কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট ভাবনা

[প্রকাশ: মিশুক মনজুর, ১ জুন ২০২৫]

অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট ভাবনা
সরকার সবসময় জনবান্ধব বাজেট উপহার দিতে চান এবং একই সঙ্গে সরকারের স্বার্থ রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকেন যা স্ববিরোধী। প্রত্যেক সরকার ক্ষমতায় এসে জনবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব, কল্যাণকামী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখান। বাস্তবে কতটা পারেন? জনগণের করের টাকায় বাজেট বাস্তবায়ন হয়, তাই তার সুফলও জনগণের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হবে। সরকার ঋণ পরিশোধ করুক, কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়ানোসহ কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের সুযোগ না থাকলে এ বাজেটকে একটি গতানুগতিক বাজেট ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণ একটি ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং জনবান্ধব বাজেট প্রত্যাশা করে।
 
 
 
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট প্রণয়ন একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে বাজেট রাজনীতি বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। কোন সরকার কত বড় আকারের বাজেট প্রণয়ন করতে পারে তার একটি প্রতিযোগিতা থাকে। এমনকি বর্তমান অর্থবছরের বাজেট অবশ্যই গত অর্থবছরকে ছাড়িয়ে যাবে এটিই যেন নীতি। অথচ বাজেটের মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়ন করা। অন্তর্বর্তী সরকার বাজেট নিয়ে কী ভাবছে এবং কী কৌশল অবলম্বন করছে বর্তমান অর্থনীতির জন্য তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
 
 
 
 
২ জুন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ নতুন প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করবেন। সংসদ অনুপস্থিত থাকায় দেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে এমন বাজেট পেশ নতুন নয়। সংসদ থাকলে একটি বাজেট অধিবেশন থাকে এবং প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে সে সুযোগ নেই। তবে সংসদের বাইরেও বাজেট নিয়ে বিস্তর আলোচনার সুযোগ রয়েছে। নানা পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বিশিষ্টজনদের সম্পৃক্ত করে গোলটেবিল বৈঠক, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে বাজেটকে অর্থবহ করার সুযোগ নিতে হবে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিশ্চয়ই সেসব আলোচনাকে আমলে নিয়ে সত্যিকারের জনবান্ধব বাজেট উপহার দেবেন।
 
 
 
বাজেট একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সরকার কোন কোন খাত থেকে কত আয় করবে, কোন কোন খাতে কত ব্যয় করবে এবং কী পরিমাণ বরাদ্দ থাকবে এসবের একটি সুসংগঠিত ঘোষণাই হচ্ছে বাজেট। প্রতি অর্থবছরে বাজেট পেশের মাধ্যমে সরকার তার উন্নয়ন কৌশল, রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং আর্থ-সামাজিক অগ্রাধিকারের দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাজেট একটি নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার। তাই যেকোনো সরকার বাজেট ঘোষণার ক্ষেত্রে গভীর চিন্তাভাবনা করে থাকেন। একটি সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা অনেকাংশে বাজেট নীতির ওপরই নির্ভর করে। একটি ভুল বাজেট একটি দেশের অর্থনীতিকে শুধু পিছিয়েই দেয় না, সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা, কল্যাণ ও জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
 
 
 
 
গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের পতনের পর অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, উচ্চ মূলস্ফীতি, রাজস্ব ঘাটতি, ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকট এবং বৈদেশিক ঋণের বোঝা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা শুরু করে। খাদের কিনারের অবস্থান করা অর্থনীতিকে টেনে তুলতে সরকারের প্রাণান্তকর চেষ্টাও যেন সফলতার মুখ দেখছে না। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা অতি সহসায় এসব সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। একটি নির্বাচিত এবং স্থিতিশীল সরকার এলে এ সংকট কাটতে পারে। তা ছাড়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নানা সীমাবদ্ধতায় সব কাজ সম্ভব নয়।
 
 
 
বাংলাদেশের বাজেট মূলত ঘাটতি বাজেট। ঘাটতি বাজেট হলো একটি দেশের সরকারের ব্যয় তার আয়ের থেকে বেশি হয়ে থাকে। অর্থাৎ সরকার যত টাকা আয় করে তার থেকে বেশি খরচ করে। ঘাটতি বাজেটের অন্যতম প্রধান সমস্যা ঋণের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, বিনিয়োগ হ্রাস এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘাটতি বাজেট উন্নয়নমূলক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করে বিশেষ করে অর্থনৈতিক মন্দার সময়। একটি ঘাটতি বাজেট ভালো না খারাপ তা নির্ভর করে কী কারণে এবং কীভাবে বাজেটের অর্থ ব্যয় বা ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর।
 
 
 
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট অনুমোদিত হয় যা বিগত যেকোনো বছরের তুলনায় বড় বাজেট। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের সম্ভাব্য বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা যা বিগত বছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম।
 
 
 
বাজেটে কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন উল্লেখ করেছেন। তারা মনে করছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও জ¦ালানি নিরাপত্তা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নই হবে প্রধান চ্যালেঞ্জ। বিগত সালের বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান খাতে বরাদ্দ অপ্রতুল। এবারও সম্ভবত এসব খাতে নতুনত্ব থাকছে না।
 
 
 
এ কথা ঠিক বড় বাজেট মানেই ভালো বাজেট নয়। তবু সব সরকারই আগের অর্থবছরের তুলনায় বড় আকারের বাজেট দিতে অভ্যস্ত। মূলত টেকসই উন্নয়নই বাজেটের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। সরকারি তথ্য মতে এবারের বাজেট কোনোভাবেই উচ্চাভিলাষী হচ্ছে না এবং এ বাজেটে অবাস্তব ও অবাস্তবায়নযোগ্য কোনো মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হবে না। যার কারণে বাজেটের আকার গত অর্থবছরের তুলনায় ছোট হচ্ছে। তবে টাকার অঙ্কে এবারের বাজেট গত বছরের তুলনায় বড় নয়। বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এটি একটি ছোট বাজেটও নয়। কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। প্রতি বছর বাজেট এলেই জনগণের অস্বস্তি বাড়ে। কোন কোন পণ্যের দাম বাড়বে আর কোন কোন পণ্যের দাম কমবে তা নিয়ে জনগণকে ভয়ে থাকতে হয়। আবার প্রতি বছরই করের বোঝা কোনো না কোনোভাবে বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় আয় বা ব্যবসা বাড়ছে না। জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবায় বিরূপ প্রভাব পড়ে এমন ক্ষেত্রে অবশ্যই করের বিকল্প খুঁজতে হবে।
 
 
 
অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটে সুস্পষ্ট কোনো রূপরেখা এখনও দৃশ্যমান নয়। কোন কোন বিষয় বাজেটে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে তা নিয়েও কোনো আলোচনা চোখে পড়ছে না। বর্তমান সংকটময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং সম্ভাব্য আগামী জুনের মধ্যে নির্বাচন বিবেচনায় কেমন বাজেট হতে চলেছে তার একটা সুস্পষ্ট রূপরেখা অবশ্যই থাকা উচিত। যেহেতু কোনো সংসদ কার্যক্রম চলমান নেই, তাই জনগণের অংশগ্রহণের প্রশ্নটি বারবার আলোচনায় আসছে।
 
 
 
 
আগামী বাজেট কেমন হতে পারে এমন এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ বছরের বাজেটটি হবে সমতাভিত্তিক ও কল্যাণকামী বাজেট। আগে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল তার সুবিধা সবাই পাননি। এবার যেন প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই পান সেই লক্ষ্যে কাজ করছেন। এ বাজেট হতে যাচ্ছে জনগণের জীবন-জীবিকা উন্নত করার বাজেট। কিন্তু অনেক বিশ্লেষকদের মতে কতটুকু কল্যাণকামী বাজেট হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। জনগণকে সম্পৃক্ত না করে এবং বিশেষজ্ঞদের ডিবেটের সুযোগ না দিয়ে কোনো বাজেট ঘোষিত হলে তা অর্থবহ হবে না। তা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার নতুন কী কী সংযোগ করতে পারল তা নিয়েও জনগণের আগ্রহের কমতি নেই।
 
 
 
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ দেশের মালিক এবং জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। কিন্তু সরকার যখন বাজেট প্রণয়ন করে তখন তার মালিকদের কতটুকু প্রাধান্য দেন? সরকার সবসময় জনবান্ধব বাজেট উপহার দিতে চান এবং একই সঙ্গে সরকারের স্বার্থ রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকেন যা স্ববিরোধী। প্রত্যেক সরকার ক্ষমতায় এসে জনবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব, কল্যাণকামী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখান। বাস্তবে কতটা পারেন? জনগণের করের টাকায় বাজেট বাস্তবায়ন হয়, তাই তার সুফলও জনগণের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হবে।
 
 
 
সরকার ঋণ পরিশোধ করুক, কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়ানোসহ কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের সুযোগ না থাকলে এ বাজেটকে একটি গতানুগতিক বাজেট ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণ একটি ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং জনবান্ধব বাজেট প্রত্যাশা করে। অনেক অর্থনীতিবিদের ধারণা, অন্তর্বর্তী সরকার পুরোনো পথ থেকে বেরিয়ে কিছু চমক দেখাতে পারবে তেমন মনে হচ্ছে না। শুধু কিছু বিষয় কাটছাঁট করে এবং বরাদ্দ কমিয়ে-বাড়িয়ে একটি গতানুগতিক বাজেটের দিকেই হাঁটছে সরকার।
 
 
 
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অন্য সরকার থেকে আলাদা, তাই প্রত্যাশা বেশি। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। তার হয়তো অনেক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সাধারণ জনগণ তো এতসব ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ বুঝবে না। তাই বাজেটে বিশিষ্টজনসহ জনগণকে যতবেশি সম্পৃক্ত করা যাবে বাজেট ততবেশি ফলপ্রসূ হবে। বাজেট হতে হবে জনকেন্দ্রিক, স্বচ্ছ এবং বাস্তবায়নযোগ্য।