কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

নির্বাচনের রোডম্যাপ দিলেও সংকট সহজে কাটবে না

ড. সুলতান মাহমুদ রানা সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

নির্বাচনের রোডম্যাপ দিলেও সংকট সহজে কাটবে না

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনিশ্চয়তার মেঘ লেগেই আছে। পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনও কোনোভাবেই চোখে পড়ছে না। সাম্প্রতিককালে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য-বিবৃতিতে রাজনীতির মাঠে উত্তাপ-উত্তেজনা বেড়ে চলেছে। এ ছাড়া বেফাঁস বক্তব্য, প্রতিপক্ষকে আক্রমণ, পাল্টা-আক্রমণ চোখে পড়ার মতো।

 

এমনকি সংস্কার-নির্বাচন প্রসঙ্গ নিয়ে এক ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এমন দ্বন্দ্ব ক্রমেই সংঘাতের দিকে এগোতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণের মনে উদ্বিগ্নতা বাড়ছে। এ থেকে আদৌ পরিত্রাণ পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সাধারণের মধ্যে সংশয় রয়েছে অতিমাত্রায়।

 

রাজনীতি মানেই যেন দ্বন্দ্ব, সংঘাত, অশ্রদ্ধা এবং অপসংস্কৃতি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার করে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচন করার রোডম্যাপ না দিলে মাঠের আন্দোলন শুরু করতে পারে বিএনপি। নবগঠিত এনসিপি চায় সংস্কার ও জাতীয় পরিষদ নির্বাচন। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী এখন মাঝামাঝি অবস্থানে।

 

 

তারা বলছে, নির্বাচন এবং সংস্কার সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ বছর (২০২৫) ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।’ তিনি বারবার নির্বাচন নিয়ে একই ধরনের বক্তব্য দিলেও কিছু কিছু রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে তাদের স্থির মনোভাব পোষণ করছে না। সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো কেন বিষয়টি অনুধাবন করছে না সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তারা অভিযোগ তুলছে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে কথা বললেও সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়া হচ্ছে না।

 

এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, নির্বাচনের ঘোষিত সময় ঠিক থাকলে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেওয়ার যথেষ্ট সময় সরকারের হাতে রয়েছে। তবে ডিসেম্বর থেকে জুন—এই বড় সময় নিয়ে একটি বিতর্ক রয়েছে। নির্বাচনের বিষয়টি এমন হওয়া উচিত যে ডিসেম্বর না হলে জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারির মধ্যে হতে পারে। কিন্তু ডিসেম্বর না হলে জুনের মধ্যে হবে—এমন বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক।

 

 

নির্বাচন কখন হবে, কিভাবে হবে এ বিষয়ে নবগঠিত এনসিপির মতামত ও অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাজনীতিতে তারা এখন গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-তরুণদের এই দলটি ‘কিংস পার্টি’ হিসেবেও পরিচিতি পাচ্ছে। সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন এখন এই দলটির মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছে। তারা কখন কিভাবে নির্বাচন চাইবে, কোন সময় চাইবে—এসবের সঙ্গে সরকারের সদিচ্ছার প্রসঙ্গটি থাকতে পারে বলে অনুমান করা যায়। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে বলেই সাধারণভাবে অনুমান করা হচ্ছে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাস অতিবাহিত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত নির্বাচনের যেমন রোডম্যাপ সরকারের পক্ষ থেকে আসেনি ঠিক তেমনি কোনো রাজনৈতিক দলও তাদের জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক রোডম্যাপ যথাযথভাবে ঘোষণা করেনি। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করতে কিংবা জনসমর্থন বাড়াতে কোনো ধরনের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি। চোখে পড়ার মতো কোনো রাজনৈতিক রোডম্যাপ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে জনগণ পাচ্ছে না। জনগণের কাছেও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বার্তা পৌঁছাচ্ছে না। বরং বিএনপির মতো বড় দলের আন্তঃকোন্দল বেড়েই চলেছে।

