ন্যাটোর খবরদারি ও বিশ্ব বাস্তবতা
রায়হান আহমেদ তপাদার [প্রকাশ : দেশ রুপান্তর, ০৩ জুলাই ২০২৫]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর ইউরোপের ১০টি দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা মিলে গঠন করে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটো। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিরোধ করা। যুদ্ধের অন্যতম বিজয়ী হওয়ায়, পূর্ব ইউরোপ জুড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপুল পরিমাণ সেনা থেকে যায়। পূর্ব জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দেশের ওপর আধিপত্য পায় মস্কো। যুদ্ধের পর জার্মানির রাজধানী বার্লিন দখলে নেয় বিজয়ীরা এবং ১৯৪৮ সালের মধ্যভাগে, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী জোসেফ স্ট্যালিন পশ্চিম বার্লিনের বিরুদ্ধে অবরোধ শুরু করেন। সে সময় ওই এলাকা ছিল তৎকালীন মিত্রশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু পুরো এলাকাটি অবস্থিত ছিল সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত পূর্ব জার্মানিতে। শহরটির সঙ্গে বিমান যোগাযোগের মাধ্যমে সরাসরি সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। তবে এই সংকট সোভিয়েত শক্তিকে মোকাবিলায় একটি জোট গঠনে ভূমিকা রাখে। স্নায়ুযুদ্ধের শুরুর দিকে এ ধরনের রাজনৈতিক ও সামরিক জোট গঠনের উদ্দেশ্য ছিল সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সমন্বিত সুরক্ষা দেওয়া। এত বছর পরে এসে, একটি পরিবর্তিত বিশ্ব যেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সুরক্ষার অগ্রাধিকার রয়েছে সেখানে কি এটি এখনো প্রাসঙ্গিক? সম্প্রতি ন্যাটোর ভেতরকার পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই। খোদ সংস্থা কিংবা এর সদস্যভুক্ত অন্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং তুরস্ক।
চুক্তি অনুযায়ী, ন্যাটোভুক্ত যে কোনো দেশের ওপর সশস্ত্র হামলা হলে সেটি জোটভুক্ত সব দেশের ওপর হামলা বলে গণ্য হবে এবং সব দেশ একে অন্যের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। বাস্তব ক্ষেত্রে জোটটি এটা নিশ্চিত করে যে, ইউরোপীয় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা অবিচ্ছেদ্যভাবে উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সাম্যবাদকে জোটটি তাদের বড় হুমকি মনে করত। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে ন্যাটোর সীমান্ত মস্কোর দিকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার অগ্রসর হয়েছে। এ ছাড়া ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপে বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে জোটটি সাবেক সোভিয়েত স্যাটেলাইট জাতিকে নিজেদের সদস্য হিসেবেই গণ্য করে। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি আর সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই তার মানে এই নয় যে, পশ্চিমারা মস্কোকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করা বন্ধ করে দেবে। কেউই হঠাৎ করে বিশ্বাস করেনি যে, কমিউনিজমের অনুপস্থিতি একটি দুশ্চিন্তামুক্ত পরিস্থিতি, একটি স্বর্ণযুগের সূচনা করেছে যেখানে মিত্র শক্তিরা কোনো ধরনের সশস্ত্র বাহিনী ছাড়াই থাকবে বা সুরক্ষা ছাড়াই বসবাস করতে পারবে। কিন্তু এর বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে। এবারের ন্যাটো সম্মেলন নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে খুশি রাখতে ও ন্যাটোকে এক রাখার চেষ্টায় নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে সাম্প্রতিক ন্যাটো সম্মেলনে প্রায় সবকিছুই করেছে জোটটি। ঢালাও প্রশংসা, রাজকীয় আপ্যায়ন আর ট্রাম্পের বিখ্যাত সেøাগান নকল করাও বাদ যায়নি। পরিকল্পনা মোটামুটি সফল। যদিও ইউক্রেনে যুদ্ধ, রাশিয়ার বিরুদ্ধে কৌশল বা ইউরোপে মার্কিন সেনা কমানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে ন্যাটোকে এগুলো নিয়েও একসময় যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হতে হবে।
ন্যাটোপ্রধান মার্ক রুটের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই সম্মেলনের সবচেয়ে বড় অর্জন-মিত্র দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি। যেখানে দেশগুলো ট্রাম্পের আহ্বান মেনে জিডিপির ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করবে, যা বর্তমান ২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক বেশি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আবারও ন্যাটোর যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রতি অঙ্গীকার করা হয়েছে। অথচ কয়েক মাস আগেও অবস্থা ছিল ভিন্ন। তখন আটলান্টিক উভয় পাড়ের দেশগুলোর সম্পর্ক এতটাই খারাপ ছিল যে, জার্মানির নতুন চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস প্রকাশ্যে বলেছিলেন, তার নির্বাচনী জয় হওয়ার পর হয়তো ন্যাটো বর্তমান রূপে টিকে থাকবে না। সম্মেলনের আগে ট্রাম্প যখন ইরান-ইসরায়েল নিয়ে কঠোর মন্তব্য করছিলেন, তখনো রুটে ট্রাম্পের পক্ষেই কথা বলেন। ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে ন্যাটো ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, যারা যথেষ্ট প্রতিরক্ষা ব্যয় করছে না, তাদের তিনি রক্ষা করবেন না। ফলে ন্যাটোর জন্য এবার ঝুঁকি অনেক বড় ছিল। বিশেষ করে, ইউক্রেনে ২০২২ সালের রাশিয়ার আগ্রাসনের পর বেশির ভাগ ন্যাটো সদস্য দেশই মনে করছে-রাশিয়া তাদের নিরাপত্তার সরাসরি হুমকি। আর মার্কিন পারমাণবিক শক্তিধর মিত্র ছাড়া তারা নিজেদের পক্ষে ঠিকমতো আত্মরক্ষা করতেও পারবে না।
এই সম্মেলনে ট্রাম্প শুধু স্পেনের সমালোচনা করেছেন। কারণ, দেশটি নতুন প্রতিরক্ষা ব্যয় লক্ষ্যমাত্রায় সই করেনি। তবে ট্রাম্প বলেছেন, স্পেন অন্যভাবে খেসারত দেবে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে। অনেক ইউরোপীয় দেশের জন্য নতুন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা অর্থনৈতিকভাবে কঠিন হবে, কিন্তু সে ইস্যু আপাতত এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সম্মেলনের শুরুতেই ন্যাটো জোটের অন্য নেতারা ট্রাম্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মূল সম্মেলনে অংশ নিতে না পারলেও প্রাক-সম্মেলনের নৈশভোজে ছিলেন। পরে ট্রাম্পের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেন তিনি। এই সম্মেলনের যৌথ বিবৃতি মাত্র পাঁচটি অনুচ্ছেদে সীমাবদ্ধ, যেখানে গত বছর ওয়াশিংটনের সম্মেলনে ছিল ৩৮টি অনুচ্ছেদ। বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে ‘যুদ্ধ বা আগ্রাসন’ বলা হয়নি। এমনকি ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করার আগের প্রতিশ্রুতিও পুনরাবৃত্তি করা হয়নি। এর ফলে রাশিয়া ও ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যকার বড় মতপার্থক্য আপাতত চাপা দেওয়া গেছে।
ইউরোপের অনেকের জন্য অস্বস্তির কারণ হলো- ট্রাম্প তার পূর্বসূরি জো বাইডেনের তুলনায় মস্কোর প্রতি অনেকটাই নরম অবস্থান নিয়েছেন এবং কিয়েভকে কম সমর্থন দিচ্ছেন। তার লক্ষ্য হলো, যুদ্ধ শেষ করা। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে রাশিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলে, তা ন্যাটোর কার্যকারিতার জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের অধীনে ন্যাটোয় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত জুলিয়ান স্মিথ বলেন ইউক্রেনে যখন যুদ্ধ চলছে, তখন সেই যুদ্ধকে প্রায় উপেক্ষা করে ন্যাটো সম্মেলন হওয়া আমাদের সবার জন্যই উদ্বেগের বিষয়। স্লোভাকিয়ার ন্যাটোতে সাবেক রাষ্ট্রদূত পিটার বাতোর মন্তব্য, ‘আমরা ক্রেমলিনকে একটা কৌশলগত বার্তা পাঠানোর সুযোগ হাতছাড়া করেছি। এর খেসারত আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে দিতে হবে। এখন দেখা যাবে, ট্রাম্পের ন্যাটো নিয়ে নতুন উদ্দীপনা তার প্রশাসনের সেনা মোতায়েনের নীতিতে কতটা প্রতিফলিত হয়? কারণ, ইউরোপ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ইউরোপীয় নেতারা বলছেন, তারা ধীরে ধীরে আরও দায়িত্ব নিতে চান। তবে তারা চান, সেটি যেন অগোছালো বা হঠাৎ করে না হয়।
ন্যাটোর মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করা ও বর্তমানে রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউট বা রুসির সিনিয়র ফেলো ওয়ানা লঞ্জেস্কু বলেন, ‘জ্যেষ্ঠ ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললেই তাদের উদ্বেগটা বোঝা যায়।’ তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগই মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র কিছু সেনা ও সামরিক সক্ষমতা সরিয়ে নেবে। কিন্তু কতটা ও কখন, সেটা কেউ জানে না। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, সোভিয়েত ইউনিয়ন তো নেই। তাহলে কেন ইউরোপে সেনা ঘাঁটি থাকবে? যে কোনো দেশে যদি অন্য দেশের সেনা ঘাঁটি থাকে, তাহলে কি তারা স্বাধীন থাকতে পারে? ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো কি আসলেই স্বাধীন? এই প্রশ্ন তো যৌক্তিক। তারা কেন নিজেরা নিজেদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না? ইউরোপের দেশগুলো যখন এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে রাশিয়া-চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ছে, তখনই আমেরিকা বিরাগভাজন হলো। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে ন্যাটো কিছুটা স্বস্তি ফেলছে বলে মনে করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলে ন্যাটোর এই স্বস্তি কতদিন থাকে, তা দেখার বিষয়। বর্তমানে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রতিরক্ষা বাজেটে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে। তাহলে ন্যাটোর ভবিষ্যৎ কী হবে? নেটোর উদ্বেগের একটি বড় বিষয়, ভøাদিমির পুতিনের রাশিয়া। এই প্রশ্নের সবচেয়ে ভালো উত্তর রয়েছে রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্যে। যতদিন রাশিয়ার আগ্রাসী মনোভাব থাকবে, ততদিন ন্যাটো দরকার হবে একটি সমন্বিত প্রতিরক্ষা এবং প্রতিরোধের জন্য। কয়েক বছর আগে এনপিআর রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিলেন, ন্যাটোর সাবেক উপ-মহাসচিব আলেক্সান্ডার ভার্শবো। ফলে মনে হচ্ছে আরও অন্তত কয়েক দশক ন্যাটো টিকে থাকতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছাতা হয়ে। তবে ন্যাটোকে সত্যিকারভাবে আরও শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে, যুক্তরাষ্ট্র নির্ভরতা কমিয়ে আনার কৌশল নিতে হবে। যতদিন তা না হবে, ততদিন ন্যাটো- যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য থাকবে না। সম্প্রতি বিশ্বে যে আঙ্গিকে যুদ্ধ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে এককভাবে ন্যাটোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বা খবরদারি কতদিন থাকবে সেটা বড় প্রশ্নচিহ্ন হিসাবে সামনেই প্রকট হতে পারে।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক