অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম মুদ্রানীতি ও পর্যালোচনা
আনোয়ার ফারুক তালুকদার । সূত্র : বণিক বার্তা, ০৫ মার্চ ২০২৫

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এটি একটি অন্যতম রুটিন কাজ। দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছরে দুইবার (জানুয়ারি-জুন ও জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। এ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি (জানুয়ারি-জুন ২০২৫) সুদহার ১০ শতাংশ রেখেই ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন।
প্রকাশিত মুদ্রানীতিতে জানা যায়, চলতি অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশে নামানোর লক্ষ্য রাখা হয়েছে। যদিও নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমেছে, আগের মাস শেষে যা ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার সময় নীতি সুদহার ছিল ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। তিন দফায় ৫০ বেসিস পয়েন্ট করে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর যে কৌশল সেটি যে কাজ করছে এটা তাই প্রমাণ করে। অথচ বিগত আমলে নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রানীতি যে কাজ করে সেটা তারা আমলেই নেননি। ফলে আমাদের দেশ দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে।
অর্থনীতির নিয়ম অগ্রাহ্য করে চললে কী হয় তা তো দেশ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তবে শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে দিলেই যে মূল্যস্ফীতি একেবারে নিয়ন্ত্রণে আসবে তা বলা যায় না। পাশাপাশি আরো যে কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে তা খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। আমাদের বর্তমান মূল্যস্ফীতি অনেকটা সরবরাহজনিত তাই পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর সার্বিক ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের মতো রাখা হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৮ শতাংশ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বেসরকারি তথা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ বাড়ানো জরুরি। তবে মুদ্রানীতির ভালো দিক হচ্ছে সরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, যা গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ। আরেকটি ভালো দিক হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে (রিজার্ভ মানি) মুদ্রা সরবরাহ বাড়াবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। গত জুনে রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ডিসেম্বরে এ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ২ শতাংশ নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়। নতুন মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ১ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। এটা নিঃসন্দেহে একটি সাহসী পদক্ষেপ। যদিও অনেকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ছয় মাসে অর্থনীতিতে বড় কোনো উন্নতি হয়নি; আসলে চোখে পড়ার মতো উন্নতি এত অল্প সময়ে সম্ভব কিনা তা ভেবে দেখা দরকার।
তা সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধারাবাহিক যে অবনতি হচ্ছিল, তা ঠেকানো গেছে। অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর নীতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের নিম্নমুখী প্রবণতা থামানো গেছে। গত ছয় মাসে বাংলাদেশ ৩৩০ কোটি ডলার বকেয়া পরিশোধ করার পরও তা ২০ বিলিয়ন ডলারে স্থিতিশীল আছে। এটা নিঃসন্দেহে স্বস্তির বিষয়। পাশাপাশি ডলারের দর ১২২-১২৪ টাকায় স্থিতিশীল আছে। আশা করি নতুন মুদ্রানীতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে লক্ষ্যমাত্রা অর্থাৎ উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা, বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা, রিজার্ভ বাড়ানো ও ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের আস্থা বৃদ্ধি সেটি অর্জিত হবে।
আনোয়ার ফারুক তালুকদার: অর্থনীতি বিশ্লেষক