অবশেষে গাজায় যুদ্ধবিরতি
ড. ফরিদুল আলম । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

অনেক দিন ধরেই ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়াসে কাতারের রাজধানী দোহায় আরব নেতাদের এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় চেষ্টা চলে আসছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী নিজেদের মধ্যকার মতপার্থক্যগুলো অনেকটাই কমিয়ে এনেছে ইসরায়েল ও হামাস। অবশেষে গত ১৫ জানুয়ারি দুই পক্ষই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। ইসরায়েলি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর আগামী ১৯ জানুয়ারি থেকে এটি কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে।
এ ধরনের চুক্তি কার্যকর হলে হামাসের অধীনে গাজা ঠিক আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার অর্থাৎ আগের মতো করে স্বাধীনভাবে গাজাকে শাসন করার মতো সুযোগ হামাসের থাকবে না। গাজা থেকে সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলের সেনা সরিয়ে নেওয়ার যে দাবি এত দিন ধরে হামাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, এই বিষয়টি নিয়ে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ক্রমাগত আপত্তির জেরে হামাস অবশেষে এই শর্ত থেকে সরে এসেছে। তারা নিজেরা এই অসম যুদ্ধকে আর টেনে নিয়ে যেতে চাইছে না।
বাস্তবতা হলো, এত দিন ধরে হামাসের সব শক্তির নেপথ্যে ইরানকে বিবেচনা করা হতো।
বর্তমান সময়ে ইরান তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে অধিক চিন্তিত, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণকে উপলক্ষ করে তারা মার্কিন নেতৃত্বের দিক থেকে নিজেদের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি নতুন ঝুঁকি অনুমান করছে। সিরিয়ায় সরকার পতনের পর তাদের অন্যতম মিত্র রাশিয়া পতিত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে আশ্রয় দিয়েছে। এর বাইরে ইরানকে নিয়ে রাশিয়ার তরফে ইরানের সমর্থনে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। চীনের অবস্থানও স্পষ্ট নয়।
এ অবস্থায় ইসরায়েল-হামাসের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি নিয়ে বর্তমান চলমান আলোচনায় হামাস যেকোনো শর্তে ইসরায়েলের আগ্রাসী আক্রমণের হাত থেকে মুক্ত থাকার নিশ্চয়তা পেতে চাইছে। গেল ১৫ মাসের অধিক সময় ধরে চলমান এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে উপত্যকাটির প্রায় সব মানুষ। ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমএস) এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গাজার ২২ লাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ১৭ লাখ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অপরাপর প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে যে গাজার প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই বাস্তুচ্যুত এবং অনেকের ক্ষেত্রে এই বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা একাধিকবারের জন্য ঘটেছে।
এর কারণ ইসরায়েলের ক্রমাগত আক্রমণে মানুষের প্রতিনিয়তই নিরাপত্তার সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে বেড়ানো। অবশেষে গাজায় যুদ্ধবিরতিএদিকে গাজায় নিহতের যে সংখ্যাটি জানানো হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে এটি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা সাময়িকী ল্যানসেট গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অনলাইন জরিপ এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত মৃত্যু সংবাদের ভিত্তিতে ‘ক্যাপচার-রিক্যাপচার’ পরিসংখ্যান পদ্ধতি প্রয়োগ করে জানিয়েছে যে প্রকৃত অর্থে মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি, যা ৬৪ হাজারের ওপরে; যার অর্থ প্রতি ৩৫ জনে একজন মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে। এই হিসাবে প্রায় ৪১ শতাংশ মৃত্যুর হিসাব বাদ পড়েছে।
সংখ্যাটি যদি এমন হয়, তাহলে যুদ্ধপূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় গাজার জনসংখ্যা ২.৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এর বাইরে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ এখন পর্যন্ত নিখোঁজ হয়েছে। যারা মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। ইসরায়েলি বাহিনী হাসপাতাল থেকে শুরু করে শরণার্থী শিবির, স্কুল-কলেজ এবং সাধারণের আশ্রয়স্থল—কোনো কিছুই হামলা করতে ছাড়েনি। আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন করে গেলেও প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করতে তারা এ ধরনের হামলা চালিয়েছে বলে জানান দিয়েছে, যার সমর্থন মিলেছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সংগত কারণেই সেই উদ্যোগে তাদের দিক থেকে ইসরায়েলের স্বার্থের দিকটিকে সর্বাগ্রে মনোযোগ দেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয় হচ্ছে।
হামাস কেন যুদ্ধবিরতিতে যেতে চাইছে, এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে আমাদের এটিই বুঝে নিতে হবে যে এই মুহূর্তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হলে তাদের এককভাবে কেবল নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যের ওপরই নির্ভর করতে হবে। পরিস্থিতি বলছে, ইসরায়েলের দিক থেকে সাম্প্রতিক সময়ে হিজবুল্লাহকে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হয়েছে, ইয়েমেনে হুতিদের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করে তাদেরও দুর্বল করা সম্ভব হয়েছে, সিরিয়ার শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে হামাস ও ইরানকে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এসব বিবেচনায় নিলে হামাসের জন্য এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কেবল নিজেদের আরো দুর্বল করা ছাড়া আর কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। আসলে পরিস্থিতি গত দু-তিন মাসের মধ্যে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
এই পরিবর্তনশীল অবস্থায় হামাসকে ইসরায়েলের অনেক শর্ত মেনে নিয়েই একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে, অবশ্য দিনশেষে ইসরায়েল যদি এই চুক্তি স্বাক্ষরের জায়গা থেকে তাদের অবস্থান পরিবর্তন না করে। এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, চুক্তি স্বাক্ষরের প্রথম দিনে হামাস ৩৪ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে, এর সাত দিন পর আরো কয়েকজনের মুক্তি মিলবে। এর বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগারে আটক এক হাজার হামাস বন্দিকে মুক্তি দেবে ইসরায়েল, যাদের মধ্যে ১৯০ জন কমপক্ষে ১৫ বছর ধরে কারাগারে বন্দি রয়েছে।
পরবর্তী সময়ে চুক্তির দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায় নিয়ে আলোচনা করতে চুক্তি স্বাক্ষরের ১৬ দিন পর দুই পক্ষই আবার আলোচনায় বসবে। কেন একটি যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠছে—এর প্রাথমিক কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ১৫ মাস ধরে দুই পক্ষের মধ্যে চলমান যুদ্ধবিরতি আলোচনায় এবারই প্রথমবারের মতো ইসরায়েল ও হামাসের প্রতিনিধিরা দোহায় এক ছাদের নিচে বসে আলোচনা করেছেন, যদিও ইসরায়েল ও হামাস সদস্যরা পরস্পরের মুখোমুখি হননি এখন পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের প্রতিনিধিদের মধ্যস্থতায় তাঁদের মধ্যে এই আলোচনা চলছে।
আলোচনা নিয়ে হামাসের পক্ষ থেকে তাদের সন্তুষ্টির কথা জানানো হয়েছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে উত্থাপিত প্রায় সব দাবি মেনে নেওয়া হলেও তাদের খোদ সরকারের ভেতরই এটি নিয়ে রয়েছে চরম দ্বিধাবিভক্তি। হামাসের সঙ্গে এ ধরনের যুদ্ধবিরতি মানে হামাসের কাছে ‘ইসরায়েলের পরাজয়’ বলে মন্তব্য করে দুজন মন্ত্রী নেতানিয়াহু সরকারের সমালোচনা করে চুক্তি হলে মন্ত্রিসভা থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন। তবে দেশটির সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা একটি চুক্তির পক্ষে, বিশেষ করে এর মধ্য দিয়ে জিম্মি মুক্তির বিষয়টি ত্বরান্বিত হবে এবং ইসরায়েলের ওপর হামাসের হুমকি ভবিষ্যতে অনেকটা দূর হবে। আসলে এই যুদ্ধ দেশটির সাধারণ মানুষকেও সারাক্ষণ আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখেছে। এটি কেবল হামাসের আতঙ্ক নয়, ইরান ও তার প্রক্সিদের হামলার বিষয়ও এখানে সম্পৃক্ত রয়েছে।
তবে যেভাবে এবং যে প্রক্রিয়ায় এই যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষ আপাতত কাছাকাছি অবস্থানে চলে এসেছে, এর মধ্য দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে হামাসের অনেক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, এটি তাদের জন্য একটি কৌশলগত পশ্চাদপসরণ। এই চুক্তি হলেও গাজায় ইসরায়েলের সার্বক্ষণিক নজরদারি অব্যাহত থাকবে। বলা হচ্ছে, চুক্তির অধীনে দক্ষিণ থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষকে উত্তরে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে, তবে তাদের হেঁটে ফিরতে হবে।
যোগাযোগ এবং পণ্য পরিবহনের স্বার্থে সালাহ-আল দিন সড়ক দিয়ে পশু এবং যান চলাচল করলেও তা কাতার ও মিসরের নিরাপত্তা বাহিনীর এক্স-রে মেশিনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া প্রথম ৪২ দিন ইসরায়েলের সেনারা ফিলাডেলফি করিডরের ৮০০ মিটার এলাকায় অবস্থান করে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে। এসব বিবেচনায় ধরেই নেওয়া যায় যে হামাস অনেকটা চাপের কাছে নতি স্বীকার করে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে সম্মত হচ্ছে। তবে চুক্তি হলেই যে ইসরায়েল এর ধারাগুলো মোতাবেক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে, এটি বোঝা কঠিন।
যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হওয়ার পরও থেমে নেই গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন। প্রায় প্রতিদিনই ইসরায়েলের হামলায় হতাহত হচ্ছে গাজার নিরীহ মানুষ। গত ১৫ জানুয়ারি ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছে ৬২ জন। এ ক্ষেত্রে এই চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের চেয়ে হামাসের তৎপরতাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। অবশ্য এখানে এক ধরনের প্রকাশ্য হুমকির বিষয়ও রয়েছে।
এরই মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জানিয়ে দিয়েছেন যে ২০ জানুয়ারির মধ্যে এই যুদ্ধের অবসান না হলে মধ্যপ্রাচ্যকে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। জানা গেছে, বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে এ নিয়ে যৌথভাবে কাজ করা হচ্ছে। আর মূলত এ কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে বিষয়টি নিয়ে বিবদমান পক্ষগুলো সরব হয়েছে। আপাতত এটিই বলা যায়, ভবিষ্যৎ কী হবে এর চেয়ে বড় কথা হলো, সবার প্রত্যাশা এটিই যে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি বিরাজ করুক।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়