 

 

যেকোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য হলো জনগণের কল্যাণ সাধন করা। এ ক্ষেত্রে জনগণ যেভাবে চায় ঠিক সেভাবেই তাদের কাজ করতে হয়। নির্বাচনের দিন-তারিখ ঠিক হলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তাও কিন্তু নয়। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কি না, গ্রহণযোগ্য ও অবাধ হওয়ার জন্য সব পদক্ষেপ যথাযথভাবে গ্রহণ করা হবে কি না, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, এ সংশ্লিষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো সরকার কিভাবে মোকাবেলা করবে—এসব নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। কাজেই নির্বাচন এগিয়ে আসা মানেই সব সংকটের অবসান ঘটা তেমনটি আশা করার কোনো কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

 

 

আমরা আশা করব, সব দল এবং দলের নেতারা সহনশীল হবেন, সংযত হবেন। অতীত বা বিগত দিনগুলোর অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে দেশবাসীর কল্যাণের রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হবেন, যাতে দেশ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারায় চলতে পারে, যাতে দেশে কোনো অপশক্তি মাথাচাড়া দেওয়ার মতো অবস্থা ভবিষ্যতে সৃষ্টি না হয়। রাজনীতিতে টানাপড়েন বাড়তে থাকলে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাড়তে থাকবে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে সব পক্ষকে একটি যথাযথ এবং ন্যায্য দিকে হাঁটতে হবে। কারণ যথাযথ রাস্তায় হাঁটতে না পারলে কোনোভাবেই দেশে ইতিবাচক রাজনীতির সূত্রপাত হবে না। এ কারণে প্রয়োজন একটি উইন-উইন পরিস্থিতি। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক পক্ষকেই বিশেষ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে রাজনীতির মাঠে থাকতে হবে। সব পক্ষ থেকে ছাড় দিতে না পারলে কোনোভাবেই উইন-উইন পরিস্থিতি আশা করা যায় না।

 

 

যেকোনো রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া। বৈধ এবং সাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দল পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক দলগুলো জোট গঠন করেও ক্ষমতায় আসে এবং আসার চেষ্টা করে। আমাদের দেশে বিদ্যমান নামসর্বস্ব দলগুলোর কোনো জনসমর্থন নেই। সম্প্রতি বিবিসি জরিপ থেকেও কিছুটা অনুমান করা যায় যে কোন দলের কেমন জনভিত্তি রয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আওয়ামী লীগ একটানা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় তাদের নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তি অন্য যেকোনো দলের তুলনায় ভালো। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে আওয়ামী লীগ সক্রিয় রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করে রেখেছে।

 

 

ভোটের রাজনীতিতে বিজয়ী হওয়ার একমাত্র হাতিয়ার হলো সাংগঠনিক ভিত্তি ও জনসমর্থন। দলের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত না হলে এবং জনসমর্থন না থাকলে সেই দল নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে না। প্রসঙ্গত বলতে হয় যে নতুন দলগুলোর উচিত সাধারণ মানুষের জন্য ব্যতিক্রমী চিন্তা বা জনমুখী কর্মসূচি নিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বাস্তবতাবিবর্জিত রাজনৈতিক দর্শনের কারণেও অনেক দল মানুষের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে না। ফলে জনসমর্থনও বাড়ে না। এতে নির্বাচনের ফলাফলও নেতিবাচক হয়।

 

 

কাজেই নতুন নতুন রাজনৈতিক ভাবাদর্শ সৃষ্টির যে প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে আমরা লক্ষ করছি, সেটি সত্যিকার অর্থে কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করবে কি না সেটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। জনসমর্থন বাড়ানোর রাজনৈতিক কর্মসূচি গঠনই রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভুল সিদ্ধান্ত এবং ভুল কার্যক্রমের কারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে মাসুল দিতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবেই চিন্তা করুক না কেন, দিনশেষে তাদেরকে জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবেই।

 

লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়