নতুন খাত খুলতে প্রয়োজন কূটনৈতিক তৎপরতা
মোহা. হামিদুর রহমান [সূত্র : কালবেলা, ১০ আগস্ট ২০২৫]

বাংলাদেশের জন্য চতুর্থ বৃহৎ এবং অতিগুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। সম্ভাবনার এ শ্রমবাজার বারবার বন্ধ হয়েছে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হস্তক্ষেপে নতুন করে শ্রমবাজার খোলার আগে তাই অতীতের অনিয়ম আর দুর্নীতির ফিরিস্তিগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করা জরুরি। একই সঙ্গে এই শ্রমবাজারে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পাশাপাশি দক্ষতার ভিত্তিতে বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশিদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর এখনই উপযুক্ত সময়।
মালয়েশিয়ান মালিকরা বাংলাদেশি কর্মীদের সাধারণত পছন্দ করে থ্রি-ডি (ডার্টি, ডিফিকাল্ট ও ডেঞ্জারাস) কাজের জন্য। এসব কাজে স্থানীয় ও অনেক দেশের কর্মীরা কাজ করতে আগ্রহ দেখান না। অদক্ষ কর্মীদের খুব সহজেই এসব জায়গায় পাঠানোর সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। তবে এই অদক্ষ কর্মীদের পাঠানোর আগে বেসিক ইংরেজি, মালয় ভাষা, এখানে চলাফেরার নিয়ম শেখানো উচিত। বিএমইটির নির্ধারিত যে প্রশিক্ষণ রয়েছে, তার বেশিরভাগই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে। প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক ও কার্যকরী হলে এসব কর্মীকে মালয়েশিয়ায় এসে প্রাথমিক যেসব সমস্যায় পড়তে হয় সেসব সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে।
শ্রমবাজারে দক্ষ কর্মীর বিকল্প নেই। অদক্ষ কর্মীর প্রবাসে দীর্ঘদিন থাকার সুযোগ কম, একই সঙ্গে তাদের বেতন কাঠামোও কম। তাই সরকারের উচিত দক্ষ কর্মী প্রেরণে নজর দেওয়া। বিশেষ করে আইটি খাত, নার্সিং, প্রকৌশলীসহ বেশ কিছু সেক্টরে বাংলাদেশিদের কাজের সুযোগ রয়েছে মালয়েশিয়ায়। কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর মাধ্যমে এসব খাত উন্মুক্ত করলে সম্প্রসারিত হবে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার বাড়বে রেমিট্যান্স প্রবাহ।
শ্রমবাজার নতুন করে খোলার চেয়ে নিরাপদ অভিবাসন খুবই জরুরি। যেখানে একজন কর্মীর সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ন্যায্য বেতন, ওভার টাইম, খাওয়া, থাকা এবং সুচিকিৎসার নিরাপত্তা পাবে। এখানে হাজার হাজার কর্মী রয়েছে যাদের অনেকেরই বৈধ ভিসা নেই, যারা ঠিকমতো কাজ পায় না, কাজ পেলেও বেতন পায় না, সুচিকিৎসা পায় না, থাকার উপযুক্ত পরিবেশ পায় না। এদেরই একজন যশোরের জহিরুল ইসলাম ফ্রি ভিসার নামে তাকে দুই বছর আগে মালয়েশিয়ায় নিয়ে এসেছে একটি কোম্পানি। দালালের মাধ্যমে আসা জহিরুলের নির্ধারিত কোম্পানির নিজস্ব কোনো কাজ নেই। বাধ্য হয়ে তাকে কাজ করতে হচ্ছে কম বেতনে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে। মালয়েশিয়ার নিয়ম অনুযায়ী তার অন্য কোম্পানিতে কাজ করা অবৈধ, যার কারণে সবসময়ই তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কাজ করতে হয়। জহিরুলের মতো অনেক ভুক্তভোগী রয়েছে, যারা ফ্রি ভিসার প্রলোভনে মালয়েশিয়ায় এসে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। এদের অনেকেই আবার অবৈধ হয়ে গেছে কোম্পানির গাফিলতিতে। নতুন কর্মী আনার আগে এসব কর্মীকে বৈধতার ব্যাপারেও সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা জরুরি।
অভিবাসী কর্মীদের সেবায় কনস্যুলার সেবা বাড়ানো ও আইনগত সহায়তার জন্য জনবল বাড়ানো প্রয়োজন। প্রায় ১৫ লাখ প্রবাসীর জন্য কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশনে একজন উকিল নিয়োগ রয়েছে। অথচ শুধু আইনি সহায়তার অভাবে হাজারো প্রবাসী বাংলাদেশি বিনা অপরাধে সাজা খাটছে। একই সঙ্গে কুয়ালালামপুর শহর থেকে ৪শ কিংবা ৫শ কিলোমিটার দূরের পেনাং, জোহর, পাহাংসহ যেসব রাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আধিক্য বেশি, সেসব রাজ্যে স্থায়ী কনস্যুলেট সেবা স্থাপনের মাধ্যমে প্রবাসীদের সেবা বাড়ানো দরকার।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জুলাই মাসে দেশে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স প্রবাহ এসেছে, যার একটি বড় অংশ মালয়েশিয়ায় কর্মরত প্রবাসীদের মাধ্যমে আসে। বর্তমান বাস্তবতায়, অধিকাংশ রেমিট্যান্স অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল (যেমন: হুন্ডি) মাধ্যমে পাঠানো হয়, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং গ্রামীণ পরিবারগুলোর অনেকেই ব্যাংকিং সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ‘নমনীয় বেতন-বণ্টন মডেল’ নামক একটি কার্যকর ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান প্রস্তাব করছি, যা মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন এবং দেশের অর্থনীতিকে সুসংহত করবে।
নমনীয় বেতন-বণ্টন মডেলের মূল বৈশিষ্ট্য:
l একজন প্রবাসী কর্মী প্রতি মাসে যে বেতন পাবেন, তার প্রতিষ্ঠান সেই বেতনের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশে পরিবারের অ্যাকাউন্টে মোবাইল/ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেবে। এক্ষেত্রে বিদেশ যাত্রার আগে বাংলাদেশে সহজ প্রক্রিয়ায় এবং দ্রুত ব্যাংক/মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা সরকারের নিজের উদ্যোগে করে দিতে হবে। ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক নামে একটি বুথ থাকবে।
l দুই থেকে তিনটি অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের সুবিধা দিতে হবে।
l বিদেশে সরকারিভাবে কর্মী পাঠানোর পূর্বে তার প্রাপ্য বেতনের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশে ব্যাংক/মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে পাঠানোর শর্ত সংযুক্ত করতে হবে। এর ফলে প্রবাসীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি পাবে, যাতে তারা বৈধ ও নিরাপদ চ্যানেলে তাদের অর্থ সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করতে পারে। পাশাপাশি অবৈধ ও অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে (হুন্ডি) টাকা পাঠানো বন্ধ হবে এবং বাংলাদেশ সরকারের রেমিট্যান্স বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
l অর্থনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের (মাইক্রো সেভিংস ও পেনশন স্কিম) আয়োজন করতে হবে।
বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলাটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পাশাপাশি শ্রমিক পাঠানোর সুযোগটি যেন আগের মতো কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য সীমাবদ্ধ না থাকে, সে বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। এই শ্রম বাজারটি চালুর জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হলো, অভিবাসন ব্যয় কমানো। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে পুরোনো অভিজ্ঞতার সুযোগ যাতে তৈরি না হয় অন্তর্বর্তীকালীন বর্তমান সরকারের সে দিকটি সর্বোচ্চ নজর দেওয়া দরকার। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রম বাজার হয়ে উঠেছে মালয়েশিয়া।
মালয়েশিয়ায় কর্মসংস্থানের জন্য বাংলাদেশ ওভারসিস এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসেল) মাধ্যমে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য নতুন নিয়োগ অনুমোদন দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। যারা গত ৩১ মে ২০২৪ তারিখের মধ্যে মালয়েশিয়ায় যেতে পারেনি, তাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত কর্মীদের এবার কনস্ট্রাকশন এবং ট্যুরিজম সেক্টরে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। ১ আগস্ট ২০২৫ তারিখ কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছে কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন।
দুঃখের বিষয়, তাদের মধ্যে গড়ে প্রতিদিন ১০০ জন পর্যটককে মালয়েশিয়ায় ঢুকতে না দিয়ে ফিরতি বিমানে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এতে ভ্রমণপিপাসুরা আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেহেতু সব কাগজপত্রাদি যাচাই-বাছাই করেই ভিসা দেওয়া হয়, সেহেতু অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে তাদের ফেরত পাঠানোটা মানবিক দিক থেকে সঠিক নয়। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আমরা জানি, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম আপনার বন্ধু। আপনার এই সফরে বিষয়টি আলোচনায় আনবেন বলে আশা করছি।
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, ওমান, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, তুরস্ক, মিশর ও লিবিয়াতে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি কাজের জন্য যায়। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এ সব দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করা।
কূটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা ও বেতন-ভাতাদি বৃদ্ধি করা। এতে করে প্রবাসী আয়ের মাধ্যমেই বাংলাদেশ একদিন অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াবে।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, মালয়েশিয়া