অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি এবং বাস্তবতা
আব্দুল বায়েস [সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০২ জুন ২০২৫]

কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গল্প যেমন উচ্চ কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল, তেমনি উন্নয়ন ঘিরে নানান সমস্যার কথাও জোরালো চাউর পেয়েছিল। বিগত সরকার সমর্থকরা যখন বলতেন, বাংলাদেশ নামক দেশটি উন্নয়নের মহাসড়কে, সমালোচকরা তখন দাবি করতেন অন্যরকম : মহাসড়ক আছে বটে, তবে মানুষ মহাদুর্ঘটনার স্বীকার। বৈষম্য বৃদ্ধি, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ইত্যাদি কণ্টকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত দেশ। আসলে ব্যাপার হলো যে, বিশ্লেষণকারীর দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভর করে একই ঘটনার বিভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে। কথায় বলে, তিনজন অর্থনীতিবিদের পাঁচটির মতো অর্থাৎ কিছু নির্বাচিত বিষয় ব্যতীত অর্থনীতিবিদরা সাধারণত একমত পোষণ করেন না। এমন একটা বিষয় নিয়ে আজকের আলোচনা আবর্তিত।
দুই. মনে পড়ছে তৎকালীন সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রীর এক মজাদার মন্তব্যে নেটিজেনরা একবার বেশ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। সুদূর ব্রাসেলস থেকে আমার প্রিয় ছাত্র রাজু নুরুল মন্তব্যটি এভাবে উপস্থাপন করেছেন : ‘বাণিজ্যমন্ত্রী (টিপু মুন্সী) বলেছেন, আমার এলাকায় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, আলুভিত্তিক অর্থনীতি। লোকজনের কোনো কষ্ট নেই। মহিলারা দিনে তিনবার করে লিপস্টিক লাগাচ্ছে, চারবার করে স্যান্ডেল পাল্টাচ্ছে।’ বলা বাহুল্য, সম্ভবত তিনি বোঝাতে চেয়েছেন সমালোচকরা যত সংকটের কথাই বলুক, অন্তত তার নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ মানুষের অন্তরে কষ্ট নামক অনুভূতি একেবারেই অনুপস্থিত। অনুমান করি, সারা দেশে একই অবস্থা বিদ্যমান। তবে উচ্ছ্বসিত মন্ত্রী বাহাদুর আবেগের বশে হয়তো কিছুটা বাড়িয়ে বলেছিলেন। কারণ গুলশান, বনানীর বাসিন্দা নারীরাও দিনে তিনবার লিপস্টিক আর চারবার স্যান্ডেল বদলান কি না সন্দেহ আছে, এমনকি সুদিনেও। আমরা এটাকে তাই ‘কথার কথা’ হিসেবে ধরে নিয়ে বলব, মন্ত্রীর এলাকার নারী যখন প্রতিদিন ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায়, পায়ে স্যান্ডেল তখন ধরে নিতে হয়, ওখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভালো।
বস্তুত অর্থনৈতিক তত্ত্ব তাই বলে। মানুষের আয় বৃদ্ধি সাপেক্ষে কিছু কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে, আবার কোনো কোনো পণ্যের চাহিদা হ্রাস পায়। প্রথমটিকে বলে নরম্যাল গুড, দ্বিতীয়টি ইনফেরিওর গুড। আয় বাড়লে মূলত খাদ্যপণ্য যেগুলো প্রক্রিয়াজাত নয়, সেগুলো ইনফেরিওর হয়ে ওঠে। অন্যদিকে খাদ্যবহির্ভূত এবং কিছুটা বিলাসজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায় (নর্মাল গুড)। ধরে নিতে হয়েছিল, একটা এলাকায় নারীরা যে তিনবার লিপস্টিক লাগায় আর চারবার সেন্ডেল বদলায় তার অন্যতম প্রধান কারণ আয় বৃদ্ধির প্রভাব, সুখের হাতছানি এবং অতঃপর তিনবার লিপস্টিক এবং চারবার স্যান্ডেল। অর্থনীতিক বিশ্লেষণের দৃষ্টিকোণ থেকে তার পর্যবেক্ষণে ভুল ছিল বলে মনে হয় না। লিপস্টিক বা স্যান্ডেলের চাহিদা বৃদ্ধি অর্থনৈতিক অগ্রগতির পূর্বাভাস। এবং এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপাদান ঠিক রেখে, বিগত দশকে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির জন্য মানুষের জীবন-মান আগের চেয়ে কিছুটা উন্নত হয়েছে। হতে পারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কিংবা সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ভুল নীতির কারণে, সাধারণ মানুষের জীবন জেরবার হয়েছে, কিন্তু মোবাইল ফোন আর লিপস্টিকের ব্যবহার কমেছে বলে তো মনে হয় না।
তিন. তবে ‘থিয়োরি অব লিপস্টিক এফেক্ট’ নামে একটা তত্ত্ব আছে এবং সেটা উন্নত দেশের প্রেক্ষিতে। এই তত্ত্বের সারমর্ম হচ্ছে, লিপস্টিকের চাহিদা বৃদ্ধি অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস কিংবা আগমনের ইঙ্গিত দেয়। এ বিষয়টি নিয়ে রাজু নুরুল বিভিন্ন অধ্যয়ন থেকে ধার করে বলতে চেয়েছেন যে, এমনকি অর্থনৈতিক মন্দার সময়ও লিপস্টিক কিংবা স্যান্ডেলের চাহিদা বাড়তে পারে : অর্থনীতিতে যখন মন্দাভাব দেখা দেয় এবং টাকার অভাবে লোকজন দামি জিনিস কিনতে পারে না, তখন নিজেদের মন মেজাজ ঠিক রাখার জন্য সস্তা বা কমদামি জিনিসপাতি কেনার দিকে মনোযোগী হয়। সেই অবস্থাকে ‘লিপস্টিক থিউরি’ বা ‘অর্থনীতিতে লিপস্টিক প্রভাব’ বলা হয়। ইংরেজিতে বলে lipstick effect to economy. বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানি এস্তি লউডারের প্রধান লিওনার্দো লউডার ২০০১ সালে এই থিউরি প্রবর্তন করেন। ২০০১ সালে অর্থনীতিতে প্রবল মন্দার সময় তার কোম্পানির উৎপাদিত লিপস্টিক বিক্রির পরিমাণ ১১ ভাগ বেড়ে গিয়েছিল।
আবার ২০০১ সালে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার পর সেখানকার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে, লোকজন মন্দায় পতিত হয়। দামি জিনিস কেনার সক্ষমতা হারায়। সে অবস্থা থেকে নিজেদের মনোযোগ সরাতে তারা সস্তা জিনিস কেনার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। শুধু তাই না, ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও লিপস্টিক কেনায় ধুম পড়ে গিয়েছিল। লিপস্টিক থিউরির অন্য ব্যাখ্যা হলো, মানুষ অন্তর্গতভাবে খারাপ থাকলেও লিপস্টিক লাগিয়ে সেটাকে প্রাথমিকভাবে চেপে রাখার চেষ্টা করে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।
খেয়াল করে দেখবেন, নারীরা তাড়াহুড়া করে বের হতে গেলে কিংবা কোনো মিটিংয়ে ঢুকার আগে চুলে দ্রুত চিরুনি চালিয়ে নেয়। হাল্কা করে ঠোঁটে লিপস্টিক টেনে দেয়। এতে তার অন্যান্য অগোছালো অবস্থা বা চেহারার ক্লান্তি ঢাকা পড়ে যায়। গবেষণায় এটিও দেখা গেছে যে, লিপস্টিক যত উজ্জ্বল রঙের হয়, বিষাদ তত বেশি ঢেকে রাখা যায়। সবচেয়ে ভালো কাজ করে লাল রঙের লিপস্টিক। এতে আপনার দিকে যখন কেউ তাকায় তার সব মনোযোগ আপনার ঠোঁটে চলে যায় এবং অন্য দুর্বলতাগুলো ঢাকা পড়ে যায়। অবশ্য আমাদের তখনকার মন্ত্রী বলেননি, তার এলাকার নারীরা ঠিক কোন রঙের লিপস্টিক বেশি ব্যবহার করছেন। একইভাবে স্যান্ডেলের থিউরিও সত্য। এটিও অর্থনীতিতে মন্দার সঙ্গে সম্পর্কিত। দেশে মন্দা শুরু হলে বেকারত্ব বাড়ে, চাকরির অভাব দেখা দেয়। পূর্বে থেকে কাজে থাকা লোকজন চাকরি হারায়। ফলে বেকাররা চাকরি খুঁজতে শুরু করে। নানা জায়গায় ধর্ণা দিতে হয় বলে লোকজনকে প্রচুর হাঁটতে হয়। এতে স্যান্ডেলের ক্ষয় হয় এবং ঘন ঘন স্যান্ডেল পাল্টাতে হয়। এই যুক্তিটাকে আর একটু প্রসারিত করে বলা যায়, অর্থনৈতিক মন্দার সময় রেস্টুরেন্টে খাওয়ার এবং সিনেমা দেখার সখ জাগে এজন্য যে, মানুষ তার কষ্ট আপাতত ভুলে থাকতে চায়। আবার সংকুচিত চাকরির বাজারে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেও ওই দুটো দ্রব্য দরকার।
চার. আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এলান গ্রিন স্পেন একবার বলেছিলেন, অন্তর্বাস বা আন্ডারওয়্যার বিক্রির প্রবণতা থেকেও আন্দাজ করা যায় অর্থনীতি ভালো না মন্দ অবস্থায় আছে। অন্তর্বাসের চাহিদা সাধারণত স্থিতিশীল থাকে এবং সেই চাহিদা যখন হ্রাস পায়, তখন বুঝতে হবে মানুষের হাতে খুব একটা টাকা-পয়সা নেই। অন্তর্বাস বিক্রির সঙ্গে অর্থনীতির ওঠানামার সম্পর্ক অদ্ভুত প্রতীয়মান হতে পারে। কিন্তু এটা অর্থনীতিক নির্দেশক প্রাক্কলনের অনেক পথের মধ্যে একটি পথ বলে বিবেচনা করা হয়।
(The men’s underwear index (yes, it exists) backs up Greenspan’s theory: US sales of men’s underwear fell significantly from 2007 to 2009, during the Great Recession, but gained steam again in 2010 as the economy recovered).
মূল্যস্ফীতির কারণে জুতা বা স্যান্ডেলের তলি ক্ষয় হয় এমন একটা কথাও প্রচলিত আছে অর্থনৈতিক অধ্যয়নে। এর মানে জিনিসপত্রের দাম যখন দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী, প্রকৃত আয় নিম্নমুখী, মানুষ তখন ঘন ঘন ব্যাংকে যায় টাকা তোলার জন্য। সেটা করতে গিয়ে জুতা বা স্যান্ডেলের তলি ক্ষয় হওয়া স্বাভাবিক। সুতরাং কী কারণে মানুষ দিনে তিনবার স্যান্ডেল পরছে, সেটা অবশ্যই গবেষণার বিষয়।
পাঁচ. এই নিবন্ধের মূল কথা, অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির পূর্বাভাস দিতে বিশেষ বিশেষ মডেলের দরকার হয় এ কথা ঠিক। তবে ওই যে বলে, আক্কেল মন্দ কে লিয়ে ইশারায় কাফি। ঠিক সে রকম লিপস্টিক, অন্তর্বাস কিংবা স্যান্ডেলের মতো ছোটখাটো পণ্য বিক্রয় পরিসংখ্যান থেকেও আঁচ করা যায় সেই গতিপ্রকৃতি যেমন সুনামির আঁচ পেয়ে প্রাণিকুল দৌড়ে গৃহস্থের বাড়ি অব্দি পৌঁছায় এবং গৃহস্থ টের পায়, সুনামি আসতে চলেছে।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়