নিষেধাজ্ঞার যুগে দুই শক্তিধর দেশ রাশিয়া-ভারত
এম এ হোসাইন [প্রকাশ : সময়ের আলো, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫]

গত ৪ ডিসেম্বর, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নয়াদিল্লীতে তার দশম সরকারি সফরে পৌঁছান। এটা এমন এক সফর যা সাম্প্রতিক সময়ে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘনীভূত হওয়ার পর এটি তার প্রথম ভারত সফর। এমন একসময়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন দুই দেশই নিষেধাজ্ঞা, শুল্কবৃদ্ধি এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক বাণিজ্য-পরিবেশের মধ্যে নিজেদের অবস্থান নতুনভাবে নির্ধারণ করছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, মহাকাশ কর্মসূচি, অর্থনৈতিক সংযোগ ও বাণিজ্য সহজীকরণ এই সফরের আলোচ্যসূচিতে থাকলেও এর বৃহত্তর প্রেক্ষাপট হলো পশ্চিমা চাপ মোকাবিলায় দুই পুরোনো মিত্রের কৌশলগত সমন্বয় শক্তিশালী করা।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উপস্থিতিতে, নয়াদিল্লীতে ভারত-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের সময়, মেক ইন ইন্ডিয়ার অধীনে প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং যৌথ উৎপাদনসহ গভীর সামরিক সম্পর্ককে জোর দেওয়া হয়েছে। রাশিয়া হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেডে পঞ্চম প্রজন্মের সু-৫৭ই স্টিলথ ফাইটারের স্থানীয় উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে, যার লক্ষ্য পর্যায়ক্রমে ৪০-৬০ শতাংশ দেশীয়করণ, ইঞ্জিন প্রযুক্তি এবং স্টিলথ উপকরণ স্থানান্তর করা। অতিরিক্ত প্রস্তাবগুলোতে ল্যানসেট স্ট্রাইক ড্রোন এবং রাশিয়ান উৎপাদিত সরঞ্জামের খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ বিলম্ব মোকাবিলায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। সম্প্রতি রাশিয়ার নিম্নকক্ষ দুমা যে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি অনুমোদন করেছে, তা দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ মহড়া ও মানবিক অভিযানে ব্যাপক সুবিধা দেবে এবং পরস্পরের ভূখণ্ডে সৈন্য বা সরঞ্জাম মোতায়েনের আইনগত কাঠামো তৈরি করবে।
‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের আওতায় ভারত বহু আগেই বিদেশি প্রতিরক্ষা কোম্পানিকে দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হতে উৎসাহিত করেছে। দুবাই এয়ারশোতে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় অস্ত্র রফতানিকারক রোসোবরোনএক্সপোর্ট তাদের অস্ত্র ব্যবস্থা ভারতের সঙ্গে প্রযুক্তিগত অংশীদারত্ব বৃদ্ধির আগ্রহ স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ডেনিস আলিপভ ইতিমধ্যে নিশ্চিত করেছেন যে সু-৫৭ই যৌথ উৎপাদন নিয়ে আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছে। ভারতের সামরিক আধুনিকায়নের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের সঙ্গেও এসব উদ্যোগ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে। ভারতের জন্য রুশ প্রযুক্তির প্রবেশাধিকার বজায় থাকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো অন্যান্য শক্তির সঙ্গে কৌশলগত ভারসাম্য রাখার প্রয়োজনও সমান গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার জন্য, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের মতো নির্ভরযোগ্য অংশীদার ধরে রাখা এক কৌশলগত সাফল্য। দুই দেশের সামরিক-শিল্প ক্ষমতার সমন্বয় ২১ শতকের প্রতিরক্ষা অংশীদারত্বের একটি শক্তিশালী উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
ষাট দশক থেকে ভারত-সোভিয়েত/রাশিয়া সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো মহাকাশ সহযোগিতা। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে ভারত-রাশিয়া শীর্ষ বৈঠকে রকেট ইঞ্জিন উন্নয়ন, উৎপাদন এবং লাইসেন্সিংয়ের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে আরডি-১৭০/১৭১ শ্রেণির তরল জ্বালানি ইঞ্জিনের সম্ভাব্য বিক্রয় ও স্থানীয় উৎপাদন অন্তর্ভুক্ত। রসকসমসের প্রধান দিমিত্রি বাকানভ জানিয়েছেন যে ইঞ্জিন নির্মাণ, মানব মহাকাশযাত্রী, জাতীয় কক্ষপথ স্টেশন এবং রকেট জ্বালানি উৎপাদনে যৌথ কাজের ‘ভালো খবর’ ঘোষণা হবে। যৌথ বিবৃতিতে মানব মহাকাশযাত্রী, উপগ্রহ ন্যাভিগেশন এবং গ্রহ অনুসন্ধানে গভীরকরণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
রসকসমস ভারতের গগনযান মানব মহাকাশ মিশনে যৌথভাবে কাজ করছে, যার মধ্যে অ্যাস্ট্রোনট প্রশিক্ষণ, লাইফ-সাপোর্ট সিস্টেম এবং ডকিং প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত। ভারতের জাতীয় কক্ষপথ স্টেশন স্থাপনে রাশিয়ান প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়ার আলোচনা চলছে, যা চন্দ্রমিশন এবং মঙ্গল অনুসন্ধানকেও সমর্থন করবে। এই সহযোগিতা ভারতের আত্মনির্ভরশীলতা এবং রাশিয়ার প্রযুক্তিগত শক্তিকে পারস্পরিকভাবে শক্তিশালী করবে।
ইতিহাস স্মরণ করলে দেখা যায়, ১৯৮৪ সালে ভারতীয় বিমানবাহিনীর পাইলট রাকেশ শর্মা সোভিয়েত সয়ুজ মহাকাশযানে ভ্রমণ করে প্রথম ভারতীয় হিসেবে মহাকাশে যান, যা দুই দেশের মহাকাশ সহযোগিতার মাইলফলক। ভারতের মানব মহাকাশযাত্রী কর্মসূচি আজও রুশ অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিগত সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। এর বিনিময়ে রাশিয়াও পায় এক দৃঢ় অংশীদার, যার সঙ্গে মহাকাশ গবেষণা ও প্রযুক্তি বিকাশে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বয় সম্ভব। এ সহযোগিতা কেবল প্রতীকী নয়; এটি দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্কের গভীরতা নির্দেশ করে।
রাশিয়া কঠোর নিষেধাজ্ঞায় এবং ভারত মার্কিন শুল্কবৃদ্ধির চাপে থাকায় এ বছরের আলোচনায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। সফরের দুই দিন আগে পুতিন ঘোষণা দেন যে রাশিয়া ভারত-রাশিয়া অর্থনৈতিক সংযোগ আরও গভীর করতে চায়। যৌথ বিবৃতিতে জাতীয় পেমেন্ট সিস্টেম, আর্থিক বার্তা ব্যবস্থা এবং সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি প্ল্যাটফর্মের মধ্যস্থতা নিশ্চিত করার ওপর পরামর্শ চালিয়ে যাওয়ার প্রশ্রিুতি দেওয়া হয়েছে। মির কার্ড ভারতে এবং রুপি রাশিয়ায় গ্রহণযোগ্য হলে লেনদেনে মধ্যস্থতাকারীদের প্রয়োজনীয়তা কমবে এবং মুদ্রা বিনিময়ের কমিশন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পাবে। এটি ভারতীয় পর্যটনকারীদের জন্য সুবিধাজনক হবে এবং ব্যবসায়িক লেনদেন ত্বরান্বিত করবে। পাশাপাশি রাশিয়ার ‘ফাস্টার পেমেন্ট সিস্টেম’কে (এসবিপি) ভারতের ইউনিফাইড পেমেন্টস ইন্টারফেস (ইউপিআই)-এর সঙ্গে যুক্ত করার বিষয়েও দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে দুই দেশের ৯০ শতাংশ বাণিজ্য রুপি ও রুবলে সম্পন্ন হয়, মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানোর কৌশলের অংশ হিসেবে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, রাশিয়া ভারতের সঙ্গে আর্থিক সহযোগিতায় যা সম্ভব সবই ভাগ করে নিতে প্রস্তুত। বৈশ্বিক অস্থিরতার সময় এ ধরনের আর্থিক সমন্বয় দুই দেশকেই স্থিতিশীলতা এনে দিতে পারে।
ভারত-রাশিয়া আন্তঃসরকার কমিশন- যা বাণিজ্য, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সহযোগিতা নিয়ন্ত্রণ করে, এবারের বৈঠকে বাণিজ্য বৈচিত্র্যকরণে একটি বড় ফোরামের ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে রাশিয়া ভারতে ৬৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে, যেখানে ভারত রফতানি করে মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলার। ভারত চাইছে যন্ত্রপাতি, খাদ্যপণ্য ও কাঁচামাল রাশিয়ায় রফতানির পরিমাণ বাড়াতে। উভয় দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। রাশিয়া স্বীকার করছে যে বাণিজ্য ভারসাম্য সংশোধনে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারতের জন্যও রাশিয়ার বাজারে প্রবেশাধিকারের প্রসার অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণের কৌশলগত অংশ, বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কবৃদ্ধি রফতানিতে প্রভাব ফেলছে।
পুতিন ও নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত সম্পর্ক এই সফরে একটি নীরব কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। সেপ্টেম্বর মাসে চীনের তিয়ানজিনে এসসিও সম্মেলনে দুই নেতা সর্বশেষ সাক্ষাৎ করেন। এবার পুতিনের সফর বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনের ঐতিহ্যে ফিরে আসা নির্দেশ করছে। ভারত সম্প্রতি কাজান ও ইয়েকাতেরিনবুর্গে দুটি নতুন কনসুলেট চালু করে রাশিয়ায় তাদের উপস্থিতি বাড়িয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া প্রকাশ্যে ভারতের ইউক্রেন-সংক্রান্ত অবস্থানকে প্রশংসা করেছে। নয়াদিল্লী পশ্চিমাদের মতো সরাসরি নিন্দার পথে না গিয়ে নিজস্ব কূটনৈতিক মানদণ্ড বজায় রেখেছে। এ অবস্থান ভারতকে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ধরে রাখতে সাহায্য করছে।
ভারত যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক হ্রাস চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে, রাশিয়া তখন জ্বালানি খাতে কঠোর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে। মার্কিন বাজারে ভারতের রফতানি কমলেও যুক্তরাষ্ট্র এখনও ভারতের সবচেয়ে বড় রফতানি গন্তব্য। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার সময় অন্য কৌশলগত অংশীদারের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা ভারতের জন্য অপরিহার্য।
রাশিয়ার জন্য এই শীর্ষ সম্মেলন দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদারকে আরও দৃঢ়ভাবে পাশে পাওয়া, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বহুমুখী করা এবং বহুমেরুর বৈশ্বিক কাঠামোর দাবি জোরালো করার সুযোগ। ভারতের জন্য, উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়ানো ও বিশ্ববাণিজ্যে নতুন সুযোগ তৈরি করা এর মূল লক্ষ্য ছিল।
পুতিনের ভারত সফর নিছক আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক কার্যক্রম নয়। নিষেধাজ্ঞা, শুল্কবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার এই সময়ে এটি দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের দৃঢ়তা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিল। প্রতিরক্ষা, মহাকাশ, অর্থনীতি থেকে শুরু করে বাণিজ্য)- প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই সম্পর্ক বহুমাত্রিক ও কৌশলগত। পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভারত ও রাশিয়া আবারও ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের দিকে এগোচ্ছে, যা ভবিষ্যতের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে।