি গঠিত হলেও তার ফলাফল ছিল রাতের ভোটের নির্বাচন কমিশন। পরবর্তীতে গত কমিশন যারা একটি প্রহসনের নির্বাচন আমরা আমরা অনুষ্ঠিত করে ভোটের হার বাড়িয়ে দেশবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করেছিল, যা দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয় এবং ২০১৪ সাল থেকে ক্রমাগত অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে চরম স্বৈরাচারী বা ফ্যাসিবাদী সরকার কায়েম হয়, যার পরিণতি মাত্র সেদিনের ঘটনা। রক্তের স্রোতে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়ে বর্তমানে আইনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এ বিষয়ে আমার পূর্বতন লেখাগুলোতে স্পষ্ট করেই বলেছি যে, অগ্রহণযোগ্য-ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হয় সে সরকারকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, হাইব্রিড বা কথিত নির্বাচনের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্র গঠিত হয়। এই তত্ত্ব-প্রমাণে বেশিদূর যেতে হয়নি হাসিনার সব সময়ের শাসন এবং হাজার তরুণের রক্ত এবং কয়েক হাজার পঙ্গুত্ব অতঃপর ক্ষমতা ও দেশ ছেড়ে পলায়নই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্বের প্রমাণ। কাজেই সর্বজনীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনের বিকল্প নেই। গ্রহণযোগ্য, বিশ^াসযোগ্য এবং স্বেচ্ছায় ভোটার উপস্থিতির দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমেই জবাবদিহিমূলক সরকার গঠিত হতে হবে, যার জন্য গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি দ্বারা গঠিত নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই। যদিও সময়ের স্বল্পতার কারণে পূর্বতন আদেশে গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে এবার কমিশন গঠিত হতে পারে। তবে স্থানীয়ভাবে কমিশন গঠনে প্রধান ও অন্য কমিশনারদের নির্বাচনে একটি আইনের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
এই আইন প্রণয়নের বিষয়টি বহুবার বহুভাবে আমিসহ অনেকেই লিখেছি। যেহেতু এখন নির্বাচনবিষয়ক একটি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে সেহেতেু আমি মনে করি এই আইনটি প্রথমে অধ্যাদেশ আকারে জারি করে আগামী কমিশন গঠিত হোক। আমার সুপারিশ ছিল তিন ধাপে নির্বাচন প্রক্রিয়ার। যাই হোক আইনের দ্বারা নির্বাচিত কমিশন প্রাথমিক অবিশ^াসের আবর্তে পতিত হওয়ার কথা নয়, কারণ এ প্রক্রিয়ায় সংসদের রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য দলের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে।
কমিশন গঠন প্রক্রিয়ার বাইরেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ সংক্ষেপে আলোচনার প্রয়াসে নিম্নে তুলে ধরলাম।
ইদানীং নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আসার বিতর্ক রয়েছে। সন্দেহ নেই বাংলাদেশ অলিখিতভাবে দ্বিদলে বিভক্ত। বিগত সরকারগুলো গঠনে এমনই দেখা গিয়েছে। বিশেষ করে ১৯৯০-এর পর থেকে যখন গণতন্ত্রের কাঠামো প্রবর্তন হয়েছিল। এখন সময় সংসদে আরও দলের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করা, যাতে সংসদ প্রাণবন্ত এবং অধিকতর অংশগ্রহণমূলক হয়। সে কারণে আমার সুপারিশ ছিল এবং রয়েছে ন্যূনতম পক্ষে ১৫০টি আসনে আনুপাতিক হারে নির্বাচন পদ্ধতির প্রবর্তন। অবশ্য আগে থেকেই ন্যূনতম ভোটের হার নির্ণয় করতে হবে। এরই জের ধরে আমার সুপারিশ যে, বর্তমানে সংসদে সংরক্ষিত নারী কোটার অবসান ঘটিয়ে ৩৩ শতাংশ নারীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হোক। সে ক্ষেত্রে ফাস্টপাস্ট দি পোস্ট পর্যাপ্ত না হলে আনুপাতিক হারের মাধ্যমে নির্বাচিত হতে পারে।
ওপরের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে প্রধান দলগুলোর মতানৈক্যের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এর বিপরীত সুপারিশ হলো বর্তমানের সংসদীয় আসন ৩০০ থেকে ৪০০তে উন্নীত করে ১০০ আসনে নারীদের নির্বাচনের জন্য আনুপাতিক হারে সরাসরি ভোটের প্রবিধান করা। সে ক্ষেত্রে নারী সংসদ সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। পার্টি দ্বারা নির্ধারিত নয়। বিগত সংসদগুলোতে সরাসরি কোটার কারণে নারী প্রতিনিধিরা বহুলাংশে বিতর্কিত হয়েছেন। আমি মনে করি ৩০০ আসনে না হলেও অন্তত এই ১০০ আসনে ক্লোজড পার্টি লিস্টের প্রক্রিয়ায় নারী সদস্য নির্বাচিত হোক। এই দুই ক্ষেত্রেই সংবিধানের ধারা এবং সংশোধন প্রয়োজন হবে। তবে নারী সদস্যদের পরোক্ষ নির্বাচনে নিয়োগ বর্তমানের প্রেক্ষাপটে আধুনিক ও শিক্ষিত নারী সমাজের জন্য সুখকর নয়।
নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীনভাবে তার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র প্রস্তুতিতে সংবিধান ও নির্বাচনী আইনের বেশ কিছু সংযোজন এবং বিয়োজনের প্রয়োজন রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি উল্লেখ করা প্রয়োজনীয়। সংবিধানের ১২৬-এর ধারায় বিগত দিনে যে সংশোধনী আনার প্রয়োজন ছিল সেটা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে। যা হওয়া এবং প্রয়োজনীয় বলে অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় তা হলো, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর হতে গেজেট প্রজ্ঞাপিত না হওয়া পর্যন্ত আদালত নির্বাচনী বিষয়ে কোনো ধরনের মামলা গ্রহণ করিবে না।’ নির্বাচনী প্রক্রিয়া সমাপ্তির পর আদালত নির্বাচন সময়ের যে কোনো অভিযোগের শুনানিকরত নির্দেশনা দিতে পারিবে।’ অতীত অভিজ্ঞতায় অনেক ক্ষেত্রে কমিশনকে বিব্রত ও প্রশাসনিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে, বিশেষ করে নমিনেশন বাছাই ও বাতিলের ক্ষেত্রে। এসব ক্ষেত্রে নির্বাচন প্রক্রিয়া চলমানকালে বহু মামলায় অন্তরীণ রায়েও বাতিলকৃত নমিনেশন গ্রহণ করতে হয়েছে এবং এ ধরনের রায়ে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রশাসনিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। নির্বাচনী আইনেও প্রচুর সংশোধনীর প্রয়োজন রয়েছে। বেশ কিছু অসামঞ্জস্যতা রয়েছে যা দূর করা প্রয়োজন। এসব বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে তবে বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্র উল্লেখ করা হলো।
প্রায় সব জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপ্রতুলতার কারণে সামরিক বাহিনী নিয়োজিত করা হয় কিন্তু এসব বাহিনী অন্যান্য বাহিনীর মতো সরাসরি নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে ২০০৮-এর পর থেকে আর দেওয়া হয়নি। কারণ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা সংজ্ঞা থেকে বাদ দেওয়া হযেছে। বর্তমানে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার নিমিত্তে নিয়োগ দেওয়া হয়, যার পরিচালনা ও নির্দেশনা আইনত ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা প্রশাসকের আওতায় থাকে যা নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকারিতায় ব্যাঘাত ঘটায়। অবশ্যই এখানে পরিবর্তন প্রয়োজন। আরপিও-এর ধারা ৩৭ এবং ৩৮-এ পুনঃগণনায় ৩৭(৫) (এ) ব্যতিরেকে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা রাখা হয়নি, যার কারণে নির্বাচন কমিশনকে রিটার্নিং অফিসারের সনদকেই সঠিক ধরে গেজেট করতে হয়। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কিছু ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত।
নির্বাচন প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ সময়ে নির্বাচন কমিশনকে ওই সময়কার সরকারের প্রশাসনিক কার্যক্রমের ওপর নজরদারির ক্ষমতায়ন অবশ্যই প্রয়োজন বলে অভিজ্ঞতা ও গবেষণালব্ধ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয় নিয়ে বহু সুপারিশ এবং লেখালেখি হয়েছে।
নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত সব সরকারি ও আধাসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ন্যূনতম ৩০ দিন নির্বাচন কমিশনের আওতায় রাখা বাঞ্ছনীয়, যা বর্তমানে মাত্র ১৫ দিনের জন্য উল্লেখিত রয়েছে এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার যে কোনো সময়ে অথবা পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে যদি কোনো নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায় সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের আদেশকৃত যে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সরকারকে বাধ্য থাকতে হবে। বিদ্যমান ধারায় অস্পষ্টতা থাকার কারণে বিগত সরকারগুলো কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। নির্বাচনী কর্মকর্তা কর্তৃক নির্বাচনভিত্তিক যে কোনো অসদাচরণের কারণে অতীতে কোনো সরকারি অথবা আধাসরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
এ পর্যায়ে সর্বশেষ জোরালো সুপারিশ যে, আরপিও-এর চ্যাপ্টারের ধারা ৯১(এ)কে পূর্ণাঙ্গ বহাল করা হোক।
সেখানে উল্লেখিত ছিল যে, কোনো সংসদীয় আসনের নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলাকালীন আংশিক অথবা সম্পূর্ণ আসনের নির্বাচন স্থগিত এবং বাতিলের ক্ষমতা পুনর্বহাল করা হোক। বিগত সময়ে বিশেষ করে আউয়াল কমিশনের সময়ে এই ধারায় যে পরিবর্তন করা হয়েছিল তা এই ধারার বিপরীত ছিল। এখানে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়েছিল। এমনি বহু ধারার পরিবর্তন করা হয়েছিল, সেগুলোর সংস্কার এবং পুনর্বহালের প্রয়োজন রয়েছে।
ওপরের বর্ণিত কিছু কিছু জায়গায় সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে তা পূর্ণাঙ্গ নয়। তবে আরপিও এবং সংবিধানের কিছু ধারার পরিবর্তন না করলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সঠিক নির্বাচন করা বেশ কঠিন হবে।
সর্বশেষ আমি মনে করি ভবিষ্যৎ প্রশাসন এবং নির্বাচনের তত্ত্বাবধানের জন্য নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন রয়েছে এবং এ প্রয়োজনের স্থায়ী সমাধানকল্পে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে, উচ্চকক্ষের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
ওপরের আলোচনায় যে সুপারিশগুলো উল্লেখিত হয়েছে তা আমার নিজস্ব মতামত মাত্র।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা, সাবেক নির্বাচন কমিশনার