কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

অভিবাসী দিবসে আমাদের অভিবাসীদের নিয়ে ভাবনা

এ কে এম আতিকুর রহমান [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫]

অভিবাসী দিবসে আমাদের অভিবাসীদের নিয়ে ভাবনা

২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এই দিবসটিতে অভিবাসীরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হন; যেমন—বৈষম্য, শোষণ এবং সামাজিক একীকরণের ক্ষেত্রে বাধা, সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। যেহেতু অভিবাসী কর্মী প্রেরণকারী প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, তাই বাংলাদেশে প্রতিবছরই এই দিবসটি যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে উদযাপিত হয়।

 


দেশে ছাড়াও বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতেও দিবসটি উদযাপনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন করা হয়।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস পালনের মূল লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে সমাজের সব স্তরে সামাজিক একীকরণ এবং অভিবাসীদের অন্তর্ভুক্তির প্রচার। অভিবাসীদের মানবাধিকার সুরক্ষা এবং পরিপূর্ণতার জন্য তাঁদের অবস্থান-নির্বিশেষে সমর্থন করা। আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা এবং বর্ণবাদ মোকাবেলার কর্মপরিকল্পনায় অভিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করতে সব দেশকে উৎসাহিত করা।

 

 


যেহেতু আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উদযাপন একটি বিশ্বব্যাপী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, তাই আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার শত শত দেশীয় কার্যালয় এবং স্থানীয় সংস্থাও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৭২ মিলিয়ন মানুষ অভিবাসী, যার মধ্যে ৪১ মিলিয়নেরও বেশি অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি রয়েছেন। এ বছর দিবসটি পালনের প্রতিপাদ্য বিষয় (থিম) হলো অভিবাসীদের সম্মান করা এবং একটি অংশীদারি ভবিষ্যৎ গঠন করা। অর্থাৎ সমাজের জন্য অভিবাসীরা যে মূল্যবান অবদান রাখছেন এবং তাঁরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, সেই বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করাই এবারের থিমের মুখ্য উদ্দেশ্য।

 

 


অভিবাসীরা যাতে শোষণের শিকার না হন সে জন্য জাতিসংঘ কাজ করে যাচ্ছে। অভিবাসন যাতে নিরাপদ হয়, তা নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে। আর এসব করার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সেই কাজটি করার মাধ্যমেই আমরা অভিবাসীদের প্রতি সম্মান জানাতে পারি, তাঁদের নিয়ে আমরা একটি অংশীদারি ভবিষ্যৎ গঠনের পথে অগ্রসর হতে পারি। এবারের আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস পালনে এসব বিষয় নিয়েই আলোকপাত করা হবে।

 

 

 

আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই সমাজের ওপর অভিবাসীদের প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান দিবসটি পালনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে যেসব কর্মসূচি নেয়, তাতে অভিবাসীদের বিভিন্ন সমস্যা এবং তাঁদের অভিজ্ঞতাকে সবার সঙ্গে ভাগ নরে নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশের এমন কোনো এলাকা নেই, যেখানে ফিরে আসা বা বিদেশে কর্মরত অভিবাসীদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই দিবসটি পালনের জন্য বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় আয়োজিত সেসব সভা-সমাবেশে অভিবাসীদের অবদান ও অভিবাসন সম্পর্কিত বিষয়াদিসহ কর্ম শেষে ফিরে আসা অভিবাসীদের দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কিভাবে সম্পৃক্ত করা যায়, সেসব বিষয় গুরুত্বসহকারে আলোচনা করা হয়।

 

 

 

অভিবাসী দিবসে আমাদের অভিবাসীদের নিয়ে ভাবনা

অভিবাসীদের মধ্যে আমরা দুটি শ্রেণি দেখতে পাই—স্থায়ী ও অস্থায়ী বা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। স্থায়ী অভিবাসীরা উন্নত জীবনের সন্ধানে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়া বেছে নিয়ে থাকেন। এটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে; যেমন—চাকরির সন্ধানে, পড়াশোনা করার জন্য অথবা পরিবারের সদস্যদের কাছে যাওয়া। অনেক অভিবাসী তাঁদের পরিবারকেও তাঁদের নতুন দেশে নিয়ে যান। অনেকে আবার নিজের দেশে যুদ্ধ এবং সংঘাতের সম্মুখীন হয়ে নিরাপত্তার জন্য তাঁদের দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে অন্য দেশে নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য কেউ আবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়াকে নিরাপদ মনে করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ; যেমন—ভূমিকম্প, হারিকেন, সুনামি ইত্যাদির মতো অনেক কারণ রয়েছে, যে জন্য মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এ ছাড়া রয়েছেন অভিবাসী কর্মী, যাঁরা নির্দিষ্ট দেশে নিযুক্ত কাজকর্ম শেষ করে নিজ দেশে ফিরে আসেন। যেসব অভিবাসী শরণার্থী হিসেবে অন্য দেশে অবস্থান করেন, তাঁরা তাঁদের দেশে ফিরে আসার পরিবেশ সৃষ্টি হলেই ফিরে আসেন।  

 

 

 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি রয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই অস্থায়ী কর্মী হিসেবে ওই সব দেশে কর্মরত। গত তিন বছর ১০ লাখের বেশি করে কর্মী বিদেশে গেছেন। ২০২৪ সালে মোট ১০ লাখ ১১ হাজার ৮৫৬ জন কর্মী বিদেশে গেছেন, যা ছিল দেশের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ। তবে তাঁদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ কর্মীই গেছেন মাত্র পাঁচটি দেশে—সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। রেমিট্যান্সপ্রাপ্তির হার এখনো ভালো। ২০২৪ সালে দেশে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। বর্তমান বছরে তা ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে (নভেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত রেমিট্যান্স ২৯.৫৮ বিলিয়ন ডলার)। 

 

 

 

তবে বর্তমান বছরে বিদেশে কর্মী যাওয়ার হার কিছুটা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। কারণ নতুন শ্রমবাজার যেমন তৈরি হয়নি, তেমনি পুরনো বাজারও দুর্নীতির কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনটি বড় শ্রমবাজার; যেমন—মালয়েশিয়া, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া সৌদি আরব ও কাতারের মতো দেশগুলোতে নিয়োগ কমে যাওয়ায় এবং মালয়েশিয়া, ওমানের পাশাপাশি বাহরাইনের শ্রমবাজারও বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠেছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে বিদেশে কর্মী প্রেরণ হুমকিতে পড়ার আশঙ্কাই বেশি। তাই জরুরিভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশে যেমন কর্মী প্রেরণের উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনি নতুন গন্তব্যও খুঁজতে হবে। আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে সেটিই আমাদের কাম্য।

 

 

 

বিদেশে কর্মী প্রেরণ ‘মানবব্যবসা’ নয় এবং অভিবাসী কর্মীরা ব্যবসার কোনো পণ্যও নন। তাই অভিবাসী কর্মী প্রেরণপ্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের অভিবাসী কর্মীদের যেভাবে শোষণ করা হয়, তা বন্ধ করতে হবে। অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় হওয়ায় আমাদের মহিলা কর্মীদের অভিবাসনব্যবস্থা হতে হবে সম্পূর্ণ নিরাপদ। দক্ষ কর্মী সৃষ্টিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়াসহ দক্ষ কর্মী প্রেরণে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে অবৈধ অভিবাসন বা মানবপাচার বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থাও নিতে হবে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইদানীং যেভাবে অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। সর্বোপরি অভিবাসনক্ষেত্রে দেশের মানুষকে সচেতন করতে আমাদের মিডিয়ারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বলতে গেলে, একটি সুপরিকল্পিত কর্মীবান্ধব অভিবাসনব্যবস্থাই দেশের সার্বিক উন্নয়ন গতিধারাকে ত্বরান্বিত করতে পারে।

 

 

 

অভিবাসীদের নিজ দেশের এবং কর্মরত দেশের জনগণের মধ্যে অভিবাসীদের অবদানকে সম্মান, তাঁদের নিয়ে একটি অংশীদারি ভবিষ্যৎ গঠন এবং মানবাধিকারসহ জাতিসংঘ নির্ধারিত অভিবাসীদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব হলেই দিবসটি উদযাপন করা সার্থক হবে।

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব