কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

অবিলম্বে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট ঘোষণা করা হোক

সৈয়দ ফারুক হোসেন । সূত্র : সময়ের আলো, ২৩ মার্চ ২০২৫

অবিলম্বে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট ঘোষণা করা হোক
বিরামহীন বিমান হামলা এবং ইসরাইলি অবরোধ ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে মানবেতর পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যাকে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা ‘মর্ত্যরে নরক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। গাজার আর অস্তিত্ব নেই। গাজা ধ্বংস হয়ে গেছে। বেসামরিক নাগরিকরা ক্ষুধা, হতাশা ও মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে আছে। এই যুদ্ধ আর চলতে পারে না। এখনই যুদ্ধ বন্ধ করে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি। 
 
 
 
গত বছরে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর ইউরোপজুড়ে গাজাবাসী তথা ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন বাড়তে শুরু করে। সংঘাতের প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর অধিকাংশই ইসরাইলকে সমর্থন করলেও ব্যতিক্রম ছিল কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল আরেক পশ্চিমা দেশ নরওয়েও। 
 
 
 
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের ১৪৩টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের মধ্যে ২০২৪ সালে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাহামা, ত্রিনিনাদ অ্যান্ড টোবাগো, জ্যামাইকা অ্যান্ড বারবাডোজ, স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে পূর্ণ রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব তোলা হয়েছিল। সেখানে ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৪৩টি দেশই এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
 
 
 
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশ এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। এদিকে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ ফিলিস্তিনি গাজা ছেড়েছেন। কিন্তু অনেকেই গাজা ছেড়ে যেতে চান না বা পারেন না। কারণ তাদের আর্থিক সামর্থ্য কম অথবা জন্মভূমি গাজার প্রতি তাদের গভীর আবেগ জড়িয়ে আছে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় অনেক গাজাবাসীই তার পূর্বপুরুষদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। সেই সময়কালকে ‘বিপর্যয়’ বলে অভিহিত করেন। যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে গাজায় নতুন করে ইসরাইলের হামলা শুরুর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি দায়ী করা হয়। গাজায় হামলা সম্পর্কে ইসরাইলকে পরামর্শ দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন এবং হোয়াইট হাউস বলে জানা যায়। এ হামলা ছিল ১৯ জানুয়ারি ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান হামলাগুলোর একটি।
 
 
 
ইসরাইলের সেনাবাহিনী আবারও রকেট হামলা চালাচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিন নাগরিকদের ওপর। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে গত সোমবার মধ্যরাতের পর থেকে এ পর্যন্ত ঘুমন্ত গাজাবাসীর ওপর এই হামলায় অন্তত ৫৯১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এদেরও মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। যুদ্ধবিরতির মধ্যে আবার দুঃস্বপ্নের রাত ফিরে এলো ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ এ উপত্যকায়। ফিলিস্তিনি বসতিতে চলাচলের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরাইল। পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। খাদ্য, রসদ ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ফিলিস্তিনি বসতিতে ঢুকতে পারছে না। 
 
 
 
এরই মধ্যে আবারও নৃশংস ও ‘বর্বরভাবে’ গাজার নিরীহ মানুষের ওপর গণহত্যা শুরু করেছে ইসরাইল। ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি চুক্তি এতে ভেঙেচুরে খান খান হয়ে গেছে। গাজার দক্ষিণের খান ইউনিস ও রাফা, উত্তরের গাজা নগর এবং মধ্যাঞ্চলের দেইর আল-বালাহসহ গাজার প্রায় সব জায়গায় যুদ্ধবিমান ও ড্রোন থেকে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। লোকজন তাদের হাতে করে সন্তানদের ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ নিয়ে আশপাশের হাসপাতালের দিকে ছুটে গিয়েছিল। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, অস্থায়ী হাসপাতাল, আবাসিক ভবন সর্বত্র বিমান থেকে বোমা হামলা চালিয়েছিল ইসরাইল। হামলায় ‘যুদ্ধবিমান ও ড্রোন থেকে চালানো হামলার পর নবজাতক, শিশু, নারী ও প্রবীণ মানুষের অসাড় দেহ যত্রতত্র পড়ে থাকতে দেখা যায়। 
 
 
 
যুদ্ধবিরতির সব প্রচেষ্টা ভূলুণ্ঠিত করার অপচেষ্টার অংশ হিসেবে এ হামলা করেছে দখলদার ইসরাইল। ১৫ মাস ধরে ইসরাইলের নির্বিচার হামলায় ৪৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর গাজাবাসীর মধ্যে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছিল যুদ্ধবিরতি। ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছিলেন তারা। গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর মেয়াদ শেষ হয় ২ মার্চ। যুদ্ধবিরতির মূল চুক্তিতে বলা ছিল, প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চলাকালে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা হবে। যদি এর মধ্যেও দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতির শর্ত নিয়ে সমঝোতা না হয়, তা হলে প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চলবে। এ ছাড়া প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার পর ২ মার্চ যুদ্ধবিরতির মেয়াদ সাময়িকভাবে বাড়ানোর বিষয়ে অনুমোদন দেয় ইসরাইলের সরকার। পবিত্র রমজান ও ইহুদিদের পাসওভার উৎসব এ মেয়াদকালের আওতায় পড়েছে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ২০ এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে আবারও গাজায় নির্বিচার হামলা চালাল ইসরাইল। 
 
 
 
গণহত্যা নিঃসন্দেহেই একটি ঘৃণ্য কাজ। এ ধরনের অভিযোগকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। জেনোসাইড কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে ইসরাইল। ৭৩ বছর ধরে অধিকার আদায়ের জন্য ফিলিস্তিন জনগণ সংগ্রাম করে আসছে। ফিলিস্তিনের জনগণ এ সংঘাতের কারণে অবর্ণনীয় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। মানবাধিকার সুরক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ক‚টনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো হয়। ইসরাইলের হামলা বন্ধে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগী ভ‚মিকাও বাংলাদেশ চেয়েছে। দীর্ঘ ১৫ মাসের যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে গাজা। উপত্যকাটির রাস্তাঘাট, বাড়িঘর- সবই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ শেষ হলে এটি পুনর্গঠনের পরিকল্পনা প্রস্তাব দিয়েছিল মিসর। দেশটির এ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করেছিল আরব ও ইউরোপের দেশগুলো। মিসরের পরিকল্পনাটি তিনটি পর্যায় ছিল। অন্তর্র্বর্তী ব্যবস্থা, পুনর্গঠন এবং শাসন। প্রথম পর্যায়টি প্রায় ছয় মাস স্থায়ী হবে, আর পরবর্তী দুটি পর্যায় ৪-৫ বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এ প্রস্তাবের লক্ষ্য ছিল গাজা পুনর্গঠন করা। 
 
 
 
এ ছাড়া উপত্যকা পুনর্গঠন এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক দাতাদের জন্য সম্মেলন হবে। মিসর গাজার পুনর্গঠনে অর্থায়নের জন্য ৫৩ বিলিয়ন ডলারের আহ্বান জানিয়েছে। এ অর্থ তিনটি পর্যায়ে বিতরণ করা হয়েছে। প্রথম ছয় মাসের পর্যায়ে সালাহ আল-দিন স্ট্রিট থেকে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে, অস্থায়ী আবাসন নির্মাণ এবং আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলো পুনরুদ্ধার করতে তিন বিলিয়ন ডলার খরচ হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে দুই বছর সময় লাগবে এবং ২০ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে। এ পর্যায়ে ধ্বংসস্ত‚প অপসারণের কাজ অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি ইউটিলিটি নেটওয়ার্ক স্থাপন এবং আরও আবাসন ইউনিট তৈরি করা হবে। তৃতীয় ধাপের আড়াই বছরে খরচ হবে ৩০ বিলিয়ন ডলার। এতে গাজার সমগ্র জনসংখ্যার জন্য আবাসন সম্পন্ন করা, একটি শিল্প অঞ্চলের প্রথম ধাপ স্থাপন, বাণিজ্যিক বন্দর নির্মাণ এবং অন্যান্য পরিষেবার মধ্যে একটি বিমানবন্দর নির্মাণও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ প্রস্তাবকে সমর্থন দিয়েছে ইউরোপের চার বড় দেশ। দেশগুলো হলো- ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও জার্মানি। এ চার দেশ এই পরিকল্পনাকে ‘বাস্তবসম্মত’ বলে উল্লেখ করেছিল। দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা শনিবার এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, তারা ৫৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে গাজা পুনর্গঠনের পরিকল্পনাকে সমর্থন করেন। কায়রোতে আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলনে আরব নেতারা এ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। 
 
 
 
সৌদি আরবের জেদ্দায় ৫৭ সদস্যের ওআইসির এক জরুরি বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পরিকল্পনা গৃহীত হয়। যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের বর্বরতম এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে গাজার সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠন হামাস। সংগঠনটি বলেছে, এ হামলার মধ্য দিয়ে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছে ইসরাইল। নৃশংস এ হামলার প্রতিবাদ জানাতে আরব ও ইসলামিক দেশগুলোসহ ‘মুক্ত বিশ্বের মানুষদের’ সড়কে নেমে প্রতিবাদে শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে হামাস। 
 
 
 
যুদ্ধবিরতির মধ্যে গাজায় হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ইসরাইলের হামলা ফিলিস্তিনিদের জীবন অসহনীয় দুর্দশা বয়ে এনেছে। ইসরাইলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে কাতার, সৌদি আরব ও জর্ডান। গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মধ্যস্থতা করে আসা কাতার বলেছে, ইসরাইলের এ হামলা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্তির ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
 
 
 
ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী গাজা উপত্যকা ইসরাইল ও মিসর সীমান্তে অবস্থিত। মাত্র ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত এই ভূমিতে প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি মুসলিম বসবাস করে। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত গাজা নগরীর ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছরের পুরোনো। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে গাজা নগরী এক মিশ্র সংস্কৃতির কেন্দ্র। ইসরাইল হলো- গাজা ভূখণ্ডে এক অবৈধ দখলদার। ফিলিস্তিন নামক জাতিকে নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়েই ইসরাইল গাজায় নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞে মেতে রয়েছে। এ ধ্বংসযজ্ঞের একমাত্র নাম জেনোসাইড বা জাতি হত্যা। ঐতিহাসিক এ অবিচারের কারণে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগে ফেলা কোনোভাবেই সঠিক ছিল না। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত, ফিলিস্তিনের জনগণের পাশে থাকবে সমগ্র বিশ্ববাসী। সমগ্র পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ যাদের মধ্যে মানবতা রয়েছে তারা সবাই পাশে থাকবে ফিলিস্তিনবাসীর স্বাধীনতার পক্ষে।
 
 
 
লেখক- সৈয়দ ফারুক হোসেন, সাবেক রেজিস্ট্রার, জেএসটিইউ