কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

নির্বাচনের স্বপ্ন দেখছে দেশের মানুষ

মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন [প্রকাশ: সময়ের আলো, ১৩ জুন ২০২৫]

নির্বাচনের স্বপ্ন দেখছে দেশের মানুষ
আশা করা যায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি থাকবে শতভাগ না হলেও কাছাকাছি। জনমত জরিপ করলে দেখা যাবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সাধারণ ভোটারের আগ্রহ তুঙ্গে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন নিয়ে নানা সময় নানা রকম কথাবার্তা হয় কিন্তু কমিশনের দেওয়া সিদ্ধান্ত কেউ মেনে নেয়নি এমন নজির খুবই কম। এ কথাও ঠিক যে নির্বাচন কমিশনের সব বিবৃতিই যে মেনে নেওয়ার মতো তা কিন্তু নয়। কমিশনের দেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত বা ডিরেকশনের ব্যাপারে কারও মনে যদি কোনো প্রশ্ন কিংবা সন্দেহ দেখা দেয় তা সে প্রকাশ করতেই পারে।
 
 
 
টানা ১৫ বছর শাসন-শোষণের পর আওয়ামী লীগের বিদায় জনমনে স্বস্তি এনেছে। মানুষের চাওয়া-পাওয়ার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সেই জায়গাটায় আছে। যারপরনাই বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে একটা নির্বাচনের জন্য। অন্তর্বর্তী সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ অংশগ্রণমূলক নির্বাচন উপহার দেবে সে আশায় বুক বেঁধে আছে গোটা জাতি। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া টিভি ভাষণে বলেছেন ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
 
 
 
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সহ আরও বেশ কয়েকটি দল নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়ার জন্য বারবার চাপ দিচ্ছিল। হয়তো সেই চাপেরই ফল প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করবে। ইতিমধ্যে তফসিল ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
 
 
 
নির্বাচন হবে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এমন কথা বলে চুপটি মেরে বসে আছে সরকার। এপ্রিলে নির্বাচন হবেই এ রকম কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষ দেখতে পাচ্ছে না।
 
 
 
বেশ কয়েক দিন আগেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছিলেন ২০২৫ সালের শেষ অথবা ২০২৬ সালের শুরুতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। খবরটা জেনে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বেশ আনন্দিত হয়েছিল। প্রত্যাশা করছিল একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ অংগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনে তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। নির্বাচন ও নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে নানারকম কথা হচ্ছে, চাল চলছে। কূটচাল চালা হচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে ২০২৬ এর এপ্রিলের মধ্যেই নির্বাচন হবে।
 
 
 
যারা নতুন ভোটার হয়েছে তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। জীবনের প্রথম ভোট বলে কথা। ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে চিন্তা করেই তাদের আনন্দের সীমা নেই। মাত্র কয়েক দিন পরই তারা প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। দেশের নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। নাগরিক মর্যাদার আসনে আসীন হবে। এসব চিন্তা করে নতুন ভোটার প্রজন্ম স্বপ্নে বিভোর। তাদের সেই স্বপ্ন কবে পূরণ হবে তাই ভাবনার বিষয়।
 
 
 
ভোটাধিকার একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার থেকে সরকার বা রাষ্ট্র কেউ তাকে বঞ্চিত করার বা রাখার অধিকার রাখে না। গণতান্ত্রিক দেশে তো না-ই। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ বলে এ দেশের বেশিরভাগ মানুষই তাদের ভোটাধিকার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। কোনো নাগরিকই তার অধিকার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকে না। নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে অধিকারের প্রতিফলন ঘটায়। সময় আসছে অধিকারের সঠিক ও সময়োপযোগী ব্যবহারের। আসছে নির্বাচনে (যখনই আসুক!) বাংলাদেশের নাগরিকরা ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচন করবে যারা সঠিক ও পরিকল্পিতভাবে দেশ পরিচালনা করবে। দেশের মাটি ও মানুষের কথা ভাববে। দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে। সাধারণ মানুষের মতামতের মূল্য দেবে। অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে।
 
 
 
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। জীবনকে বাঁচাতে জীবনের পেছনে ছুটে বেড়ায় এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ। কিন্তু তারা যথেষ্ট রাজনীতি সচেতন। দেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে, এর গতি-প্রকৃতি কী, কোথায় কোন ধরনের নির্বাচন হচ্ছে বা হবে সবই তারা জানে। পত্রপত্রিকা পড়ে, টেলিভিশন দেখে, বেতার শুনে কিংবা অনলাইনে তারা সব খবর পায়। প্রায়ই দেখা যায় রাস্তার ধারে টং দোকানে জটলা বেঁধে মানুষ টেলিভিশনে খবর দেখছে। তারা রাস্তার মানুষ নয়। তারপরও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে খবর দেখছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় তারা যথেষ্ট সচেতন। নির্বাচনের ব্যাপারে এ দেশের সাধারণ মানুষের আগ্রহের এতটুকু কমতি নেই। বিষয়টা নির্বাচন কমিশনসহ সবাই অবগত। সবশেষ ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যায়নি। করতে পারেনি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ।
 
 
 
