অর্থনৈতিক ও শিল্পোন্নয়নে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
পান্থ রহমান। সূত্র : আমাদের সময়, ০৬ মে ২০২৫

উন্নয়নশীল দেশ হয়ে ওঠার মতো বড় আর গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক অবস্থানের দিকে আরেকটু ওপরে ওঠার এই দৌড়ে বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ বিদ্যুৎ-জ্বালানির চাহিদা মেটানো। শিল্প খাতের বিস্তার, মোটা দাগের নগরায়ণ আর দ্রুত ডিজিটালাইজেশনের পথে হাঁটতে থাকা নতুন বাংলাদেশের জন্য এই চাহিদা পূরণ করা সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ আরও শক্ত হয়ে উঠেছে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার তাগিদের কারণে।
বিনিয়োগ যথাযথ না হওয়ার কারণ হিসেবে খালি চোখে দেখা ও জানা তথ্যের ভিত্তিতে মোটা দাগে একটা উপসংহার টানা যায়। চোখ-কান যাদের খোলা তারা আপাতদৃষ্টে বিনিয়োগ কম হওয়ার কিছু কারণ খুঁজে পাবেন। এই যেমন- আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতা, অলিখিত ও অপ্রকাশিত লেনদেন, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যোগাযোগব্যবস্থার অপ্রতুলতা ইত্যাদি।
তবে মোদ্দা হলো, বিনিয়োগ পরিবেশ। বিদেশি মিশনগুলোর প্রতিনিধি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বরাবরই এ নিয়ে কথা বলেছেন। যদিও বিনিয়োগ পরিবেশ কথাটার ব্যাপ্তি অনেক। বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ কারণগুলো নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন কখনও কখনও। তাদের মূল কথা ‘সার্বিক অব্যবস্থাপনা’। আর এই সার্বিক অব্যবস্থাপনার একটি হলো নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট।
বিনিয়োগকারীকে ডেকে এনে বিদ্যুৎ-জ্বলানি সরবরাহ করতে না পারলে উৎপাদন হবে কোত্থেকে। উৎপাদনকেন্দ্রিক বিনিয়োগে মূল চাওয়া নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-জ্বালানি। যেখানে বড় ধরনের সংকট আছে বাংলাদেশে।
গোটা দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটানোর সঙ্গে শিল্পে জ্বালানি সরবরাহ করার চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশে সব সময়ই ছিল, এখনও আছে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বিগত সরকারগুলো কিছু উদ্যোগ নিয়েছে ঠিকই, তবে তা পর্যাপ্ত মনে হয়নি কখনই।
দেশের মানুষের চাহিদা মেটানোর পর শিল্পে জ্বালানি সরবরাহের ব্যাপারটি বরাবরই বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জের ছিল এবং এখনও আছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে ওঠা যায়নি। তবে চেষ্টা ছিল। সেই চেষ্টার অংশ রূপপুরের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট।
২.
এ-ও ঠিক যে, এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের যতটা অগ্রগতি তার প্রায় অনেকটাই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অবদান। কারণ বিদ্যুৎ ছাড়া শিল্প চলে না। নগর, প্রযুক্তি চলে না।
যদিও সেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশের বড় ভরসা ছিল জীবাশ্ম-জ্বালানি আর প্রাকৃতিক গ্যাস। এই নির্ভরশীলতা কমানোর চেষ্টা ছিল বটে; তবে সেই চেষ্টার গতি বেড়েছে কিছুদিন ধরে। আর সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে বিকল্প হয়ে আসে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প।
যদিও প্রাথমিকভাবে এই শক্তিকে উচ্চাভিলাষী মনে হতে পারে; তবে কার্যকরী তাতে সন্দেহ নেই। বিশে^র বিভিন্ন দেশে এর প্রমাণ মিলেছে। এই জ্বালানি উৎস নিয়ে অবশ্য নানাজনের নানামত আর ভিন্নমত আছে। দুনিয়াজুড়ে বিতর্কও চলমান। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেমে নেই। বরং দেশে দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মেটাচ্ছে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে ইতিবাচক বিশেষজ্ঞদের ধারণা বিদ্যুৎ সরবরাহে স্থিতিশীলতা আনতে পারে রূপপুরের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর তাতে করে টেক্সটাইল, গার্মেন্ট ও ভারী শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয়ের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা কমে গেলে শিল্প খাতে উৎপাদন খরচও কমে যাবে।
শুধু তাই নয়, বিশেষজ্ঞমত হলো- রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন ইন্ডাস্ট্রিয়ালজোন গড়ে উঠতে পারে। এতদিন যারা সাহস করে তথ্যপ্রযুক্তি, অটোমেশন, ই-কমার্স কিংবা কৃষিভিত্তিক শিল্পগুলোতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখাননি তারাও আগ্রহী হতে পারেন।
৩.
যদিও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা-শঙ্কার বিষয়টুকু নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিশেষজ্ঞদের একটা অংশ কথা তোলেন পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে অপারেশনাল ব্যয়ের হিসাব নিয়ে।
বলা হয়, পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন একটু খরুচে, হ্যাঁ এটা ঠিক প্রথমে এর বিনিয়োগ অনেক। কিন্তু যদি দীর্ঘমেয়াদে ভাবা হয় বা দেখা যায় তবে সে খরচ বেশি নয়। সাধারণ একটি প্রচলিত গ্যাস বা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর চলে। কিন্তু পরমাণু বিদ্যুৎ সত্তর থেকে একশ বছর চলে। ফলে বেশি খরচের যে সমালোচনা তা সাময়িক। দীর্ঘমেয়াদে হিসাব করলে এই খরচ কমই।
আর একটা বড় কথা হচ্ছে, জ্বালানি খরচের নিশ্চয়তা। এর দাম বাড়ার সহসা কোনো আশঙ্কা নেই। আমাদের মতো জ্বালানি আমদানিনির্ভর দেশে এটা বড় পাওয়া। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের ওঠানামায় দেশের বাজেটে কাটছাঁট করার ঘটনা কম নয়। রূপপুর অন্তত সেই স্বস্তি দেবে আশাকরি।
মোটের হিসেবে জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় এটি লাভজনক হিসেবেই প্রমাণিত। এর মূল কারণ সম্ভবত জ্বালানি-উৎসের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল থাকা। তার ওপর উৎস ঠিক থাকলে দীর্ঘমেয়াদে এই জ্বালানি উৎপাদনে জটিলতাও কম।
তার পরও এত বিতর্ক কেন? কিংবা কেনই বা এই জ্বালানিকে এত প্রয়োজনীয় প্রমাণের চেষ্টা?
দুটোর প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর নেই। আর ইনিয়ে-বিনিয়ে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা হলে কোনো না কোনো পক্ষে যাবে। তার চেয়ে বরং একে সেই আদি ও অকৃত্রিম সূত্রে ফেলা যাক; চাহিদা ও জোগানের সমীকরণে! বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মাথায় রেখে যতটা সম্ভব জ্বালানি উৎস খোঁজার অংশ হিসেবে যুক্ত হয়েছে পাবনার রূপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
৪.
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও শিল্প বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গেম-চেঞ্জার। আশা করা হচ্ছে, রাশিয়ার রোসাটমের সহযোগিতায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোপুরি সক্রিয় হলে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে।
তখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রায়োরিটি শিল্প গার্মেন্ট থেকে শুরু করে রপ্তানিমুখী শিল্প খাতগুলো আরও বেশি স্বস্তিতে থাকবে। কমে আসবে আমদানিনির্ভরতা। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। তাতে দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যুৎ-জ্বালানি উৎপাদনের কারণে যে চাপ পড়ে তা কিছুটা লাঘব হবে বলে ধরে নেওয়া যায়। এর সঙ্গে বড় প্রাপ্তি হতে পারে বৈশি^ক বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসা। ওটা হতে পারে বাড়তি পাওয়া।
শুধু বিনিয়োগকারীদের জন্যই নয়, বরং দেশের ভেতরেও এর প্রভাব পড়তে পারে। যেমন এই বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে এরই মধ্যে গড়ে উঠতে শুরু করেছে একটি উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর জনবল এবং তাকে ঘিরে আরেকটি পারমাণবিক সক্ষমতাভিত্তিক শিল্পক্ষেত্র। পরমাণু প্রকল্পে কাজ করার মাধ্যমে যেখানে বিদেশিদের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে দেশীয় প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও কারিগরি জনবল। তাতে তৈরি হচ্ছে আরেকটি দক্ষ ও বিশেষায়িত মানুষ। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বৈশি^ক কর্মবাজারেও।
আর সব বিবেচনায় অনেকেই মনে করছেন বাংলাদেশে শিল্প বৃদ্ধির অনুঘটক হয়ে উঠবে এই রূপপুরের বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাংলাদেশ যখন টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং ইস্পাতের মতো শিল্পে নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টায়, তখন পারমাণবিক জ্বালানি উৎস সত্যিই স্বস্তি আনবে। তাতে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ তৈরি হবে বাংলাদেশের।
এখনও পর্যন্ত যে শিল্পগুলো বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলেছে এবং উৎপাদনশীলতা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে; তাদের জন্যও রূপপুর প্রকল্প আশীর্বাদ হবে বলে ধারণা।
৫.
এই শিল্প উৎপাদন আর প্রকৌশলের জটিল ধারণার বাইরে একটু ভিন্ন প্রাপ্তিও যোগ হতে পারে রূপপুর প্রকল্প থেকে। পারমাণবিক বিদ্যুতের যুগে প্রবেশের মাধ্যমে একটু নাক-উঁচু অবস্থান তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের। কেননা এই বিদ্যুৎ প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিশ্বের কিছু উন্নত পারমাণবিক প্রযুক্তিতে এক্সেস পেয়ে যাচ্ছে। তাতে খুলে যাবে বেশ কিছু আন্তর্জঅতিক সহযোগিতার দরজাও। বিশেষ করে পারমাণবিক প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত খাতে উন্নত গবেষণা ও সক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে।
আর সব প্রাপ্তির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে বৈশি^ক দায়িত্বশীল দেশের তকমা। নির্ভরযোগ্য আর পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎস হওয়ায় কমতে পারে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎনির্ভরতা। তাতে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথেও আরেকটু ভূমিকা রাখার সুযোগ হবে বাংলাদেশের।
তবে মনে রাখা ভালো, এই প্রকল্পের সুফল তখনই ঘরে উঠবে যখন পুরোটা একটি দক্ষ ব্যবস্থাপনার আওতায় আসবে। যখন এই প্রকল্পে থাকবে সত্যিকারের স্বচ্ছতা। সঠিক পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন হলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বদলে দিতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো।
শেষ কথায় কিছু চ্যালেঞ্জ থাকবেই। যে নিরাপত্তা নিয়ে পরমাণু বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা আছে, তা তো একেবারে ফেলনা নয়। কারণ সামান্যতম ভুলও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। তার ওপর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আর স্বচ্ছতার প্রশ্নও একেবারে অমূলক নয়। আর এসব ক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক মান রক্ষা জরুরি। সেটাই বরং চেষ্টার জায়গা হওয়া উচিত। দেশের বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ করার সঙ্গে শিল্প ও অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এটুকু সতর্ক থাকা তো বাঞ্ছনীয়ই।
পান্থ রহমান : সাংবাদিক