অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও পুঁজিবাজারে ধস
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান সময়কার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৬ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পুনরায় চালু হয় এবং পরে ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) গঠিত হয়। ড. মো: মিজানুর রহমান [প্রকাশ : নয়া দিগন্ত, ১০ জুন ২০২৫]

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় রদবদলের পর সাধারণত অর্থনীতিতে কিছুটা অস্থিরতা লক্ষ করা গেলেও অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশে একধরনের স্থিতিশীলতার আবহ তৈরি হয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দেশে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স-প্রবাহ ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশ ব্যাংক, মে ২০২৫)। ডলারের দাম কমেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে, মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমেছে এবং ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরতে শুরু করেছে। অথচ এসব সম্ভাবনার মধ্যেও দেশের পুঁজিবাজার যেন কেবলই ধসে পড়ছে— একটি মৃত্যুশয্যায় উপনীত রোগীর মতো নিঃশেষিত হচ্ছে প্রতিদিন।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের উত্থান ও পতন
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান সময়কার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৬ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পুনরায় চালু হয় এবং পরে ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) গঠিত হয়। এই বাজার দীর্ঘ সময় ধরে এক দিকে যেমন সুশাসনহীনতা ও দুর্নীতির কারণে ১৯৯৬ সালে বাজারে বড় ধরনের ‘বাবল’ সৃষ্টি হয়েছিল, যার ফলে হাজার হাজার সাধারণ বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়, অন্য দিকে তেমন ২০১০ সালের মহাপতনের মাধ্যমে পুঁজিবাজার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আঘাত পায়। ওই সময় বাজার মূলধন এক মাসের ব্যবধানে দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি কমে যায় (বিএসইসি, ২০১১)। সেই ঘা থেকে আজো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি দেশের পুঁজিবাজার; বরং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে যে আশার আলো দেখা যাচ্ছিল, তা ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
২০২৫ সালের মে মাসে এসে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্রড ইনডেক্স (ডিএসইএক্স) পাঁচ হাজার ৩২০ পয়েন্টে নেমে এসেছে, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন্ন। বাজার মূলধন এপ্রিল ২০২৪ থেকে মে ২০২৫ এর মধ্যে প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকা কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকায় (ডিএসই রিপোর্ট, মে ২০২৫)। দৈনিক লেনদেন গড়ে ৩৫০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে, যেখানে ২০২১ সালে এই অঙ্ক ছিল গড়ে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা।
বাজার পতনের কারণগুলো
এবারের বাজার পতনকে কেবল রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দায়ী করলে বড় ভুল হবে; বরং একে একটি বহুস্তরীয়, বহুপারস্পরিক, কাঠামোগত ও নৈতিক সঙ্কটের ফলাফল হিসেবে দেখতে হবে। এখানে মোটা দাগে কিছু কারণ তুলে ধরা হলো। বাজারে মৌলভিত্তিহীন কোম্পানির আধিপত্য অতীতে যেমন ছিল এখনো তারই ধারাবাহিকতা রয়েছে। বর্তমানে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা প্রায় ৩৮০টি। এর মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি কোম্পানির আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব কোম্পানির ইপিএস (Earnings Per Share) নেগেটিভ বা শূন্যের কাছাকাছি, অথচ তারা নিয়মিতভাবে বাজারে লেনদেন করছে। ২০১০ সালের মতোই এসব কোম্পানি মূলত ‘গুজবভিত্তিক’ মূল্যবৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। অনেক কোম্পানির ক্ষেত্রে আইসিবি বা নামকাওয়াস্তে নিরীক্ষা সংস্থার ‘অডিট রিপোর্ট’ দিয়েই লিস্টিং হয়েছে, যা বাজারের প্রতি আস্থা কমিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজার শুরু থেকেই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় দুর্নীতিগ্রস্ত কোম্পানির লিস্টিং ছিল, এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও এর প্রভাব থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। গত ১৫ বছরে দেখা গেছে, সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এবং প্রভাবশালী মহলের মাধ্যমে বিভিন্ন লোকসানি অথবা বন্ধ কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। যেমন— কয়েকটি গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা আগেই বন্ধ হওয়া সাবেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নামে নতুন কোম্পানি গঠন করে বাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করেছে এবং পরে তা গায়েব হয়ে গেছে। দুর্নীতিপরায়ণ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মদদ ছাড়া এটি সম্ভব ছিল না।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, পুঁজিবাজার বিনিয়োগের বদলে বাজারে শোষণ ও অর্থপাচারই যেন অন্যতম। ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (BFIU) ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুসারে, পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করে দেশের বাইরে অর্থ পাচারের চেষ্টা বেড়েছে। অনেক কোম্পানি প্রাইমারি শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ না করে মূলধন বিদেশে পাচার করেছে বলে সন্দেহ রয়েছে। আবার কিছু বিনিয়োগকারী ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিপুল মুনাফা তুলে বাজার থেকে সরে দাঁড়ায় এবং এই অর্থ বিদেশে সরিয়ে নেয়।
ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানির পুঁজিবাজারে আস্থার অভাব রয়েছে ফলে অনাগ্রহ রয়েছে। সুস্থ কোম্পানিগুলো কেন পুঁজিবাজারে আসছে না? কারণ— তারা পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও স্থায়িত্ব খুঁজে পায় না। বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কোম্পানির প্রতি সুশাসন, হিসাবের স্বচ্ছতা, নিয়মিত রিপোর্টিং এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকি বেড়ে যায়। সে জন্যই গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফার্মা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ইউনিলিভার ছাড়া বড় আন্তর্জাতিক বা লোকাল কোম্পানি বাজারমুখী হচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরে সরকারি সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে ১১-১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দেয়া হয় (বাংলাদেশ ব্যাংক, ২০২৪)। শেয়ারবাজারের অনিশ্চিত রিটার্নের বিপরীতে এই নির্দিষ্ট ও ঝুঁকিহীন রিটার্ন মধ্যবিত্ত ও অবসরপ্রাপ্তদের আকৃষ্ট করছে। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগপ্রবাহ কমিয়ে দেয় (সিপিডি, ২০২২)।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়া মুদ্রানীতির ফলে ২০২৩ সালে ব্যাংকের আমানতের সুদের হার ৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে (বাংলাদেশ ব্যাংক, ২০২৩-২৪)। এর ফলে মানুষ এবং প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতে টাকা রাখতে উৎসাহী হচ্ছে। ফলে শেয়ারবাজারে নতুন অর্থপ্রবাহ কমেছে এবং বাজারের তারল্য সঙ্কুচিত হয়েছে। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ প্রায় ৩৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে (ডিএসসি, ২০২৩)। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের নিশ্চিত রিটার্নই এর অন্যতম কারণ। ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপি এবং উচ্চ এনপিএল (Non-Performing Loan) অনুপাতের কারণে পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কমেছে। ২০২৪ সালের মার্চে এনপিএলের হার দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ (বাংলাদেশ ব্যাংক, এপ্রিল ২০২৪)।
বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্বে সুদের প্রভাব পড়েছে। বাজারে আস্থার সঙ্কট ও আর্থিক অনিশ্চয়তা থাকলে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিহীন বিকল্পে ঝুঁকে পড়ে। অর্থনীতিবিদ ড. আইউব হোসেন বলেন, ‘বাজারে আস্থার ঘাটতি, কোম্পানির প্রকৃত আর্থিক অবস্থার অস্পষ্টতা এবং সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদ মিলিয়ে বাজার থেকে লোকজন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে’ (প্রথম আলো, জানুয়ারি ২০২৪)। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য একটি বড় নিরুৎসাহক। বিশেষ করে বর্তমান অনিশ্চিত বাজার পরিস্থিতিতে নিশ্চিত রিটার্নের খোঁজে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। যদিও অন্যান্য কাঠামোগত দুর্বলতাও গুরুত্বপূর্ণ, তবুও সুদের হারের প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই।
দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নির্বাচনকালীন অনিশ্চয়তা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন করেছে। ২০২৪ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিদেশী বিনিয়োগ ১৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যেখানে ২০২৩ সালের একই সময়ে এটি ছিল এক হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, যা কমে ২০২৪ সালে দাঁড়ায় মাত্র এক হাজার ৫২ কোটিতে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দুর্বল মনিটরিং ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বাজারে একাধিক মূল্য-প্রবণতা জালিয়াতি হয়েছে। ২০২৩ সালের শেষে ধরা পড়ে ৯টি প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিক মূল্যে শেয়ার লেনদেন করেছে, যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিএসইসি তিন মাস দেরি করে (Dhaka Tribune, Jan 2024)। অন্তঃসারশূন্য আইপিও ও মুনাফালোভী উদ্যোক্তাও পুঁজিবাজারের পতনের কারণ। সাম্প্রতিক সময়ে বহু কোম্পানি প্রকৃত মুনাফা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম ছাড়াই আইপিও অনুমোদন পেয়েছে। ২০২৩ সালে অনুমোদিত ৪২টি আইপিওর মধ্যে ৩১টি কোম্পানির ইপিএস ছিল এক টাকার নিচে, অথচ তারা ১০ টাকা বা তার চেয়ে বেশি মূল্যে শেয়ার ইস্যু করে (DSE, Annual Report ২০২৩)।
এর সাথে যোগ হয়েছে স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক মনোভাব ও খুচরা বিনিয়োগকারীদের প্যানিক সেলিং। খুচরা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পেশাদার দক্ষতার অভাব এবং গুজবের ভিত্তিতে শেয়ার কেনাবেচার প্রবণতা বাজারকে অস্থিতিশীল করেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি-এপ্রিল পর্যন্ত ডিএসই সূচক প্রায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশ কমে যায়, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক আরো বাড়ায় (DSE Market Summary, ২০২৪)।
পুঁজিবাজার ধস থেকে উত্তরণের উপায়
বাংলাদেশের পুঁজিবাজার দীর্ঘ দিন ধরে আস্থাহীনতা, অস্থিরতা ও বিনিয়োগ সঙ্কটের মধ্য দিয়ে পার হচ্ছে। তবে সুশাসন, প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার, প্রণোদনা ও বিনিয়োগ সচেতনতায় নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সুযোগ রয়েছে। বাজারকে স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই করতে হলে কিছু বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করা সময়োপযোগী ও জরুরি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত করতে হবে। দীর্ঘসূত্রতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং স্বচ্ছতার অভাব নতুন উদ্যোক্তাদের বাজারে আনতে নিরুৎসাহিত করছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তিনির্ভরতা যেমন ইলেকট্রনিক আইপিও (ই-আইপিও) পদ্ধতির বিস্তার, অনুমোদনের সময়সীমা নির্ধারণ এবং স্বচ্ছ স্ক্রুটিনি কার্যক্রম অপরিহার্য।
দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে কর-প্রণোদনার ব্যবস্থা চালু করা উচিত। ২০২৩ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে ৮৩ শতাংশ লেনদেন তিন মাসের কম সময়ে হয়ে থাকে (ডিএসই সার্ভে, ২০২৩), যা বাজারে সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি প্রবাহের অভাবের দিকনির্দেশ করে। তাই দুই বছর বা তার অধিক সময় শেয়ার ধারণকারীদের জন্য কর হ্রাস বা পূর্ণ রেয়াত দেয়া হলে বাজারে স্থায়িত্ব বাড়বে। করপোরেট বন্ড মার্কেটকে বিস্তৃত করার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। করপোরেট বন্ড ইস্যুতে কর ছাড়, রেটিং বাধ্যতামূলককরণ এবং বাজার তৈরি করার জন্য বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যেও বন্ড ব্যবহারের সংস্কৃতি চালু করা যেতে পারে।
বাজার পর্যবেক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বর্তমানে কারসাজি, ইনসাইডার ট্রেডিং ইত্যাদি অপরাধে বাজার আস্থার সঙ্কটে পড়েছে। ভারতের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড (SEBI) ‘Surveillance Mechanism’ চালু করে এমন অপরাধ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে এনেছে (SEBI, ২০২৩-২৪)। বাংলাদেশেও এ ধরনের AI-ভিত্তিক মনিটরিং সিস্টেম চালু হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান অগ্রগতি হবে।
সরকারের পেনশন তহবিল এবং সভরেইন ওয়েলথ ফান্ডের একটি অংশ পুঁজিবাজারমুখী করা যেতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে সভরেইন ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে। যেমন— ভিয়েতনামে সভরেইন ফান্ড পুঁজিবাজারে ১৫ শতাংশ অবদান রাখে (ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ২০২৩)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এ ধরনের বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে নির্ভরযোগ্য মূলধনের উৎস সৃষ্টি করবে। এ ছাড়াও মিউচুয়াল ফান্ডে করছাড় ও REIT-এর মাধ্যমে সরকারি রিয়েল এস্টেট সম্পদ পুঁজিবাজারে আনলে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ ও লাভজনক বিকল্প পাবেন।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে পুঁজিবাজার
সদ্য ঘোষিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে পুঁজিবাজারকে উদ্ধারের জন্য অন্যতম পদক্ষেপ হলো— বাজেট ঘাটতির অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচনা করা; বন্ড, সুকুক ও ডিবেঞ্চার ইস্যুর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা; মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর কর হার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার সুপারিশ, যাতে তারা পুঁজিবাজারে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে; তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য কর হারের সুবিধা বাড়িয়ে পুঁজিবাজারে নতুন কোম্পানি আনার জন্য উৎসাহিত করা; এসএমই, স্টার্ট-আপ ও অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আনতে তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা গ্রহণের প্রস্তাব; বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে কর প্রণোদনা, সহজীকৃত বিনিয়োগ পদ্ধতি ও নীতিগত সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ৫০ লাখ টাকার ওপর ক্যাপিটাল গেইনের ক্ষেত্রে স্ল্যাব-ভিত্তিক কর ধার্য করার প্রস্তাব, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য আরো সুবিধাজনক হবে মনে করার মতো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এতে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সার্বিকভাবে দেশের পুঁজিবাজারে এখনো আগের ব্যর্থতার জের টানতে হচ্ছে। তবে এত দিনে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বাজার অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিলে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা। বিলম্ব হলেও এখনো এগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুঁজিবাজার কেবল অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রেই পরিণত হবে না; বরং সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যকার সেতুবন্ধ হিসেবেও কাজ করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এখন একটি সুযোগ আছে। তারা চাইলে পুঁজিবাজারকে ধ্বংসের গহ্বর থেকে বের করে সত্যিকার একটি অর্থনৈতিক ইঞ্জিনে রূপান্তর করতে পারে। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা, স্বচ্ছতা ও সাহসী সংস্কার। এই সমস্যা দূর করতে হলে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণকাঠামো, দক্ষতার ভিত্তিতে আইপিও অনুমোদন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ উৎসাহ ও বিনিয়োগশিক্ষা নিশ্চিত করা আবশ্যক।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট