নিষ্ঠা ও সততার প্রতীক বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী
কর্নেল কাজী শরীফ উদ্দীন (অব.) [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৯ মে, ২০২৫]

আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস আজ। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে নিষ্ঠা এবং সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে লাল-সবুজের পতাকাকে ৩৭ বছর ধরে বিশ্বের বুকে সমুন্নত রেখেছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করা হবে।
আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস প্রতিবছর ২৯ মে উদযাপিত হয়।
এই দিনে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী সব পুরুষ-নারীকে শান্তি রক্ষার লক্ষ্যে সর্বোত্কৃষ্ট পেশাদারি মনোভাব বজায়, কর্তব্যপরায়ণতা, নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁদের আত্মত্যাগের ঘটনাকে গভীর কৃতজ্ঞতা ও যথোচিত সম্মানপূর্বক স্মরণ করা হয়। ২০০৩ সাল থেকে এই দিনটি পালন করা হয়। ২০০৯ সালে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষায় নারীদের অবদান ও ভূমিকার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। শান্তি রক্ষায় নারীর ভূমিকা ও লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যেই এ পদক্ষেপ গ্রহণ।
ইউক্রেনের শান্তিরক্ষী সংস্থা এবং ইউক্রেন সরকারের যৌথ প্রস্তাবে ১১ ডিসেম্বর ২০০২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের গৃহীত ৫৭/১২৯ প্রস্তাব অনুযায়ী এই দিবসের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস প্রথম উদযাপন করা হয়। ১৯৪৮ সালে সংঘটিত আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের সময় যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণে জাতিসংঘ ট্রুস সুপারভিশন অর্গানাইজেশন (আন্টসো) গঠনের দিনকে উপজীব্য করে ২৯ মে তারিখটি স্থির করা হয়েছে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ ট্রুস সুপারভিশন অর্গানাইজেশনই হচ্ছে প্রথম জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী।
দিবসকে কেন্দ্র করে নিউইয়র্ক সিটিতে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ড্যাগ হ্যামারশোল্ড পদক বিতরণ করা হয়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি ও জাতিসংঘের মহাসচিব সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীকে অভিনন্দনবার্তা প্রদান এবং তাদের কাজের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতার কথা তুলে ধরে থাকেন। এ ছাড়া বিশ্বের সর্বত্র আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস পালন করা হয়।
বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী : বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী হলো বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনুষঙ্গিক নিরাপত্তা বাহিনী, যারা জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ প্রথমবার জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সেনাবাহিনী পাঠায় এবং তা থেকে আজ পর্যন্ত দেশের সামরিক ও পুলিশ বাহিনী বিশ্বজুড়ে শান্তি রক্ষা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখে আসছে।
বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী শান্তি রক্ষার পাশাপাশি মানবিক সহায়তা, শরণার্থী সুরক্ষা, সংঘর্ষ নিরসন এবং পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই বাহিনী দেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় একটি গৌরবময় অবদান।
নিষ্ঠা ও সততার প্রতীক বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী
১৯৮৮ সালে ইউএন ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভেশন গ্রুপ (ইউনিমগ) মিশনে মাত্র ১৫ জন সেনা পর্যবেক্ষক প্রেরণের মাধ্যমে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর বাংলাদেশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তী কয়েক বছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বেশ সুনামের সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে কাজ করে গেছে। সে সময় অর্থাৎ ১৯৯৩-৯৪ সালে সবচেয়ে আলোচিত রুয়ান্ডা, সোমালিয়া ও বসনিয়া—এই তিনটি শান্তি মিশনে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। দরিদ্র দেশের সেনাবাহিনী দক্ষতা এবং সামরিক জ্ঞানে রুয়ান্ডায় বেলজিয়ান, সোমালিয়ায় আমেরিকান এবং বসনিয়ায় ফ্রান্স সেনাবাহিনীকে যে টেক্কা দিতে পারে, তা জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট দেশের কর্মকর্তাদের ধারণার বাইরে ছিল। ফলে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হতে থাকে।
১৯৯৪ সালে আফ্রিকার রুয়ান্ডার গণহত্যার সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড গ্রুপ সেখানে নিয়োজিত ছিল। প্রায় ১০০ দিনের গৃহযুদ্ধে তখন ছয় লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছিল। উল্লিখিত শান্তি মিশনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে বেলজিয়ানসহ আফ্রো-ইউরোপিয়ান ব্যাটালিয়নগুলো দ্রুত প্রত্যাহার করে তাদের মিশন গুটিয়ে ফেললেও বাংলাদেশের সেনা সদস্যরা বুকে সাহস নিয়ে মিশন এলাকায়ই থেকে যান। ফলে গণহত্যায় মৃত্যুর হার অনেক কম হয়েছিল। জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকেও সেখান থেকে প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। বাংলাদেশি সৈনিকদের এই সাহস ও দক্ষতা দেখে তখন সবাই মুগ্ধ হয়েছিল। সোমালিয়া থেকে যখন শান্তি মিশন গুটিয়ে নেয়, আমেরিকান সেনাদের দাবি ছিল, তাদের শেষ সৈনিক সোমালিয়া না ছাড়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সেনাদের তাদের সঙ্গে থাকতে হবে। সোমালিয়ার জনগণের হূদয় জয় করে বাংলাদেশিরা নিজেদের অবস্থানকে সেখানে সুদৃঢ় করে নিয়েছিলেন।
স্থানীয় জনগণের আস্থা আর ভালোবাসাই জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশি সেনাদের মূল শক্তি। প্রতিটি মিশনেই বাংলাদেশিদের এই দক্ষতা জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের মুগ্ধ করেছে। ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা, প্রশাসনিক আর সামরিক দক্ষতার জন্য যেকোনো সামরিক কমান্ডারের কাছে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকান সেনাপতিরা বাংলাদেশি সামরিক কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও সাহসিকতায় মুগ্ধ ও আস্থাশীল।
১৯৯৫ সালে ইউরোপের একমাত্র শান্তি মিশন বসনিয়ায় ফ্রান্স ব্যাটালিয়ন প্রত্যাহার করলে বাংলাদেশি সেনারা তাদের জায়গায় কাজ শুরু করেন। ৩৪টি দেশের সেনাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তখন বাংলাদেশের ব্যাটালিয়নকে শান্তি রক্ষার কাজে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়েছিল। সবারই ধারণা ছিল, দরিদ্র দেশের সেনারা ফ্রান্সের সেনাদের জায়গায় কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, যেখানে ডাচ আর ইউক্রেন সেনারা বসনিয়ার ‘স্রেব্রেনিচা’ ও ‘জাপা’ নামক দুটি শহরে গণহত্যা ঠেকাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশি সেনারা তাদের তুলনায় অনেক হালকা অস্ত্র নিয়েও শুধু সাহস, দক্ষতা আর শক্ত মনোবল দিয়ে বসনিয়ার ‘বিহাচের’ মতো গুরুত্বপূর্ণ বিরাট শহরের জনগণকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছেন।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ চার হাজার সদস্য নিয়ে তৃতীয়, ২০০০ সালে পাঁচ হাজার ৬০০ সদস্য নিয়ে দ্বিতীয় এবং ২০০১ সালে ছয় হাজার সদস্য নিয়ে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে শীর্ষে উঠে আসে। ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিন পর্যন্ত ২৮ মাসের মধ্যে ২০ মাসই বাংলাদেশ শীর্ষে ছিল। বর্তমানেও বাংলাদেশ শীর্ষ স্থানটি ধরে রেখেছে। আড়াই যুগেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের ৪০টি দেশের ৫৪টি মিশনে শান্তি রক্ষায় অনন্য ভূমিকা রেখে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন। মিশনে বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে এযাবৎ ছয়জন ফোর্স কমান্ডার ও সাতজন ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের গৌরব অর্জন করেন। ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী শান্তি মিশনে দায়িত্ব পালন করে আসছে। বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যরা ১৯৮৯ সাল থেকে এই মিশনে অংশ নিচ্ছেন। এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশি নারী শান্তিরক্ষী এরই মধ্যে বিভিন্ন মিশন এলাকায় সাফল্যের সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করেছেন। শান্তি মিশনে এযাবৎ ১৫৩ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী প্রাণ দিয়েছেন। আহত হয়েছেন ২২৯ জন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য ২১৯ জন। নিহতদের মধ্যে সেনাবাহিনীর ১২২ জন, নৌবাহিনীর চারজন, বিমানবাহিনীর পাঁচজন এবং পুলিশের ২২ জন।
জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সাফল্যের মূলে রয়েছে আমাদের প্রতিটি শান্তিরক্ষীর ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা, পেশাগত দক্ষতা, দায়িত্ববোধ, মানবিক আচরণ ও সহনশীল মনোভাব। শান্তি মিশনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি সদস্য পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাদেশের দূতের কাজ করছেন। এসব মিশনে অংশ নেওয়ার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশেই বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার পরিচিতির প্রসার ঘটেছে। অন্যদিকে শান্তি মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শান্তিরক্ষীরা বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও ব্যাপক অবদান রাখছেন। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সেনা প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও এই দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কলামিস্ট