অন্তর্বর্তী সরকারের কত দিন ক্ষমতায় থাকা উচিৎ
অন্তর্বর্তী সরকারের কত দিন ক্ষমতায় থাকা যুক্তিসংগত, তা নিয়ে লিখেছেন এস কে তৌফিক হক, সৈয়দা লাসনা কবীর ও মোহাম্মাদ ঈসা ইবন বেলাল। সূত্র : প্রথম আলো, ১৯ এপ্রিল ২০২৫

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার কত দিন ক্ষমতায় থাকবে বা থাকা উচিত, সে বিষয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা চলছে। এ আলোচনা মূলত দুটি কারণে তৈরি হয়েছে: এক. দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপি নির্বাচনের জন্য সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করছে; দুই. সংস্কার, আওয়ামী লীগের বিচার এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মতবিরোধ।
এই বিতর্কের গভীরে প্রবেশ করার আগে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের পূর্ববর্তী সরকারগুলোর পার্থক্য বিবেচনা করা দরকার। বাংলাদেশ রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সরকার আগে গঠিত হয়নি। মনে রাখতে হবে, এটি কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয় বা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত কোনো ‘সেনা-সমর্থিত’ সরকারও নয়; বরং এটি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সংঘটিত ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত একটি সরকার।
বিগত সরকার দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণের মাধ্যমে দেশকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিল। মানুষের বাক্স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকারকে সুদূরপরাহত করা হয়েছিল। সেই ভঙ্গুর দেশকে সামনে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের কাঁধে। প্রায় দেড় হাজার শহীদ ও ২০ হাজার মানুষ আহত হওয়ার বিনিময়ে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রতি জনমানুষের প্রত্যাশা বেশি থাকবে, এটা স্বাভাবিক।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার সীমিত সামর্থ্য দিয়ে সেই আকাশ পরিমাণ স্বপ্নকে বাস্তবায়নের কাজ করে যাচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে; এর বড় উদাহরণ এবারের পুরো রমজানে দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরে রাখা। পাশাপাশি এবারের ঈদযাত্রায় সরকার যানজট নিরসন করে জনগণের ভোগান্তি লাঘব করতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে বিপর্যয় হয়েছিল, তার উন্নতিতেও এই সরকার যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। ফলে এই সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা ও প্রত্যাশা—দুটিই দিন দিন বাড়ছে, কেউ কেউ এমনটা মনে করেন।
আমাদের দেশের মানুষকে এ রকম গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সরকারের প্রতি আস্থাশীল হতে দেখা যায়। এর অন্যতম কারণ হলো নির্বাচনের পর যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক, তাদের ও জনতার মধ্যে একধরনের অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়। তাঁরা নিজের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের ভিড় ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের মনের কথা খুব কমই শোনার সুযোগ পেয়ে থাকেন। সে কারণে শুধু নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রচর্চার মধ্য দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কয়েক দশক ধরে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
সুষ্ঠু নির্বাচন কি ভালো সরকার তৈরি করতে পারছে?
বাংলাদেশে ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারটি সাধারণ নির্বাচনকে দেশ-বিদেশের প্রায় সব মহলেই গ্রহণযোগ্য ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এই চারটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারগুলো তাদের পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলেও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সফলতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে; বরং এই ২০ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলোর কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রবণতাই প্রাধান্য পেয়েছে।
দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ক্রমাগত শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখা, সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দলীয়করণ, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও মতের দমন-পীড়ন, নির্বাচনী সহিংসতা এবং বিরোধী দল হিসেবে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা—এসবই ছিল সেই সময়ের রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের প্রতি একধরনের অনীহা ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে।
ক্ষমতাসীন হয়েও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো, তারা ক্ষমতাকে জনগণের সেবায় নয়, দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ক্ষমতায় থাকাকালে তারা প্রধানত বিরোধী দলকে দমন ও ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার কৌশলেই ব্যস্ত থেকেছে। অন্যদিকে বিরোধী দল হিসেবে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো (১৯৯১-২০০৮) সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বাধার সৃষ্টি ও দেশকে অস্থিতিশীল করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে।
এই দুষ্টচক্রের কারণে কোনো নির্বাচিত সরকারই ক্ষমতার মোহ কাটিয়ে প্রকৃত জনকল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। জাতির এই তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আরও কিছু সময় ক্ষমতায় থাকা উচিত’ এ ধরনের গুঞ্জন জনমনে শোনা যাচ্ছে।
বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে বাংলাদেশ বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণভাবে ইতিহাসের এক জটিল ও চ্যালেঞ্জিং পর্যায় অতিক্রম করছে। আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের জনরোষের মুখে পড়ে প্রায় দেশছাড়া হওয়ার অবস্থা তৈরি হওয়া অথবা রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে প্রায় নির্বাসিত হওয়ার মতো ঘটনা—দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
একইভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কও একটি স্পর্শকাতর ও জটিল পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের ভারতের প্রতি
অত্যধিক নির্ভরশীলতা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ দেশের সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া ভারতীয় মূলধারার মিডিয়ায় বাংলাদেশ বিরোধী প্রোপাগান্ডা এই ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের অপর প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধ একটি আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসাকে বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য একটি ট্রান্সফরমেটিভ পর্যায় (রূপান্তর বা পরিবর্তন) হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে তিনি নতুন শুল্কনীতি প্রবর্তন করে বিশ্ববাণিজ্যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছেন, যা বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তার পররাষ্ট্রনীতি এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ভূরাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরি করতে পারে, যার প্রভাবে বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক চীন সফর এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ভারতের একচ্ছত্র প্রভাব বৃদ্ধির বিপরীতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার এই কৌশল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক ইস্যুতে আলোচনা শুরু করেছে; অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে কূটনৈতিক সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। এই দ্বৈত কৌশল বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশকে প্রস্তুত করবে।
এই পটভূমিতে মুহাম্মদ ইউনূসের বৈশ্বিক সুনাম ও নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের জন্য একটি কূটনৈতিক সম্পদ হিসেবে কাজ করছে। বর্তমানে আমরা এক ঐতিহাসিক সময়ের মুখোমুখি হয়েছি, যখন প্রথমবারের মতো অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জন্য একটি আঞ্চলিক ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম প্রধান সাফল্য হতে পারে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জাতীয় সংহতি ধরে রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতির মাধ্যমে রাজনৈতিক সংঘাত প্রশমিত করে দেশকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাওয়াই এখন সবচেয়ে জরুরি। এ মুহূর্তে কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক সম্প্রীতিকে কতটা সাফল্যের সঙ্গে ধরে রাখতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।