নতুন ভাইরাস নিয়ে সচেতন থাকতে হবে
রনি রেজা । সূত্র : সময়ের আলো, ১০ জানুয়ারি ২০২৫

পৃথিবী থমকে দেওয়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের পাঁচ বছর পর নতুন আরেক ভাইরাস চোখ রাঙাচ্ছে ফের। চীনের উত্তর অঞ্চলে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস সংক্ষেপে এইচএমপিভি ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ায় নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। দুরন্ত ছুটে চলা বিশ্বকে অসাড় করে দিয়েছিল কোভিড-১৯ নামে করোনাভাইরাসটি। ওই ভাইরাসটিও ছড়িয়েছিল চীন থেকে। ঠিক পাঁচ বছর পর আবার একই দেশ থেকে এমন ভাইরাস ছড়ানোয় কিছুটা আতঙ্কিত বিশ্ব।
করোনার সময় ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে আমাদের। সন্তানরা বৃদ্ধ মা-বাবাকে জঙ্গলে ফেলে এসেছে মহামারি থেকে বাঁচতে। নির্মম-নির্দয় এমন বহু উদাহরণ প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। একের পর এক লকডাউন দিয়েছিল দেশগুলো। বন্ধ হচ্ছিল কলকারখানা। বিভিন্ন দেশের মধ্যকার আমদানি-রফতানি প্রায় বন্ধের পথে, বলা যায় জরুরি চিকিৎসাসামগ্রী ছাড়া অন্য সবকিছু বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এতে প্রভাব পড়েছিল প্রতিটি দেশের আর্থিক খাতে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি ভেঙে পড়ে তখন। আর নাগরিকরা ভোগ করে চরম ভোগান্তি। একের পর এক বেকার হয়েছিল মানুষজন। চারদিকে ছিল কেবল হাহাকার।
বিশ্বের দেশগুলো যেন ‘একা’ হয়ে পড়েছিল। দেশে দেশে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগও বন্ধ ছিল। এতে শহর থেকে শহর বিচ্ছিন্ন। আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, ইংল্যান্ড, জার্মানির মতো দেশগুলোকেও হিমশিম খেতে হয়েছে এই অচেনা শত্রুকে দমাতে। তখন গণমাধ্যমের প্রতিটি পাতাজুড়ে ছিল করোনা আলোচনা। বিনোদনের পাতাও থাকত বিষাদে ভরা। সেই অপরিচিত সময়কে মানুষ ঠিকই পার করেছে। এতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ব্যক্তি সচেতনতা। তখনকার অভিজ্ঞতা বলে-প্রতিটি মানুষ সচেতন হলে এই অদৃশ্য শত্রু মোকাবিলা করতে সহজ হয়।
যদিও আমাদের দেশের চিকিৎসকরা বলছে ভাইরাসটি নতুন নয়। এ দেশে আগে থেকেই ভাইরাসটি ছিল। তেমন ভয়ের কিছু নেই বলেও জানিয়েছেন আমাদের দেশের চিকিৎকরা। কিন্তু বিশ্বে এরই মধ্যে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে ভাইরাসটি নিয়ে। ভারতেও শনাক্ত হয়েছে নতুন করে। আমাদের দেশের পুরোনো ভাইরাসই এটি, নাকি সত্যি আরেকটি নতুন ভাইরাস সেটি নিয়েও সংশয় রয়েছে অনেকের মধ্যে। স্বাভাবিকভাবে কিছুটা চিন্তা, কিছুটা শঙ্কা থাকা স্বাভাবিক।
পুরোনো অভিজ্ঞতা আরও শঙ্কিত করে। আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এমন ধাক্কা সত্যি অনেক শঙ্কার। করোনার ক্ষতি এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পেরেছি কি? একবাক্যে বলা অসম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে নতুন কোনো ধাক্কা যেন না খেতে হয়, সে জন্য সচেতন থাকা খুবই জরুরি।
বিশ্ব গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী নতুন ভাইরাস এইচএমপিভিও করোনার মতোই ছোঁয়াচে। অনেকে বলছে করোনার চেয়েও ভয়ংকর এই ভাইরাসটি। এমন একটি ভাইরাস যদি আবার আসে তাই সতর্ক হওয়া উচিত আগ থেকেই। করোনা যখন এসেছিল তখন আমাদের এ ধরনের পরিস্থিতি বিষয়ক কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। এখন আমাদের সামনে করোনাভিজ্ঞতা রয়েছে। সেটি থেকে যতটুকু সম্ভব সচেতনতা আগে থেকে আমরা রপ্ত করতে পারি।
করোনাভিজ্ঞতা বলে-এ ধরনের ভাইরাস মোকাবিলা করতে প্রথম কথা হচ্ছে ঘরে থাকতে হবে। আবার ঘরে বসে থাকতে থাকতে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, অস্থিরতা কাজ করে মানুষের মাঝে। ছটফট করতে করতে আবার রাস্তায় বেরিয়ে আসে মানুষ। কেউ বুকভরে দম নিতে। কেউ ক্ষুধার তাড়নায়। তাদের রুখতে নিয়োজিত আছে প্রশাসন। সবমিলিয়ে একটা অস্থির সময় যাচ্ছে; সন্দেহ নেই। এতে বেদনা আছে। দম বন্ধ করা অস্বস্তি আছে। আছে কিছু নিয়মবদ্ধতা। প্রকৃতি তার প্রয়োজনেই নিয়মে ফেরায়। ফিরতে বাধ্য করে। এ যেন সেই সময় চলছে।
ভালো থাকতে হলে একা থাকতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। প্রিয়জনকে আলিঙ্গনে জড়াতে পারব না। চুমু খেতে পারব না প্রিয় সন্তানকে। অফিস থেকে ফিরেই কোলে ঝাঁপিয়ে পড়া সন্তানের চোখ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে ঢুকছি ওয়াশরুমে। আবেগ মিশিয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরতে পারব না। সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দেওয়া আগন্তুককে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে হ্যান্ডশেক না করেই। প্রিয়জন মারা যাচ্ছে; লাশ বুকে জড়িয়ে আহাজারি করতে পারছে না স্বজনরা। জানাজা-সৎকারেও নেই খুব উপস্থিতি।
বাঙালি সত্তা এ কিছুতেই মানতে চাইছে না। আবার নিজেকে বোঝাচ্ছি-এ নিয়মগুলো ভালো রাখবে আমাদের। হয়ত নতুন এই ভাইরাসটি এক দিন চলে যাবে। আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে। সুন্দর নিয়মগুলো থেকে যাবে আমাদের মঙ্গলে। সেই মঙ্গলময় আগামীর জন্য ভালো থাকতে হবে আমাদের। রুখতে হবে ‘এইচএমপিভি’ নামধারী এই বিশ্বশত্রুকে। রুখতে হলে প্রয়োজন সামাজিক ঐক্য। একত্রিত হতে হবে পুরো বিশ্বকে। ধর্ম-বর্ণ-জাতিভেদ ভুলে এক হতে হবে নতুন এই ভাইরাস রোধে।
তাই নতুন এই ভাইরাস এইচএমপিভি আগে থেকেই সচেতন থাকতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে। এগিয়ে আসতে হবে শীর্ষ তালিকায় থাকা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের। সচেতনতামূলক বাক্যে বলা সামাজিক দূরত্ব যেন হৃদ্যতা কমিয়ে না দেয়; সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। দৈহিক দূরত্ব বজায় রেখেই পাশে থাকতে হবে অসহায় মানুষগুলোর। পাশে থাকতে হবে আপনজনেরও। করোনার সময়ে কবি ও গবেষক রঞ্জনা বিশ্বাসের একটি পোস্ট খুব আলোচিত হয়েছিল।
তিনি লিখেছিলেন, ‘মরণে আমার ভয় নাই কিন্তু মরিবার আগে দু ফোঁটা অশ্রুবিন্দু দেখিয়া মরিতে চাই।’ সংকটকালে মানুষ সবচেয়ে বেশি থাকে ভালোবাসার কাঙাল হয়ে। কেউ একটু খোঁজ নিলে, সাবধানে থাকার পরামর্শ দিলেই যেন গলে যায় মন। ভরসা পায়। ভাইরাস এসেছে, চলেও যাবে। হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু এই সংকটময় মুহূর্তের শিক্ষা আমাদের যেন সজীব করে, সতেজ করে। এই একলা চলো নীতি যেন কোনো সম্পর্কে ফাটল না ধরাতে পারে।
এই অচেনা ভাইরাসের ভয় যেন আপনজনের হৃদয় থেকে দূরে না সরিয়ে দেয়। নিরাপদে থাকতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে পাশে থাকতে হবে সাধ্যমতো। হতে হবে আরও ঐক্যবদ্ধ।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই-প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী এই ভাইরাসও আমাদের ইতিবাচক কিছু দিয়ে যাবে। সেগুলো আমাদের আগামী দিন আরও ভালো করবে। আলো ছড়াবে। আমরা জড়ো হব শাহবাগের আড্ডায়। হেসে গড়াগড়ি খাব। বন্ধুকে দেখামাত্র টেনে নেব বুকে। করমর্দনে অভিবাদন জানাব আগন্তুককে। আন্তরিকতায় মুগ্ধ করব বিদেশি বন্ধুকে। এগুলোই তো আমাদের সম্পদ। এগুলোই আমাদের অহংকার। এগুলোই আমাদের পরিচয়।