বলা চলে ভোটার উপস্থিতি ছাড়াই হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরপর থেকে মানুষ অপেক্ষা করছে। এরই মধ্যে ৫ আগস্ট ২০২৪ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে। ক্ষমতা গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৫ সালের শেষ অথবা ২০২৬ সালের এপ্রিলের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। আশা করা যায় মানুষের দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার প্রতিফলন ঘটবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। তারা আনন্দ পাবে নিজেদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। দেশের শাসনভার প্রকৃত শাসকের হাতে তুলে দেওয়ার একমাত্র মাধ্যম নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমেই নির্বাচিত হন মানুষের পছন্দের প্রতিনিধি বা জনপ্রতিনিধি। নাগরিকদের ভালোমন্দ দেখার দায়ভার জনপ্রতিনিধিদেরই কাঁধে। সেই দায়ভার গ্রহণের জন্য প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন নির্বাচনে।
 
 
 
এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১২টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের অধীনে চারটি নির্বাচন হয়েছে। ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯১ সালে। ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি। এতে ২৯টি দল অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৭৩ সালের নির্বাচন এবং ১৯৯১-এর পর বাকি সাতটি নির্বাচন হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের অধীনে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থার আওতায়। এবারের নির্বাচনটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এবারের নির্বাচন হবে সতেরো বছরের মধ্যে সেরা নির্বাচন। মানুষ তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
 
 
 
বাংলাদেশের মানুষ যেকোনো ধরনের খবরের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। নির্বাচনের খবরের ব্যাপারে তাদের আগ্রহের মাত্রা সবার ওপরে। রাজনীতির খবর হলে তো কোনো কথাই নেই। টিভির সামনে থেকে যেন সরতেই চায় না। পত্রিকার পাতা থেকে মুখ ফেরাতে চায় না। নির্বাচনের খবর তাদের আরও বেশি আগ্রহী করে তোলে। আমরা সেই বাল্যকাল থেকেই দেখে এসেছি বাংলাদেশের নির্বাচন মানে একটা উৎসব।
 
 
 
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার শরিক দলগুলো। আসলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, এর পরিবেশ, ভোটার উপস্থিতি, তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ এসব বিষয় নিয়ে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পর তেমন কিছুই বলার থাকে না। একটা নির্বাচনের পুরো দায়িত্ব যেহেতু নির্বাচন কমিশনের সেহেতু তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণটাই সর্বজনগ্রাহ্য! ইচ্ছা না থাকলেও মানুষকে জোর করে মানানো হয়।
 
 
 
মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে। এই নির্বাচনে কোনো ভোটার উপস্থিতি ছিল না। বলা যায় কোনো মানুষ ভোট দিতে যায়নি। আন্তর্জাতিক বিশ্বও ওই নির্বাচন নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে। ভোটারবিহীন নির্বাচন আসলে নির্বাচন না। আশা করা যায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি থাকবে শতভাগ না হলেও কাছাকাছি। জনমত জরিপ করলে দেখা যাবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সাধারণ ভোটারের আগ্রহ তুঙ্গে।
 
 
 
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন নিয়ে নানা সময় নানা রকম কথাবার্তা হয় কিন্তু কমিশনের দেওয়া সিদ্ধান্ত কেউ মেনে নেয়নি এমন নজির খুবই কম। এ কথাও ঠিক যে নির্বাচন কমিশনের সব বিবৃতিই যে মেনে নেওয়ার মতো তা কিন্তু নয়। কমিশনের দেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত বা ডিরেকশনের ব্যাপারে কারও মনে যদি কোনো প্রশ্ন কিংবা সন্দেহ দেখা দেয় তা সে প্রকাশ করতেই পারে। তবে একজন সচেতন নাগরিক কোনো একটা বিষয় নিয়ে কতটা বলবে তার নির্ধারিত কোনো সীমারেখা না থাকলেও অলিখিত একটা সীমা তো আছেই। আশা করা যায় অন্তর্বর্তী সরকার এই সীমারেখা বিলীন করে মানুষের মনের ভাব প্রকাশের ব্যবস্থা করবেন। মানুষ একটা ইস্যু নিয়ে বিচার-বিবেচনা করে কথা বলে। নির্বাচন তেমনি একটি ইস্যু। এই ইস্যুতে কথা বলার আগে অবশ্যই দশবার ভাবতে হবে। ভাবনার জায়গাটা যত বেশি শক্তিশালী হবে ঝুঁকির মাত্রা তত কম হবে।
 
 
 
টেলিভিশন টকশোগুলোতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে ব্যাপক আলোচনা, পর্যালোচনা, সমালোচনা হয়েছে। এসব আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা থেকে একটা কথাই বেরিয়ে এসেছে নির্বাচন নির্বাচনের মতো হতে হবে। নির্বাচনে অবশ্যই ভোটারদের যৌক্তিক উপস্থিতি থাকতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণও নিশ্চিত হতে হবে। নাগরিকরা যেন বাধাহীন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। তবে কথা হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করতে হবে। নির্বাচন কমিশন যদি দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা না করে তা হলে জনমনে যে প্রশ্নটা আছে সে প্রশ্নটা আরও বড় আকার ধারণ করবে। 
 
 
 
তাই সময় থাকতে ভোটারদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করা হবে সঠিক কাজ। এই কাজটি আগে করতে হবে। সংস্কার তো অবশ্যই দরকার। নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু জরুরি সংস্কার এই সরকার করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে বাকিগুলো ওই সরকার করবে।
 
 
 
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ প্রবল। দীর্ঘ সংগ্রাম-সাধনার পর মানুষ তাদের হারানো ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। আশা করা যায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের মানুষের সেই স্বপ্ন পূরণে সফল হবেন।