কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

নতজানু থেকে আত্মমর্যাদার পররাষ্ট্রনীতি : ড. ইউনূস কি পুনরুজ্জীবিত করছেন জিয়ার কৌশল?

আলাউদ্দীন মোহাম্মদ [আপডেট: বণিকবার্তা, ২৬ জুন ২০২৫]

নতজানু থেকে আত্মমর্যাদার পররাষ্ট্রনীতি : ড. ইউনূস কি পুনরুজ্জীবিত করছেন জিয়ার কৌশল?

দক্ষিণ এশিয়ার অস্থির ভূরাজনীতিতে পুরনো ইতিহাস প্রায়ই ফিরে আসে নতুন মুখোশে। ২০২৪ সালের বিপ্লবের মাঝে অন্তর্বর্তীকালীন নেতৃত্বে উঠে আসা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এমন এক কূটনৈতিক পথ অনুসরণ করছেন, যা স্পষ্টভাবে ১৯৮০-এর দশকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতিকে মনে করিয়ে দেয়। দশকের ব্যবধানে দুজনের রাজনীতি ভিন্ন হলেও অভিন্ন ছিল এবং আছে একটি চ্যালেঞ্জ— ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্য মোকাবেলা করে বাংলাদেশের সার্বভৌম অবস্থানকে মজবুত করা।

 
 
 
 
 

২০২৪ সালে রাজনৈতিক সংকটে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ বাংলাদেশের সার্বিক ইতিহাসে একটি মোড় ঘোরানো মুহূর্ত তৈরি করে। ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিদেশনীতি পুনর্গঠনের দিকে দৃষ্টি দেন। প্রথমেই তার দৃষ্টি পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের দিকে, বিগত সরকার যাকে নিয়ে গিয়েছিল তলানির পর্যায়ে। জাতিসংঘে জো বাইডেনের সঙ্গে তার বৈঠক এবং পরবর্তী ২০২ মিলিয়ন ডলারের ইউএস এইড প্যাকেজ একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়—ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের সূচনা। যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে সাহায্য দাঁড়ায় ১ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামরিক সম্পর্কেও ঘটে নাটকীয় উত্তরণ। যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জোয়েল পি ভাওয়েলের ঢাকা সফর এবং ‘টাইগার লাইটনিং ২০২৫’ যৌথ মহড়া বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কাঠামোর ভিন্নমাত্রা নির্দেশ করে।

 

 

জিয়া যেমন ফারাক্কা বাঁধ ইস্যু জাতিসংঘে নিয়ে গিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন চেয়েছিলেন, ড. ইউনূস তেমনি রোহিঙ্গা সংকটকে এক কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। তার প্রশাসন এক ধরনের ‘মানবিক করিডোর’-এর কথা বলছে, যা আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতার মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে কৌশলগতভাবে বিদেশী সম্পৃক্ততা বাড়াতে পারে।

 

এ করিডোর পরিকল্পনার সঙ্গে বন্দর উন্নয়নের সংযোগ লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশকে একটি আঞ্চলিক লজিস্টিক হাব হিসেবে গড়ে তোলার কৌশল স্পষ্ট। Geo-economic statecraft তত্ত্ব অনুযায়ী, অবকাঠামো এখন শুধু উন্নয়নের বাহক নয়, বরং কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম। আর ড. ইউনূস সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছেন। এ যেন পূর্ণ সেই জিয়ার আমলের পুনরাবৃত্তি।

 

২০২৫ সালের প্রথম দিকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি পৌঁছায় ৯ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারে। এ বিশাল ঘাটতির জবাবে ইউনূস সরকার ভারতীয় ৪২ শতাংশ আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং দ্রুত বাণিজ্য বৈচিত্র্যায়ণ শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রফতানি ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যা দাঁড়ায় ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারে। অন্যদিকে ভারতের দিকে রফতানি থাকে প্রায় অপরিবর্তিত।

 

 

১৯৭৯ সালেই জিয়া বলেছিলেন, অর্থনৈতিক নির্ভরতা রাজনৈতিক দাসত্বের দিকে নিয়ে যায়। ইউনূস যেন সেই সতর্কবার্তাকে আধুনিক কৌশলে রূপান্তর করছেন। Dependency theory অনুসারে, যেকোনো একক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা নীতিনির্ধারণে সীমাবদ্ধতা তৈরি করে। আর এখানেই এই দুই নেতার মিল—তারা শুধু অনুধাবনই করেননি এ তত্ত্ব, একজন করার পথ তৈরি করে দিয়ে গেছেন, আরেকজন করছেন।

 

 

আরেকটি বিষয়েও দুই নেতার মাঝে মিল পাওয়া যায়, দেশের স্বার্থের বিষয়ে—শুধু দেশে নয়, বিশ্বমঞ্চেও সরব থাকা, সঙ্গে যুক্ত রাখা জাতীয়তাবাদী চেতনা। ভারতের হস্তক্ষেপের অভিযোগ, তিস্তা চুক্তির অগ্রগতি দাবি এবং শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের প্রশ্ন তোলার মাধ্যমে ইউনূস এক ধরনের performative sovereignty প্রদর্শন করছেন। তার ভাষ্য কেবল কূটনৈতিক বার্তা নয়, বরং ঘরোয়া রাজনীতিতেও প্রতিফলিত হচ্ছে জাতীয়তাবাদী আবেগ।

 

 

এটি আজকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম-নির্ভর যুগে এক কৌশল—যেখানে প্রত্যেক আন্তর্জাতিক অবস্থান এক ধরনের গণমাধ্যম যুদ্ধ।

 

 

জিয়ার মতো ইউনূসও পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করছেন। চীনকে প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরের গন্তব্য হিসেবে বেছে নেয়া এবং ভারতের কিছু প্রকল্প স্থগিত করা ছিল স্পষ্ট কৌশলগত বার্তা। চীনের সঙ্গে সহযোগিতার প্রসারে বন্দর উন্নয়ন এবং প্যাকেজড ঋণের বিষয়েও আলোচনা চলছে।

 

 

এ বহুমুখী কূটনীতি classical realism ধারণার সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ। যেখানে ছোট রাষ্ট্রগুলো বড় শক্তিগুলোর প্রভাবে না গিয়ে নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থে দোদুল্যমান থাকে—এটিই এক ধরনের টিকে থাকার আর্ট।

 

 

জিয়া যেমন স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কণ্ঠকে জোরদার করেছিলেন, ইউনূস তেমনি ইন্দো-প্যাসিফিক যুগে বন্দর কূটনীতি, আঞ্চলিক করিডোর ও সামরিক মহড়ার মাধ্যমে কৌশলগত সার্বভৌমত্ব রক্ষা করছেন। দুজনের মধ্যেই রয়েছে কৌশলগত সচেতনতা ও বহুমুখী কূটনৈতিক ভারসাম্যের চিন্তা।

 

 

জিয়ার কূটনীতি কিছু ক্ষেত্রে ছিল ব্যাকচ্যানেলে, ইউনূস তা করছেন দৃশ্যমান মঞ্চে—কিন্তু লক্ষ্য অভিন্ন: বহুমুখীকরণ, স্বাধীন অবস্থান এবং ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যের সীমারেখা টেনে দেয়া।

 

 

ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন বিশেষ পরিস্থিতিতে, কিন্তু তার কূটনীতি কেবল তাৎক্ষণিক কোনো কৌশল নয়। বরং এটি এক দীর্ঘস্থায়ী কূটনৈতিক ধারার আধুনিক সংস্করণ। মানবিক করিডোর হোক বা বাণিজ্যিক ভারসাম্য কিংবা যৌথ সামরিক মহড়া—সবকিছুতেই তিনি এক নতুন ধরনের আত্মবিশ্বাস ও কৌশল দেখাচ্ছেন।

 

 

যদি এ কৌশলগুলো নির্বাচনোত্তর সরকারগুলোর মধ্যেও টিকে থাকে, তবে ভবিষ্যতের ইতিহাসে ইউনূসকে জিয়ার কূটনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবেই শুধু নয়, একজন শান্তির দূত হিসেবেও বরং দেখা হবে। আর ভুলে যাচ্ছে না কেউই, এ শান্তির জন্যই তিনি আমাদের এনে দিয়েছেন নোবেল, যেই শান্তির জন্য আজীবন লড়ে গিয়েছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

 

আলাউদ্দীন মোহাম্মদ: যুগ্ম সদস্য সচিব, জাতীয় নাগরিক পার্টি