কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

অনিশ্চয়তাই কি বৈশ্বিক বাস্তবতার বৈশিষ্ট্য?

এম এ হোসাইন [প্রকাশ : দেশ রূপান্তর, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫]

অনিশ্চয়তাই কি বৈশ্বিক বাস্তবতার বৈশিষ্ট্য?

বিশ্ব যখন ২০২৬ সালের দোরগোড়ায়, তখন অনিশ্চয়তাই বৈশ্বিক বাস্তবতার সবচেয়ে স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। অতীতের যুগগুলোর মতো কেবল অর্থনৈতিক চক্রের ওঠানামা কিংবা পরিচিত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিয়ে আজকের অস্থিরতাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। বরং প্রযুক্তিগত বিপ্লব, বদলে যেতে থাকা ভূ-রাজনৈতিক জোট এবং আকস্মিক সংকট এই তিনের সম্মিলিত অভিঘাতই বিশ্বব্যবস্থাকে এমনভাবে রূপান্তরিত করছে, যা অনুমান করা কঠিন। এই ঘটনাগুলোকে প্রায়ই ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ বলা হয় যা সম্ভাবনায় ক্ষীণ, কিন্তু প্রভাবের দিক থেকে অতিমাত্রায় গভীর। এগুলো অর্থনীতি, রাজনৈতিক কাঠামো ও আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনকে আমূল পাল্টে দেয়। আগামী পর্যায়ের বৈশ্বিক গতিপথ নির্ধারণে দুটি পারস্পরিক সম্পর্কিত অনিশ্চয়তা বিশেষভাবে কার্যকর হবে। প্রথমত, ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এখনো অত্যন্ত অস্থির, এমনকি পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

 

 

ইউক্রেন যুদ্ধ আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রে থাকলেও অস্থিরতা কেবল পূর্ব ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নয়। মধ্যপ্রাচ্যে অক্টোবর ২০২৩-এ ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের পরিণতি এখনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে যা আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়াচ্ছে এবং বৈশ্বিক শক্তিগুলোর স্থিতিশীলতা রক্ষার সক্ষমতাকে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলছে। এদিকে উত্তর কোরিয়ার মতো পারমাণবিক অস্ত্রধারী ও অনিশ্চিত নেতৃত্বসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলো স্থায়ী ঝুঁকি হয়ে আছে; আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু ভঙ্গুর রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃসীমান্ত সংঘাতে সহজেই জড়িয়ে পড়তে পারে। দ্বিতীয় বড় অনিশ্চয়তা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিপথ নিয়ে। কভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কার পর বিশ্বঅর্থনীতি যে নাজুক পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটছে, তার প্রধান চালিকাশক্তি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন। বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। এটি দ্রুত উৎপাদনশীলতা, শ্রমবাজার ও শিল্প কাঠামো বদলে দিচ্ছে। কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর প্রবৃদ্ধির এ মডেলের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ঝুঁকি। এর ফলে বাজারে স্ফীতির আশঙ্কা, সম্পদ সৃষ্টিতে বৈষম্য এবং এমন কাঠামোগত ধাক্কা, যা বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে পারে। ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার ভেতর দিয়ে এই এআই-নির্ভর প্রবৃদ্ধি টিকে থাকবে কি না, এটাই আসন্ন দশকের অন্যতম নির্ধারক প্রশ্ন।

 

 

 

এই দুই অনিশ্চয়তা (ভূ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) বিবেচনায় নিলে, ২০২৫-পরবর্তী বিশ্বের জন্য চারটি বিস্তৃত দৃশ্যপট সামনে আসে। প্রথমটি ‘সহনশীল বিশ্ব’, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। দ্বিতীয়টি ‘শান্তি ও সমৃদ্ধি’। যেখানে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনাও কমে আসে। তৃতীয়টি ‘স্থবির বিশ্ব’। যেখানে অর্থনৈতিক গতি শ্লথ, তবে ভূ-রাজনৈতিক চাপও কিছুটা লাঘব হয়। আর শেষটি ‘দুর্যোগের সময়’। যেখানে একযোগে অর্থনৈতিক মন্দা ও তীব্র ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়।

