কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

অনিশ্চয়তার ঘুরপাকে অর্থনীতি

আব্দুল বায়েস । সূত্র : বণিক বার্তা, ১৩ মার্চ ২০২৫

অনিশ্চয়তার ঘুরপাকে অর্থনীতি

বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য গত ক’টা বছর খুব একটা ভালো যায়নি। প্রথমে করোনা উৎপাদন ও বণ্টনে নিয়ে এল এক অনিশ্চয়তা। মানুষ ঘরে বন্দি, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাটা। সেই সংকট কাটিয়ে থিতু হতে না হতেই বাধল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ— যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। আবার অনিশ্চয়তার মুখে পড়ল পৃথিবীর ছোট-বড় সব অর্থনীতি। বলা হয় যে যুদ্ধটি সাপ্লাই চেইন বিপুল বিঘ্নিত হয়ে উসকে দিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের দামামা একটু হলেও ফেলল কপালে ভাঁজ। অতি সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় যে বাণিজ্য যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে তা প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাপে ফেলতে পারে বলে ধারণা করছে বিজ্ঞ মহল। এখানেও অনিশ্চয়তার কালো মেঘে ঢাকা অর্থনীতির আকাশ।

 

 

 

উপরোক্ত উপাদানগুলো নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের কিছু করার নেই কিংবা ছিল না। অর্থনীতির ভাষায় এগুলোকে বলে এক্সোজেনাস ফ্যাক্টরস। কিন্তু বাংলাদেশকে অনিশ্চয়তার গাঢ় অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল তৎকালীন অভ্যন্তরীণ বেশকিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপাদান। মোটা দাগে যাকে বলে সুশাসনের সংকট। এমন উপাদানের মধ্যে আছে মারাত্মক ভুল মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি, আকাশচুম্বী দুর্নীতি, ব্যাপক অর্থ পাচার, খাজনা-খাওয়া (রেন্ট সিকিং), তোষণ পুঁজিবাদ, দুঃশাসন, জবাবদিহিতার অভাব, ব্যবসাবান্ধব নীতির জায়গায় ব্যবসায়ীবান্ধব নীতি ইত্যাদি। বস্তুত উন্নয়ন বয়ান বিধৃত হতো এসব বিষয় পাশ কাটিয়ে। বলাবাহুল্য, নৈরাজ্যের ধারাবাহিকতায় ছাইচাপা আগুনের মতো বাড়তে থাকে জনক্ষোভ এবং অবশেষে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ অভ্যুথানের মুখে তৎকালীন সরকারের পতন ঘটলে হতাশাগ্রস্ত জনমনে কুয়াশা ভেদ করে আলো দেখার প্রত্যাশা জাগে।

 

 

 

দুই.

 

অর্থনীতি আগের চেয়ে ভালো চলবে—এমন প্রত্যাশা জাগার অন্যতম প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারপ্রধান একজন বিশ্বনন্দিত নোবেলজয়ী অরাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব। বাংলাদেশে অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা ক্ষমতায় থাকুক এমনটি চাইবার মানুষের অভাব নেই—কি বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কিংবা মিডিয়া জগতে। তাদের ধারণা, রাজনীতিবিদ মানেই মন্দ, বি-রাজনীতি মধু। তাছাড়া এ সরকারের তিন তিনটি জায়গায় বসেছেন তিন তিনজন খ্যাতিমান খাস অর্থনীতিবিদ—অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। অর্থমন্ত্রীর কথাই যদি বলি এবং সবচেয়ে বড় কথা এদের সবারই বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রথম কয়েকজনের মধ্যে স্থান ছিল এবং সমাজে তাদের যথেষ্ট সুনাম আছে।

 

 

 

তিন.

এমনিতে সাধারণ মানুষের ধারণা এই যে অর্থনীতিবিদরা অর্থ মন্ত্রণালয় পেলেই বুঝি অর্থনীতি ভালো চলবে। যুক্তি যথার্থ কারণ ডাক্তারের হাতে রোগী নিরাপদ থাকে, ওঝার হাতে নয়। এবার তো আবার ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ঘটে গেল এমনকি প্রধান উপদেষ্টা স্বয়ং অর্থনীতিতে পিএইচডি এবং আরো দুএকজন উপদেষ্টাও অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতির হালহকিকত নিয়ে প্রত্যাশার পারদ যে আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি থাকবে তা বলাই বাহুল্য। প্রত্যাশার ষোলকলা পূর্ণ তখনই যখন ধরে নেয়া হয় যে অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের সব সদস্য ভালো মানুষ—যোগ্যতায়, দক্ষতায় ও নৈতিকতায়। সুতরাং রাখে অর্থনীতিবিদ মারে কে!

 

 

চার.

জুলাই-আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যুথান যে সরকারের জন্ম দিয়েছে সে সরকারের অর্থনৈতিক কৃতিত্বের সমালোচনা করার সময় এখনো আসেনি, কারণ সরকারের বয়স মাত্র সাত মাস। তবে গত মাসগুলোয় এ সরকারের আমলে ইতিবাচক এবং আশা জাগানিয়া কাজের মধ্যে আছে ব্যাংকগুলোর রক্তক্ষরণ বন্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ, বৈদেশিক মুদ্রার বাজার এবং রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা, সংস্কার সাধনে বেশ ক’টা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন তৈরি, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ, চার মাসের আমদানি রিজার্ভ, স্থিতিশীল বিনিময় হার, লেনদেনের ভারসাম্য ইত্যাদি। সন্দেহ নেই যে ছয় মাসে অর্জিত এ ইতিবাচক পদক্ষেপ এরই মধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এর বিপরীতে সমালোচনার ঝুড়িতে আছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যর্থতা (যদিও ১ শতাংশ কমেছে বলে দাবি করা হচ্ছে), উচ্চ সুদের হারে ব্যাংক ঋণের জন্য স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফেরে বিনিয়োগ প্রায় শূন্যের কোটায় এবং অর্থনৈতিক মন্দার হুমকি মোকাবেলায় কার্যকর সরকারি পদক্ষেপের অনুপস্থিতি। সমালোচকদের চোখে আইএমএফের নির্দেশে নীতিমালা গ্রহণে গলায় আঙুল দেয়া, চাঁদাবাজি, দখলদারি, আমলানির্ভরতা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও টেন্ডার দখলদারত্ব বিগত সরকারের আমলের অনুসরণ বলে মনে করছেন বিজ্ঞ সমালোচকরা।

 

 

পাঁচ.

এতগুলো ইতিবাচক অর্জনের পরও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা ক্রমেই বাড়ছে এবং তা বড় বেগে বইছে, চায়ের কাপে তুলছে ঝড়। কারণগুলো নিম্নরূপ: প্রথমত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি অর্থনীতির চাকা রুদ্ধ করছে বলে প্রতীয়মান হয়। অভ্যুথানের ছয় মাস পরও বিভিন্ন বাহানায় চারদিকে হাঙ্গামা, ভাংচুর, তাণ্ডবের মচ্ছপে জনগণ ভীতসন্ত্রস্ত, ব্যবসায়ী মহল আতঙ্কে দিন কাটায়— আগে দিতে হতো ৫০ টাকা, এখন দিতে হয় ১০০ টাকা। অথচ অভিযোগ আছে যে সবই ঘটছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায়। এরই মধ্যে বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীরা এবং বিদগ্ধ রাজনীতিক মহল, বিশেষত ৩২ নং গুঁড়িয়ে দেবার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে দায়ী করে দায়ভার নিতে বলছেন। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনী অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। কারণ বিনিয়োগকারী জানে না এ সরকারের গৃহীত নীতিমালা কত দিন টিকবে কিংবা এ সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন আরো ছয় মাস, এক বছর না কয়েক বছর। যদি সব সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেয়ার কথা হয় তাহলে তো কয়েক বছরই লাগার কথা। কিন্তু বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া দরকার মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য, ব্যবসা-বাণিজ্যে জোয়ার জাগানোর জন্য। স্বয়ং শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সভাপতি অভিযোগ করেছেন যে সরকার অর্থনীতিকে টেনে তোলার অভিপ্রায়ে শ্বেতপত্র কমিটি কর্তৃক সুপারিশ বাস্তবায়নে এখনো কিছুই করেননি। তৃতীয়ত, সত্য কিংবা মিথ্যা, জনমনে একটা ধারণা এই যে বর্তমান সরকার খুব দুর্বল একটা সরকার যার কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই অথবা ‘সরকারের ভেতর সরকার’-এর কারণে এক পা এগোলে দুপা পিছায়। এমন অবস্থায় অর্থনীতির চাকা প্রত্যাশিত মাত্রায় সচল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

 

 

ছয়.

অতি সম্প্রতি ঘোষিত মুদ্রানীতিতে নীতি সুদের হার এবং ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ নিশানা মোটামুটি আগের জায়গায় রাখা হয়েছে এবং আশা করা যাচ্ছে জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশ খানিকটা হ্রাস পেয়ে ৭-৮ শতাংশে নেমে আসতে পারে। আমরা মুদ্রানীতির সাফল্য কামনা করি কিন্তু চলমান অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অর্থনৈতিক অমঙ্গল ডেকে আনতে পারে। একদল লোক ছাত্র-জনতার নামে উগ্র মনোভাবে বিভিন্ন জায়গায় হামলা ভাংচুর করে সরকারের জন্য বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করছে। সরকারের উচিত লৌহ হস্তে দমন করা, কারণ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন প্রভুকে সাহায্য করে সে-ই একসময় প্রভুকেই গিলে খায়। অতএব সাধু সাবধান!

 

 

সাত.

স্বয়ং উপদেষ্টাদের কেউ কেউ মনে করছেন সরকার বদল হওয়ার পর চাঁদাবাজি, দখলদারত্ব উবে যায়নি, মালিকানা বদলেছে মাত্র। অংক কষে দেখাচ্ছেন ৫ হাজার টাকার পরিবহন খরচ কীভাবে ১৫ হাজার টাকায় ওঠে। অথচ আমরা এর বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ দেখতে পারছি না। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘‌একটি পণ্য মোকাম থেকে ঢাকায় আসা পর্যন্ত কয়েক জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। বড় বড় ব্যবসায়ীর ব্যবসা এখন অন্যরা চালাচ্ছে কিন্তু খুব দক্ষতার সঙ্গে চালাচ্ছে না। আর ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী ভয়ে ব্যবসা গুটিয়ে বসে আছে। এতে লোকজনের কর্মসংস্থান হচ্ছে না।’

 

 

অর্থনীতিশাস্ত্রে দেখানো হয়েছে প্রত্যাশা ভোক্তার চাহিদাকে কীভাবে প্রভাবিত করে। এও বলা হয়, অনিশ্চয়তা হচ্ছে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু। বর্তমান অনিশ্চয়তা দূর করতে হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে আরো সরব হতে হবে, নীরব থাকলে চলবে না। মনে রাখতে হবে যে বাহানায়ই অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়ে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হোক না, তার দায়ভার পুরোটাই সরকারের ওপর বর্তায়। সুতরাং আমরা আশা করব আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকার কোনোভাবে চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে নির্মোহ, কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং তা করতে গিয়ে অবশ্যই রাজনীতিকে সঠিক রাস্তায় আনা দরকার। কারণ রাজনীতি হচ্ছে অর্থনীতির প্রভু। বাংলাদেশের অর্থনীতির বেহাল দশা মেধাবী অর্থনীতিবিদের অভাবে নয়, বেহাল দশা স্বচ্ছ রাজনীতির অভাবে।

 

 

আট.

‘নতুন বিনিয়োগের চিন্তা করছেন না উদ্যোক্তরা’—এ শিরোনামে একটা খবর ছাপিয়েছে বণিক বার্তা (গত ৯ ফেব্রুয়ারি) যেখানে দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতিদের মতামত তুলে ধরা হয়েছে নিম্নরূপ— ১. ‘সার্বিকভাবে পরিস্থিতি অনিশ্চিত এবং স্বস্তি নেই। অর্থনীতিতেও তাই। নতুন বিনিয়োগের চিন্তা এখন কেউ করছে না। অনেকে সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে ভয়ের মধ্যে আছে’ (তপন চৌধুরী, স্কয়ার গ্রুপ); ২. ‘ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ। প্রায় ১৫-২৫ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন ও বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি কমেছে। ব্যবসায় নতুন বিনিয়োগ নেই, পুরনো ব্যবসাই চলছে। যা চলছে তা আরো কমছে’ ‌(আজম জে চৌধুরী, ইস্টকোস্ট গ্রুপ); ৩. ‘যদি স্থানীয় বিনিয়োগ বাড়াতে হয় বা বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হয়, নীতি কাঠামোটি ব্যবসাবান্ধব হওয়া খুব প্রয়োজন। তাৎক্ষণিকভাবেই এটা প্রয়োজন। বিনিয়োগকারীদের সমস্যা অনুধাবনে সরকারের গতি শ্লথ’ (আলী হোসাইন আকবর আলী, বিএসআরএম); ‘এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি, আইন-শৃঙ্খলা যেগুলো উন্নতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেগুলোর কোনো উন্নতি হয়নি। আর বিনিয়োগ তো হচ্ছেই না’ (মস্তফা কামাল, মেঘনা গ্রুপ)। তেমনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রাণ গ্রুপের কর্ণধার। মোটা দাগে এরা আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখেন এবং তাদের মতামত জানা জরুরি। ব্যবসায়ীদের যেমন মাথায় তোলার দরকার নেই, তেমনি পায়ে ঠেলে দিলে অর্থনীতির জন্য সমূহ বিপদ। একটা সর্বজনগ্রহণযোগ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত একটা নির্বাচন অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে সক্ষম হতে পারে।

 

 

আব্দুল বায়েস: অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়