অদক্ষ জনশক্তি ও একক খাতের ওপর নির্ভর করে রফতানি সম্প্রসারণ সম্ভব নয়
সূত্র : বণিক বার্তা, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

যেকোনো দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক রফতানি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস এটি। রিজার্ভ বৃদ্ধিতে রফতানি আয়ের ভূমিকা অপরিসীম। যেকোনো দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক রফতানি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস এটি। রিজার্ভ বৃদ্ধিতে রফতানি আয়ের ভূমিকা অপরিসীম। পাশাপাশি এটি অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতেও বিশেষ ভূমিকা রাখে। কিন্তু এ দেশে রফতানি বাণিজ্যে বেশকিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
বাংলাদেশের পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা সীমিতসংখ্যক আন্তর্জাতিক বাজার ও সামান্য কিছু পণ্যের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর হয়ে রফতানি কার্যক্রম পরিচালিত হওয়া। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২০০ পণ্য বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়। এর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি পণ্য থেকে আসে মোট রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশেরও বেশি। অথচ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে অনেক দেশ এরই মধ্যে রফতানি বাণিজ্যে বিপুল সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। এর উদাহরণ হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের কারখানা হিসেবে খ্যাত চীনের নামই নেয়া যায়।
চীন স্বল্প দক্ষ থেকে শুরু করে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেছে এবং বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠেছে। এমনকি দেশটির স্বল্প দক্ষ শ্রমিকরা এ দেশের পোশাক ও বস্ত্র খাতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের সঙ্গে বর্তমানে প্রতিযোগিতা করছেন। আবার কম সংখ্যক জনসংখ্যা নিয়েও অনেক দেশ রফতানিতে অতুলনীয়ভাবে এগিয়ে গেছে। যেমন ভিয়েতনাম।
যেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় হয়েছে মাত্র ৪৫ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ভিয়েতনাম রফতানি করেছে ৩৭৪ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় আট গুণ বেশি। অথচ দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ১০ কোটি ১০ লাখ, যেখানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ৩৬ লাখ। ভিয়েতনামের এ সাফল্যের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে দক্ষ জনশক্তি, যার ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশে। এ অদক্ষ জনশক্তি এবং একক খাতনির্ভরতা বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যকে পিছিয়ে রেখেছে। এর সঙ্গে রয়েছে অকার্যকর নীতি, প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা পরিবেশের সংকট।
বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে গত বছরের সেপ্টেম্বরে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছিল সরকার। এ টাস্কফোর্স সূত্রে আরো জানা যায়, স্থানীয় বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদনকারীরা যে পরিমাণ সুবিধা পান, তার তুলনায় ৩০ শতাংশ কম প্রণোদনা দেয়া হয় রফতানিতে। আবার রফতানির ক্ষেত্রে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যে কারণে স্থানীয় বাজারে পণ্য বিক্রি করে তুলনামূলক লাভবান হন বিক্রেতারা এবং এতে উদ্যোক্তারা পণ্য রফতানির জন্য বিনিয়োগে আগ্রহ কম দেখান। এমন নীতিগত অদূরদর্শিতার কারণেই বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ সেভাবে বাড়ানো সম্ভব হয়নি বলে মনে করেন সিংহভাগ ব্যবসায়ী।
রফতানি বাণিজ্যের জন্য একক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা নীতিগত অদূরদর্শিতার একটি বড় উদাহরণ। রফতানি শুধু পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় অন্য কোনো সম্ভাবনাময় খাত অনুসন্ধান করা হয়নি। আবার অন্য খাতগুলোর রফতানি বাড়ানোরও তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিশেষ করে পোশাকসহ অন্য কিছু খাত প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরও যেভাবে প্রণোদনা পেয়েছে তার তুলনায় নতুন উদ্যোগগুলো অনেক কম সহায়তা পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, টেকসই রফতানি খাত গড়ে তোলার অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে এ রফতানি প্রণোদনা। তৈরি পোশাকসহ কিছু পণ্য রফতানি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেও বিশেষ সুবিধা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারায় সরকারের আর্থিক সহায়তার ওপর খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের অতিনির্ভরতা বেড়েছে। ফলে রফতানি খাতের সম্প্রসারণ, বহুমুখীকরণ ও গুণগত মানোন্নয়নে উদ্যোক্তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও ঝুঁকি মোকাবেলার নিজস্ব সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। অথচ নগদ প্রণোদনা দিয়ে রফতানি আয় বাড়ানোর চেষ্টা মোটেও স্থায়ী সমাধান নয়। এ ধরনের নীতিগত দুর্বলতার কারণে রফতানি বাণিজ্যের বিকাশ ব্যাহত হয়েছে।
সব মিলিয়েই রফতানিতে যে সম্ভাবনা ছিল সেটি কাজে লাগানো যায়নি। তবে সম্ভাবনায় এখনো ভাটা পড়েনি। যদি যথাযথ উদ্যোগ নেয়া যায় তাহলে রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা সম্ভব। এজন্য জনগণের দক্ষতা বাড়িয়ে পণ্যে বৈচিত্র্য আনার বিষয়ে ভাবনা জরুরি। রফতানি বৃদ্ধিতে গুটিকয়েক পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। পণ্যে বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের মান উন্নত করতে হবে। দেখা যায়, পোশাক রফতানিতে শীর্ষ হলেও সেখানে বৈচিত্র্য কম। সুতরাং সব পণ্যেই ভিন্নতা আনতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের পণ্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়ায় এর বাজার বিস্তৃতির উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সে সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
বাংলাদেশের শীর্ষ রফতানি বাজারগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, জাপান, চীন, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, সুইডেন, রাশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এসব দেশের বাইরেও অন্য দেশের সঙ্গে রফতানি বাণিজ্য চালু করতে জোরালো চেষ্টা আবশ্যক। বিশেষ করে যেসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বেশি, যেমন চীন ও ভারত। তাদের বাজারে কোনো পণ্য রফতানির সুযোগ আছে কিনা তা পর্যালোচনা করে নীতি কৌশল প্রণয়ন করা চাই।
সেক্ষেত্রে দেশ দুটির মানুষের চাহিদা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে হবে। আবার যেসব দেশে শুল্কমুক্ত পণ্য প্রবেশের সুবিধা রয়েছে, সেগুলোর বিষয়েও ভাবতে হবে। তবে এসবের জন্য জনসংখ্যাকে কীভাবে জনসম্পদে রূপান্তরিত করা যাবে, সেটিই মুখ্য। কারণ জনগণ দক্ষ না হলে প্রযুক্তি ও অটোমেশনের যুগে সস্তা শ্রম দিয়ে বিশ্বে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। পাশাপাশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ ছাড়া রফতানি প্রবৃদ্ধি বেশ কঠিন। এজন্য নীতি সহায়তা ও নীতির ধারাবাহিকতাও আবশ্যক, যা বাংলাদেশের শিল্প খাতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।