 

 

বাস্তবে এই চারটির উপাদানই কোনো না কোনো মাত্রায় সহাবস্থান করবে। তবে ‘সহনশীল বিশ্ব’ ও ‘দুর্যোগের সময়’ এই দুই দৃশ্যপট সবচেয়ে সম্ভাব্য। বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির স্থায়ী অস্থিরতা তুলনামূলক আশাবাদী ‘শান্তি ও সমৃদ্ধি’ ধারণাকে কম বাস্তবসম্মত করে তোলে। ‘সহনশীল বিশ্ব’ দৃশ্যপটটি এক ধরনের সতর্ক আশাবাদের প্রতিফলন। প্রবৃদ্ধি সমানভাবে ছড়াবে না; তবে ভারত ও কিছু এশীয় অর্থনীতির মতো উদীয়মান বাজারগুলো প্রযুক্তি বিনিয়োগ ও জনমিতিক সুবিধার কারণে এগিয়ে থাকবে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বিত নীতিগত পদক্ষেপের ওপর জোর দিচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ, আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সহনশীলতা জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন এবং বলেছেন একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও অভিযোজনক্ষম বৈশ্বিক অর্থনীতি এখনো সম্ভব। তবু এই দৃশ্যপটেও অর্জিত অগ্রগতি নাজুক; উন্নত ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির মধ্যকার বৈষম্য সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে। এআই এই সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধির কেন্দ্রে। কিছু হিসাব বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রায় ৪০ শতাংশই এআই-সম্পর্কিত বিনিয়োগ ও প্রয়োগের সঙ্গে যুক্ত। ষাটের দশকের পর দীর্ঘ সময় ধরে নিম্ন প্রবৃদ্ধির যে ধারা ছিল, তার মধ্যেও এআই উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করেছে।

 

 

 

কিন্তু এই নির্ভরতা একটি কেন্দ্রীভূত প্রযুক্তি-স্ফীতির ঝুঁকিও তৈরি করে, বিশ্বাসের হঠাৎ পতন বা বাজার সংশোধন সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক ধাক্কা আনতে পারে। একই সঙ্গে বিশ্বায়নের গতি মন্থর হয়েছে; ম্যাককিনসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের পর থেকে চীনে পশ্চিমা বিনিয়োগ প্রায় ৭০ শতাংশ কমেছে যা ভূ-রাজনৈতিক টানাপড়েনে ও কৌশলগত সঙ্কোচনের প্রতিফলন। এর বিপরীতে ‘দুর্যোগের সময়’ দৃশ্যপটটি একটি কঠোর সতর্কবার্তা। এটি ইতিহাসের রাশিয়ার ‘টাইম অব ট্রাবলস’ (১৫৮৪-১৬১৩) সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। যা ছিল রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, দুর্ভিক্ষ ও বিদেশি হস্তক্ষেপে বিধ্বস্ত এক যুগ। আধুনিক প্রেক্ষাপটে, এই দৃশ্যপট জন্ম নিতে পারে আঞ্চলিক সংঘাতের অবনতি, দুর্বল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির আকস্মিক ধসের সম্মিলনে। এআই বিনিয়োগের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল যুক্তরাষ্ট্র এতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা কেবল অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাই নয়, বৈশ্বিক শক্তি প্রদর্শনের সক্ষমতাকেও দুর্বল করবে। আরেকটি জটিলতা হলো,  বৈশ্বিক ঋণের নজিরবিহীন মাত্রা।

 

 

আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরের মধ্যে বৈশ্বিক ঋণ জিডিপির প্রায় ১০০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় সরকারগুলোর আর্থিক সক্ষমতা সীমিত থাকবে। এর ফল হতে পারে সুরক্ষাবাদী ও প্রতিবেশীকে ক্ষতিগ্রস্তকারী নীতির বিস্তার, বিশ্বায়নের আরও পশ্চাদ্পসরণ, বাণিজ্য সংকোচন এবং বড় শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার তীব্রতা বৃদ্ধি। এটি ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

ইউক্রেন, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের সংঘাত অবনতিশীল বৈশ্বিক পরিবেশে আরও বিস্তৃত হতে পারে। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চাপ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা যদি বড় শক্তিগুলোর পররাষ্ট্রনীতি সীমিত করে ফেলে, তবে এসব সংঘাত নিয়ন্ত্রণের প্রণোদনা কমে যাবে হয়তো। তখন স্থানীয় বিরোধ সহজেই বৃহত্তর সংকটে রূপ নিতে পারে, যার প্রভাব আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় সুদূরপ্রসারী হবে। তবু এই চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যেই সুযোগও রয়েছে। এআই ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সংঘাত ব্যবস্থাপনা, আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা ও বৈশ্বিক শাসন কাঠামোয় নতুন সম্ভাবনা এনে দিতে পারে।

 

 

 উদীয়মান অর্থনীতিগুলো উদ্ভাবন ও জনমিতিক প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করতে পারে। মূল চাবিকাঠি হবে, উদ্ভাবননির্ভর প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কার্যকর সংঘাত প্রশমন কৌশলের ভারসাম্য রক্ষা। শেষ পর্যন্ত, আসন্ন দশক কৌশলগত দূরদৃষ্টি ও অভিযোজন-ক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে। নীতিনির্ধারকদের প্রস্তুত থাকতে হবে একাধিক সমান্তরাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য তা আর্থিক সংকট থেকে আঞ্চলিক যুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্যবসা ও বিনিয়োগকারীদের হিসাব কষতে হবে অসম প্রবৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত রূপান্তরজনিত বাজার অস্থিরতার ঝুঁকি নিয়ে। নাগরিক সমাজকেও এমন বাস্তবতায় পথ চলতে হবে, যেখানে সমৃদ্ধির সুযোগের পাশাপাশি গভীর কাঠামোগত ঝুঁকি সহাবস্থান করবে। ২০২৬ এবং তার পরের সময়ের সবচেয়ে নির্ধারক বৈশিষ্ট্য হবে অনিশ্চয়তাই।

 
 
 

‘সহনশীল বিশ্ব’ কিছুটা আশাবাদের কাঠামো দিলেও ‘দুর্যোগের সময়’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সামান্য ভুল হিসাবও ধারাবাহিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কৌশলগত নমনীয়তা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বিচক্ষণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাই হবে সেই সময় পার হওয়ার প্রধান অবলম্বন, যখন ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক ব্যাঘাত একসঙ্গে চলবে। পরিশেষে বলা যায়, মহামারী-পরবর্তী যুগ পূর্ব-২০২০ ধারাবাহিকতার সরল সম্প্রসারণ নয়; এটি প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা ও ভূ-রাজনৈতিক ভঙ্গুরতায় চিহ্নিত এক রূপান্তরমূলক অধ্যায়।

 

 

 

বিশ্ব কীভাবে এই দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে, তার ওপরই নির্ভর করবে, এই দশক সহনশীল অভিযোজনের গল্প হবে, নাকি সংকটের পর সংকটে জর্জরিত সময়। সরকার, প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের জন্য বার্তাটি স্পষ্ট : অপ্রত্যাশিতের জন্য প্রস্তুতি নিন, সহনশীলতা গড়ে তুলুন এবং নিশ্চিততার খোঁজে না গিয়ে, জটিলতার সঙ্গে যুক্ত হোন। ‘ব্ল্যাক সোয়ান’-এর যুগে প্রস্তুতিই হতে পারে,  সবচেয়ে মূল্যবান ও কার্যকরী পদক্ষেপ।

 

 

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক